ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

একের পর এক প্রতিষ্ঠানের রিট, পক্ষে রায়

এবারও চ্যালেঞ্জের মুখে কলেজে ভর্তি নীতিমালা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৭ মে ২০১৭

এবারও চ্যালেঞ্জের মুখে কলেজে ভর্তি নীতিমালা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে কলেজে ভর্তি নীতিমালা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভর্তি নীতিমালার বিরুদ্ধে আদালতে যাচ্ছে একের পর এক প্রতিষ্ঠান। রায় নিয়ে গত তিন বছরের মতো এবারও নটর ডেম, হলিক্রস ও সেন্ট জোসেফ স্কুল এ্যান্ড কলেজ শুরু করেছে নিজস্ব নিয়মে ভর্তি কার্যক্রম। মঙ্গলবার আরেক নামী প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের ক্ষেত্রেও ভর্তি নীতিমালা স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নীতিমালা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুলও দিয়েছে হাইকোর্ট। এদিকে নীতিমালার কারণে ‘চরম ক্ষতিগ্রস্ত’ হচ্ছে এ অভিযোগ এনে আদালতে যাওয়ার চিন্তা করছে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। দাবি উঠেছে এবারই বাতিল হোক নীতিমালা। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও শিক্ষকরা বলছেন, ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া এসএসসির ফলের ভিত্তিতে ভর্তি, উপর থেকে শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থী চাপিয়ে দেয়া ও নীতি মানতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের স্বকিয়তা নষ্ট হয়ে যাওয়াসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তারা অবিলম্বে নিয়ম বাতিল করে নতুন কোন নীতিমালার মাধ্যমে কলেজ ভর্তি শুরু করার দাবি জানিয়ে বলেছেন, আমরাও চার নামী কলেজের মতো আদালতে যাওয়ার কথা চিন্তা করছি। কারণ, এ নীতিমালার ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে তাদের প্রতিষ্ঠান। নীতিমালার মাধ্যমে ভর্তির সকল প্রক্রিয়া সম্পর্কে তারা অন্ধকারে থাকছেন বলেও অভিযোগ তুলেছেন। জানা গেছে, নীতিমালা তিন বছর ধরে বাস্তবায়ন হলেও নটর ডেম কলেজ, হলিক্রস ও সেন্ট জোসেফ স্কুল এ্যান্ড কলেজ শুরু থেকেই আদালতে নীতিমালার স্থগিতাদেশ নিয়ে নিজস্ব নিয়মে শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। তারা আদালতে রিট করে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েই করছে শিক্ষার্থী ভর্তি। সরকারী নিয়ম মানলে একদিকে ভাল শিক্ষার্থী ভর্তি করা সম্ভব নয় অন্যদিকে তাদের প্রতিষ্ঠানের স্বকিয়তা নষ্ট হচ্ছে-এমন অভিযোগ এনে আদালতে রিট করে জয়ী হয় তিন প্রতিষ্ঠান। একই প্রক্রিয়ায় এবারও তারা পেয়েছে আদালতের রায়। সেই রায় নিয়ে ইতোমধ্যেই তারা শুরু করেছে ভর্তি কার্যক্রম। এতদিন ধারণা ছিল, এ তিন প্রতিষ্ঠানই হয়ত নিজস্ব নিয়মে ভর্তি করবে। তবে এবার সেই হিসাব পাল্টে দিল ছাত্রীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ। প্রতিষ্ঠানটির গবর্নিং বডির এক সদস্যের রিটের পর নটর ডেম কলেজ, হলিক্রস ও সেন্ট জোসেফ স্কুল এ্যান্ড কলেজের সঙ্গে যোগ দিল এ প্রতিষ্ঠানও। ফলে নীতিমালার ভবিষ্যত নিয়েই চিন্তিত শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের কর্মকর্তারা। দুুদিন আগে এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মোঃ সাইফুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই বলে আদেশ দেয় যে, মেধা তালিকার ভিত্তিতে নয়, ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই শিক্ষার্থীদের রাজধানীর হলিক্রস, নটর ডেম ও সেন্ট জোসেফ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে হবে। পাশাপাশি এ তিন কলেজের ক্ষেত্রে মেধা তালিকায় ভর্তির নীতিমালার ধারা কেন আইনগত কতৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা এক রুল দিয়ে জানতে চেয়েছে উচ্চ আদালত। চার সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা সচিব, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষােেবার্ড, ঢাকার চেয়ারম্যান ও কলেজ পরিদর্শককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী রমজান আলী সিকদার ও তানিম হোসেন শাওন। সারা দেশে উচ্চ মাধ্যমিক ভর্তির ক্ষেত্রে গত ৭ মে মেধা তালিকা অনুসারে ভর্তির জন্য একটি নীতিমালা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নীতিমালার কয়েকটি ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করে এ তিন কলেজের অধ্যক্ষ। তারা হলেন, হলিক্রস কলেজের অধ্যক্ষ সিস্টার শিখা এল গোমেজ, নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার হেমন্ত পিয়াস রোজারিও এবং সেন্ট জোসেফ কলেজের অধ্যক্ষ ব্রাদার রবি ফিউরিফিকেশন। রিটকারীদের আইনজীবী তানিম হোসেন শাওন বলেন, আদালতের এ আদেশের ফলে এই তিন কলেজ তাদের নিজস্ব নিয়মে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারবে। তিনটি কলেজের ক্ষেত্রে ভর্তি নীতিমালা কেন স্বতন্ত্র হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমত এই তিনটি কলেজই সরকারী অনুদান ছাড়া পরিচালিত হয়। তাছাড়া সার্কুলারটির বেশ কয়েকটি ধারা অস্বচ্ছ এবং স্বেচ্ছাচারী। ফলে মন্ত্রণালয়ের জারি করা নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হলে শিক্ষার গুণগত মান রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এসব কারণ উল্লেখ করেই রিটটি করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় আদালতে রিট করে মঙ্গলবার নিজেদের পক্ষে রায় পেয়েছে নামী প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ। এর ফলে মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী এসএসসিতে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি না করে নিজস্ব নীতিমালায় পরীক্ষার মাধ্যমে একাদশে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে রাজধানীর এ নামী কলেজটি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভর্তি নীতিমালা-২০১৭ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে একটি রুলও দিয়েছে হাইকোর্ট। এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেয়। চার সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা সচিব, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ চারজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। গত ১০ মে দেশের সকল সরকারী-বেসরকারী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য জারি করা ওই নীতিমালা অনুযায়ী ভিকারুননিসা কলেজে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ রিট আবেদনটি করেন। তিনি বলেছেন, ১৯৬১ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধ্যাদেশ অনুযায়ী দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। বোর্ডের কাজ কী হবে তা অধ্যাদেশে ২, ৩, ১৮ ও ৩৯ ধারায় নির্ধারণ করে দেয়া আছে। ভর্তি ও পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয় বোর্ড নির্ধারণ করবে। কিন্তু সরকার সার্কুলারে সেই ক্ষমতা বোর্ডকে দেয়নি। ওই অধ্যাদেশের সঙ্গে মিল রেখে ২০০৯ সালে রেগুলেশন তৈরি করা হয়, যেখানে ৪২ ধারায় কলেজের ভর্তি প্রক্রিয়া অধ্যক্ষের হাতে ন্যস্ত আছে। সে অনুযায়ী সরকারী সার্কুলার এই রেগুলেশনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক বলে বলছেন তিনি। সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ রায় বলেন, জনস্বার্থে এই রিট আবেদন করা হলেও এটি শুধু ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। আদালত যে স্থগিতাদেশ দিয়েছে আমরা এর বিরুদ্ধে চেম্বার আদালতে যাব। দেশের সরকারী- বেসরকারী কলেজে একাদশ শ্রেণীতে শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনলাইন ও এসএমএসে আবেদন জমা নেয়া শুরু হয়েছে ৯ মে। চলবে ২৬ মে পর্যন্ত। ভর্তি নীতিমালায় বলা হয়েছে, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইনে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে হবে। এ বছর মাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী ছাড়াও ২০১৫ ও ২০১৬ সালে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণরাও একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারবেন। বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ইনফর্মেশন এ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইআইসিটি) এবং কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবার একাদশে ভর্তির আবেদন গ্রহণ ও প্রক্রিয়াকরণে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। এদিকে নীতিমালা নিয়ে সঙ্কট ক্রমশ বাড়ছে। ইতোমধ্যেই দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান আদালতে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ‘চরম ক্ষতিগ্রস্ত’ হচ্ছেন এ অভিযোগ এনে আদালতে যাওয়ার চিন্তা করছে বেসরকারী অনেকে প্রতিষ্ঠান। সম্ভব এবারই বাতিল করা হোক নীতিমালা- এমন দাবি করে ক্যাম্ব্রিয়ান স্কুল এ্যান্ড কলেজের চেয়ারম্যান লায়ন এম কে বাশার বলছিলেন, সত্যি বলতে কি এ নীতিমালা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তা অনেক আগেই আমরা বলেছিলাম। কারণ, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে এতে। তিনি বলেন, সরকার যে নীতিমালা করেছে তাতে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে লেখাপড়া ভাল হচ্ছে না তা তো প্রমাণিত। এখন মহামান্য আদালতের রায়ের পর প্রমাণিত হলো, এ ভর্তি নীতিমালা আদালতের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়। সম্ভব হলে এবারই নীতিমালা বাতিল করা উচিত। এদিকে ট্রাস্ট কলেজের অধ্যক্ষ বশির আহমেদ ভূইয়া বলেছেন, নীতিমালা নিয়ে আমরাও আদালতে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছি। এটা আমাদেরও করা জরুরী হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আগের নিয়ম যখন ছিল আমরা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে পারতাম। গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য কোন উপকার করার চিন্তা করলেও তাকে ভর্তিতে সাহায্য করতে পারতাম। কিন্তু এখন আমরা অন্ধকারে আছি। কোথায় কি হচ্ছে? কত শিক্ষার্থী পাব? কারা ভর্তি হবে? কিছু আমরা জানি না। এটা কোন কথা হতে পারে না।
×