ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুভাষ সিংহ রায়

শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন থাকবেন

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ১৭ মে ২০১৭

শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন থাকবেন

আজ পৃথিবীর সর্বত্র শেখ হাসিনাকে নিয়ে আলোচনা হয়। এটা একদিনে হয়নি। দীর্ঘ সাধনা সংগ্রামের ফলে আজ যে তাঁর অবস্থান এ কারণেই। নিরদ্বিধায় বলতে পারি তিনি অনেক কারণে বাঙালী জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অত্যাবশ্যকীয় আছেন, থাকবেন। তাঁর কর্মকূশলতাই তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে। রাজনীতিতে তাঁর নিত্য যাওয়া-আসা ছিল। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের আগাম বার্তা ছিল না। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দীর্ঘ ছয় বছর যন্ত্রণাদগ্ধ প্রবাস জীবন কাটিয়ে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। আমরা কি এখন ভাবতে পারি, শেখ হাসিনা কত দুঃখ-কষ্ট এক জীবনে পেয়েছেন? শুনেছি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের সময়টাতে বিশেষ আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ও জামাতা ড. ওয়াজেদ বেলজিয়ামে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের বাসায় গিয়েছিলেন। ডিনার পার্টি দারুণ আতিথেয়তায় ভরা ছিল; কিন্তু যে মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু সংবাদ পৌঁছাল তখনই রাষ্ট্রদূতের আচরণ খুবই ভয়ানক হয়ে যায়। গত বছর জাতিসংঘের অভিবাসন সম্মেলনে শেখ হাসিনা দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ ছয় বছর অভিবাসী জীবনের যন্ত্রণার কথা জানিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে বিশ^বাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, (পৃথিবীর বড় বড় দেশের নেতারা সেটা উপলব্ধি না করলেও) বিশে^র সব অভিবাসীর ন্যায়সঙ্গত লড়াইয়ে শেখ হাসিনা আছেন এবং সব সময় থাকবেন। বাংলাদেশের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোকাবেলা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা তাঁর এক সাক্ষাতকারভিত্তিক লেখায় বাঙালীর ষড়যন্ত্র ও অবিশ^াসের উদাহরণ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের সময় বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত ছিলেন সানাউল হক। ১৫ আগস্টের নির্মম ঘটনার (বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের নিহত হওয়ার) ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন সানাউল হক। মি. সানাউল হক হুমায়ূন রশীদকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আপনি ঝামেলা পাঠিয়েছেন, আপনি সলভ করবেন। আমি এদের রাখতে পারব না।’ শেখ রেহানা তাঁর সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘গত রাতে যাদের সম্মানে তিনি ঈধহফষব খরমযঃ উরহহবৎ-এর আয়োজন করেছিলেন, তাঁরা মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে হয়ে গেলেন ‘ঝামেলা’।’ যা হোক হুমায়ূন রশীদ সবাইকে জার্মানিতে পাঠিয়ে দিতে বললেন। সেখানে মিসেস হুমায়ূন বুকে টেনে নিলেন সবাইকে। বললেন, ‘আমি আছি, তোদের চাচা আছে, চিন্তা করিস না।’ শেখ রেহানা তাঁর স্মৃতি চারণে উল্লেখ করেছেন, ‘আগস্টের সেই ১৩ তারিখে জার্মানিতে সিনেমা হলে গিয়ে একটা ছবি দেখেছিলাম আমরা, ‘মডার্ন ইন এ ওরিয়েন্টাল এক্সপ্রেস।’ কীভাবে ষড়যন্ত্র করে মারা হয়, আর কীভাবে প্রতিশোধ নেয়া হয়, সিনেমাটা ছিল সেই ঘটনার ওপর। গায়ে কাঁটা দিয়েছিল যে, মানুষ কী নৃশংসভাবে ষড়যন্ত্র করতে পারে। পরেও আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়েছে এই ভেবে যে, আমাদের জীবনের সঙ্গেও ছবিটির হত্যা-ষড়যন্ত্রের কী গভীর যোগ ছিল।’ শেখ হাসিনাকে অনেক আপনজনও ছেড়ে গেছেন; তা নিয়ে তিনি ভাবনা করেননি। বঙ্গবন্ধুর সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যার কিনা আন্তর্জাতিক পরিচিতিও ছিল, তিনিও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর দায়িত্ব পালন করেননি। পৃথিবীর সব রাষ্ট্র যাতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয়, সে ব্যাপারে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নিজে তাঁকে সেই অনুরোধটা করেছিলেন কিন্তু রহস্যজনক কারণে তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেননি। দৈনিক ইত্তেফাকের ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ সালের সংখ্যা থেকে জানতে পারি, কীভাবে শেখ হাসিনা ওই সময়ে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করেছেন। সেই সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে এগিয়ে যান।’ তাঁর একটি বার্তা সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক সম্মেলনে পাঠ করে শোনান। জনাব তোফায়েল আহমেদ টেলিফোনে শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ সেলিমের আলোচনার কথা উল্লেখ করে ইতোপূর্বে ঘোষণা করেন ‘একটি সুসংবাদের অপেক্ষায়’ তারা আছেন। শেখ হাসিনা তাঁর বার্তায় সব প্রকার দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে কাউন্সিলর এবং নেতাদের বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচী বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। আর সুসংবাদটি হচ্ছে, শেখ হাসিনা সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে বৈরুত থেকে আগত ফিলিস্তিনী মুক্তি সংস্থার রাজনৈতিক শাখার পরিচালক জাকারিয়া আবদুর রহিম তার শুভেচ্ছা বক্তৃতায় শেখ মুজিবের মৃত্যুকে সারা বিশ্বের সংগ্রামরত জনগণের জন্য বেদনাবহ ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এক দশক-দুই দশক পরে হলেও বাংলাদেশে শেখ মুজিবের উত্তরসূরি আবার ক্ষমতায় আসবেÑ এ কথাও তিনি বলেছিলেন। তার কথা শেষ পর্যন্ত বাস্তব রূপ পেয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ প্রায় দুই দশক বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের নাম-নিশানা মুছে ফেলে দেয়া হয়েছিল সুপরিকল্পিত উপায়ে, শেখ হাসিনার প্রথম সরকার আমলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়। দুই দশকজুড়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে আগ্রাসন চালানো হয়েছিল, শেখ হাসিনার শাসনামলে তার অবসান ঘটে।’ শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন বলেই কৃষক, শ্রমিক, জনতা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশ নিয়ে শুধু নিরাশার কথা শুনিয়েছে। তিন তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই দেশটাকেই উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করেছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় আজ ১৬০২ ডলার। পৃথিবীর সব রাষ্ট্র নেতারা শেখ হাসিনাকে বলে থাকেন, ‘আপনি তো উন্নয়নের বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন।’ যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধান ডেভিড ক্যামেরন, শেখ হাসিনার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন, ব্রেক্সিট নিয়ে অভিমত জানতে চেয়েছিলেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে শেখ হাসিনার পরামর্শ চাইতে দেখি। ২০১৪ সালে ইউনেস্কো প্রধান ইরিনা বোকোভা বলছিলেন, ‘সাহসী নারী’ শেখ হাসিনা সমগ্র জাতিকে পথ দেখাচ্ছেন।’ নারী ও কন্যা শিশুদের শিক্ষা প্রসারে স্বীকৃতি স্মারক ‘শান্তি বৃক্ষ’ দেয়ার সময় বলেছিলেন, নারী ও কন্যা শিশুদের ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব মঞ্চের ‘জোরালো এক কণ্ঠ।’ নিজের পায়ে দাঁড়ানো, নিজের স্বাভাবিকতা ও সৃষ্টিশীলতাকে বজায় রাখার জন্য যে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ তার জন্য শেখ হাসিনা অত্যন্ত জরুরী বৈকি। এ ব্যাপারে অসংখ্য উদাহরণের একটি এখানে উল্লেখ করা যায়। ২০০৭ সালের ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অসুস্থ পুত্রবধূকে দেখতে ব্যক্তিগত সফরে যুক্তরাষ্ট্রে যান। তারপর থেকে দেশের ভেতরে উচ্চাভিলাষী চক্র তাঁকে দেশে ফিরতে না দেয়ার নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। প্রথমে জনৈক ঠিকাদারকে বাগে এনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেয়া হয় চাঁদাবাজি মামলা। এফআইআর-এ নাম না থাকা সত্ত্বেও ঘাতক জামায়াত-শিবিরের দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। চাঁদাবাজির সাজানো মামলাটি দায়ের করা হয় ৯ এপ্রিল। মিথ্যা মামলাটি আইনগতভাবে মোকাবেলার জন্য তিনি তাঁর সফর সংক্ষিপ্ত করে ১৪ এপ্রিলের মধ্যে দেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি নেন। তখন যোগাযোগ উপদেষ্টা মেজর জেনারেল আবদুল মতিন (অব) শেখ হাসিনাকে ফোন করে জানান, তাড়াহুড়ো করে দেশে ফেরার প্রয়োজন নেই। বলা হয়, তিনি যেন তাঁর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষ করে নির্ধারিত সময়ে দেশে ফেরেন। পরে যোগাযোগ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, শেখ হাসিনার মর্যাদা ও সম্মানহানির কোন কিছুই সরকার করবে না। এমনকি প্রেসনোট জারির আগের দিন ১৭ এপ্রিলও যোগাযোগ উপদেষ্টা বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে না দেয়ার কোন সিদ্ধান্ত তার জানা নেই। আবার প্রেসনোট জারির পর সাংবাদিকরা তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, প্রেসনোটের এ প্রসঙ্গে তার কোন বক্তব্য নেই। সবচেয়ে বিস্ময়কর বক্তব্য দিয়েছিলেন আইন ও তথ্য উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রেসনোট ইস্যু করার পর শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশের মিডিয়ায় সাক্ষাতকার দেন। সেদিন রাতে তাঁর বক্তব্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে দেশের কোন টিভি চ্যানেল বা পত্রিকায় শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়নি। সরকার তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞার খবরটি বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনাকারী সব এয়ারলাইন্স কর্র্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়। বিমান ও স্থল বন্দরের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে যখাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এদিকে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করার পর যোগাযোগ উপদেষ্টা জেনারেল মতিন সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বে¡ও দেশে ফিরলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ১৯৮১ সালে ৫ মে বিশ^খ্যাত নিউজউইক পত্রিকার এক সাক্ষাতকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘ঝুঁকি’ নিতে না জানলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়’। ২০০৭ সালেও আমরা লক্ষ্য করেছি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে লন্ডনে ফিরে শেখ হাসিনা ২১ এপ্রিল বিবিসির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে বলেন, তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। এমনকি এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি কোন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণের সম্ভবনাও উড়িয়ে দেন। জামায়াতের দায়ের করা হত্যা মামলায় সিএমএম কোর্ট ২২ এপ্রিল দুপুরে শেখ হাসিনাকে পলাতক দেখিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। সরকারের লিখিত নিষেধাজ্ঞার কারণে বিট্রিশ এয়ারওয়েজ তাঁকে বোর্ডিং পাস দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এ সময় ব্রিটিশ এমপি এমিলি থর্নবেরিও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এয়ার লাইন্স কর্তৃপক্ষ জানায়, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও শেখ হাসিনাকে নিয়ে গেলে সরকার তাদের ঢাকায় অবতরণের অনুমতি দেবে না। ফলে শেখ হাসিনা দেশের উদ্দেশে যাত্রা করতে পারেননি। কিন্তু সে সময় হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যত বাধা আসুক না কেন, আমি দেশে ফিরবই। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে না দেয়ার ঘটনায় দেশে বিদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্যসহ রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাই স্পষ্ট করে বলা যায়, আত্মসমর্পণ যে ধ্বংসের নামান্তর, শেখ হাসিনার জীবন সাধনার মধ্যে এই বাণী নিরন্তর উচ্চারিত হতে থাকবে। কেননা, তিনি পথ দেখান এবং আশা দেন, ভরসা দেন। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ইয়াজউদ্দিন ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে জাতির উদ্দেশে তিনি একটি চিঠি লিখে যান; যা পরদিন জাতীয় দৈনিকগুলো ফলাও করে প্রকাশ করে। গ্রেফতারের পূর্বে লেখা শেখ হাসিনার চিঠি আগামী প্রজন্মের লড়াকু মানুষদের সব সময় প্রাণিত করবে। সেদিনও শেখ হাসিনা নির্ভীকচিত্তে জাতির উদ্দেশে অবিস্মরণীয় উক্তি করেছিলেন। ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। যে যেভাবে আছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথা নত করবেন না। সত্যের জয় হবেই। আমি আছি আপনাদের সঙ্গে, আমৃত্যু থাকব। আমার ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান।’ ১৭ মে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। এদিন তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছিলেন কেবল একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে নয়, জাতীয় রাজনীতির হাল ধরতে, সেনা শাসনের কবল থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে। দেশের মাটিতে পা রাখার দিন থেকেই শুরু হয় তাঁর নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামী জীবন, সাড়ে তিন দশকের অধিক সময় ধরে যা বিস্তৃত। শেখ হাসিনা রাষ্ট্র, সমাজ, দেশ, বিশ^ সম্পর্কে চিন্তাধারার উত্তরাধিকার আমাদের জন্য প্রতি মুহূর্তে রেখে চলেছেন। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফিরে না আসলে ক্ষমতার মদমত্ততার ও আত্মম্ভরিতার অবসান হতো না। এ কথা মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নির্মীয়মাণ ইতিহাসে শেখ হাসিনা নিজের জায়গা নিজে করে নিয়েছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছিলেন, শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে যখনই পা রেখেছিলেন তখনই বুঝে নিয়েছিলেন-‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু...।’ তাঁর পথে পথে পাথর ছড়ানো ছিল। শুধু পাথর নয়; এক পর্যায়ে দেখা গেল ‘পথে পথে গ্রেনেড ছড়ানো।’ শেখ হাসিনা জেনে গিয়েছিলেন, চলার পথে অনেক বাঁক থাকে, চোরাস্রোত থাকে, অনির্দিষ্ট আর অলক্ষ্য অনেক উপাদানে জড়িয়ে থাকে ইতিহাসের অনির্ধারিত গতিপথে। অথচ শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৩৬ বছর অতিক্রমের পর প্রশ্ন থেকে যায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন? বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গানের কথা মনে পড়ে-‘শুনে তোমার মুখের বাণী / আসবে ঘিরে বনের প্রাণী / হয়ত তোমার আপন ঘরে পাষাণ হিয়া গলবে না।’ বিশ^সংসার জয় করে আসলেও নিজের দেশের অনেকের পাষাণ হৃদয় গলাতে পারেননি। ওই গানেই বলা আছে ‘তা বলে ভাবনা করা চলবে না।’ এভাবেই শেখ হাসিনার পথচলা। বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনা জরুরী ছিলেন, জরুরী থাকবেন। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×