ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অরুণ কুমার বিশ্বাস

মতামত ॥ নারী-নিগ্রহের মনস্তত্ত্ব কী?

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ১৭ মে ২০১৭

মতামত ॥ নারী-নিগ্রহের মনস্তত্ত্ব কী?

সম্প্রতি আমাদের বীরপুঙ্গবেরা নারীকে যেন পেয়ে বসেছে। যাকে যেখানে পাচ্ছে, তাকেই ধরে লালসার শিকার বানাচ্ছে। জাত-পাত-বয়সভেদ দেখছে না, একটু মওকা পেলেই নারীর উপর চালাচ্ছে অকথ্য পাশবিক নির্যাতন। দু’বছরের শিশু থেকে শুরু করে মায়ের বয়সী নারী- কারও যেন নিস্তার নেই ওদের ভয়াল থাবা থেকে। বিশ^ মা দিবসে মায়ের পায়ে মাথা ঠেকাতে গিয়ে আমার নিজেরই কেমন যেন লজ্জা লজ্জা ঠেকছে। কেননা আমিও যে পুরুষ! এ-কথা হলফ করে বলতে পারি, ভুক্তভোগী অনেক নারী এখন আর জাতি হিসেবে পুরুষকে মোটেও ভরসা করতে পারছে না। নারী-পুরুষ যেন একে অপরের পরিপূরক নয়, বরং পুরুষের চোখে নারী এখন শুধু বিকৃত কামনার চিহ্ন দেখতে পায়। বুঝতে পারি না, আমাদের এই লজ্জার শেষ কোথায়! একটু ইতিহাসমুখী হই। যেখানে দেখবেন যত রকম যুদ্ধবিগ্রহ, সব কিন্তু এই নারীকেন্দ্রিক। ক্লিওপেট্রাকে পাবার জন্য পুরো ট্রয়নগরী ধ্বংস হয়ে গেল। মুঘলদের কথা ধরুন- এমন কোন মুঘল সম্রাট ছিল না যে কিনা তার হারেমে শত শত নারীকে বন্দী করে রাখেনি। নারী যেন স্রেফ ভোগের সামগ্রী। এমনও দেখা গেছে বাপ-ছেলে মিলে একই নারীর শয্যাসঙ্গী হয়েছে। সম্রাট আকবর আর তার ছেলে জাহাঙ্গীরের লালসার বলি হয়েছিল হতভাগা আনারকলি। সৌন্দর্যই যেন তার কাল হলো। ভালবাসার মোড়কে মূলত তারা আনারকলিকে সম্ভোগ করতেই ব্যস্ত ছিলেন। ইতিহাসকে মিছে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সময় বদলেছে। আমরা নিজেদের সভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়ে আত্মশ্লাঘা বোধ করছি। সভ্যতা মানে কি নারী-নিগ্রহ! যাকে-তাকে ধরে বিছানায় টেনে নেয়া! আমার প্রশ্ন, সহসাই পুরুষের কামনার হোমানল এভাবে জ¦লে উঠলো কেন! দেশে কি কোন আইন-আদালত নেই! দু’চারজন দুর্বৃত্ত সবখানে সব কালেই ছিল। তাদের দমন করার জন্য আইন আছে। অন্তত সংবিধান তাই বলে। কিন্তু যখন নারীর উপর পাশবিক নির্যাতন রীতিমতো প্রাদুর্ভাব আকারে দেখা দেয়, রাষ্ট্র তখন কী করবে! পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন লোমহর্ষক সব ঘটনা দেখি। শান্তিকামী কেউ কেউ নাকি পত্রিকা পড়াই ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকটা যেন উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকা। কিন্তু অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে! নারী-নিগ্রহের মূলে যাওয়া যাক। কথায় বলে, শক্তের ভক্ত নরমের যম। কথায় কথায় আমরা নারীকে পেলব, সুন্দরী, সুকণ্ঠী বলে ইনিয়েবিনিয়ে তার অঙ্গসৌষ্ঠবের বর্ণনা করে থাকি। এও বলি, নারী কখনও কোন বিষয়ে উচ্চবাচ্য করে না, যা বলি তা মুখবুজে মেনে নেয়। নারী মিহি রিনরিনে সুরে কথা কয়। অর্থাৎ এক অন্যরকম ব্র্যান্ডিং করে চলেছি নারীর। নারী যেন মানুষ নয়, নারী শুধুই নারীই। ফলে এক শ্রেণীর দানব নারীদের এহেন পেলবতার ফায়দা তুলছে। তারা ধরেই নিয়েছে, যাই করি না কেন নারী মুখ ফুটে কিছু বলবে না। কারণ তার লোকলজ্জা আছে, যা কিনা পুরুষের নেই। পুরুষজাতি লোকলজ্জার উর্ধে! একটু তলিয়ে ভাবলে অনুভব করা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীসংক্রান্ত বিষয়ে এহেন ভুল ব্যাখ্যার কারণে নির্যাতনকারীরা আরও ধর্ষকামী হয়ে ওঠে। মনে করে, নারী যেহেতু স্বভাবতই মূক, তাই একটু আধটু ক্ষিপ্ত হলেও বিচার চাইবার মতো সরব তারা কখনওই হবে না। তাই তাদের এই বিকৃত লালসা তারা নির্ভয়ে চরিতার্থ করতেই পারে। সমাজ বা আইন কোনটাই তাকে বিচারের মুখোমুখি করবে না। অন্তত নিকট-অতীত তাই বলে। ফেসবুকের অনেক রকম নেতিবাচক দিক আছে মানছি। কিন্তু নারী-নিগ্রহের বিরুদ্ধে বর্তমানে আমরা যে সরব হয়েছি, তার পেছনে ফেসবুক ও গণমাধ্যমের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যার ফল আমরা হাতেনাতে পেয়েছি। বনানীর ঘটনায় অন্যতম দুই অভিযুক্ত গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আমরা এই হুজুগ কতদিন ধরে রাখতে পারব! এর পরে আরও কোন স্পর্শকাতর ঘটনা ঘটলেই বনানী ভুলে আমরা হয়ত অন্য কোথাও দৃষ্টি নিবদ্ধ করব। আমাদের আবেগ মথিত হবে, আমরা ভুলে যাব দুজন বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রীর সম্ভ্রম হারানোর কথা। বলতে চাই, সচেতন নাগরিক হিসেবে নারী-নিগ্রহের এক রকম স্থায়ী সমাধান কাম্য। আমরা নিত্যদিন পত্রিকা পড়ে হতাশা ও লজ্জাবোধে ভুগতে চাই না। কিন্তু চাইলেই হবে না, যুতসই উপায় খুঁজতে হবে। নাগরিক নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে। রাষ্ট্র বলছে তারা হাত গুটিয়ে বসে নেই। সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায়, ধর্ষকের সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে, রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের গু-ামির কাছে অনেকটাই পরাভূত। আসামি যথাসময়ে ধরা না পড়া, বা পড়লেও অপরাধ প্রমাণের মতো বস্তুসাক্ষ্য না থাকা, না থাকলেও বিচারের চরম দীর্ঘসূত্রতা, এসব কারণে বস্তুত আমরা মোটেও আশাবাদী হতে পারছি না। এবার নারী-নিগ্রহের পেছনে কিঞ্চিত মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় আসা যাক। দৃষ্টিসীমায় নারী আসা মাত্র বিকৃত লালসা বোধ করা এক রকম অসুস্থতা। এদের পারভার্ট বলা যায়। এসব পুরুষ নিঃসন্দেহে মানসিক রোগী। এদের মনোবৈকল্য রয়েছে। কিন্তু তাদের এই অসুস্থতার দায় নারী কেন নেবে! রোগীর জন্য তার বাবা-মা আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। প্রয়োজনে এসব অপ্রকৃতিস্থ দামড়াদের তারা এ্যাসাইলামে পাঠাক। এখানেই শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। বিশিষ্ট স্বর্ণব্যবসায়ী মনে করেন, জোয়ান বয়সে ছেলে টুকটাক ধর্ষণকর্ষণ তো করবেই। সে তো আর বুড়া হয়ে যায়নি! তিনি নিজেও এসব করেন। তার মানে যেমন বাপ তার তেমন পুত! এতদিনে ছেলের মা বুঝতে পারলেন যে টাকা আর বাপের কারণে তার ছেলে বখে গেছে। বুঝলেন বটে, তবে বড্ড দেরিতে। এবারে হয়ত আর শেষরক্ষা হবে না। এটা আমাদের প্রত্যাশা মাত্র। বাস্তবে কী হবে কে জানে! শুনেছি তার অনেক টাকা। দেশের স্বর্ণ চোরাকারবারের সঙ্গে ইনি জড়িত। এই নিয়ে তার গর্বেরও অন্ত নেই। যে সে কাজ তো নয়- স্বর্ণের কারবার! বেশ বোঝা যায়, হোটেল রেইন-ট্রিকে তিনি যেন কিনে ফেলেছেন। দেশের মানুষ ঘাস খায় না। এসব দুষ্কর্মের অকুস্থল বিলাসবহুল হোটেলগুলোকে আইনের আওতায় আনা উচিত। টাকায় কী-না হয়! টাকা দিয়ে সব কেনা যায়- আমরা অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করি। একটি আপ্তবাক্য আছে- জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড। দেরিতে বিচার পাওয়া অনেকটা না-পাওয়ার শামিল। ধর্ষণের মামলাগুলো বিশেষভাবে স্পর্শকাতর। কারণ এর সঙ্গে মিশে আছে ঘটনার শিকার নারীটির সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা। এখানে বক্তব্য পরিষ্কার- কাউকে সাপে কাটলে আমরা যেমন সাপকে পিটিয়ে মারি, যিনি আহত হয়েছেন তাকে নয়, ঠিক তেমনি ধর্ষিতাকে সামাজিকভাবে হেনস্থা না করে ওই সর্পসদৃশ্য ধর্ষককে সমাজের কাছে মেলে ধরতে হবে। তার ছবি ও ঠিকুজি-কোষ্ঠী সবাইকে জানাতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয় ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের মতো দোষী সাব্যস্ত হলে এসব ধর্ষককে কেমিক্যাল প্রয়োগের মাধ্যমে নপুংসক বা খোজা করতে পারলে। তাতে অন্তত ওই একটি দুর্বৃত্তের হাত থেকে আমাদের নারীরা নিষ্কৃতি পাবেন। কার্যত আমরা আইন মানি, কারণ আইনের পশ্চাতে পীড়নের আশঙ্কা রয়েছে তাই। আইন ভাঙলে তাকে সমাজ ও আইনের চোখে খাটো করা হয়। শাস্তি পেতে হয়। রাষ্ট্রের কাছে আমাদের বিনীত প্রস্তাব, নারী-নিগ্রহ ও ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে আইনের আরও কড়াকড়ি আরোপ এবং বিচারে কঠোর সাজার বিধান রাখা হোক। তাহলেই ওদের মনোবৈকল্য বা লালসারোগ নিরসন হতে পারে। অল্পকিছু পশ^াধম পুরুষের কারণে গোটা পুরুষজাতি মাথা নিচু করে থাকবে, তা তো হতে পারে না। ওদের কৃতকর্মের দায় ওদেরকেই নিতে দিন। নইলে নারী-পুরুষের পারস্পরিক বোঝাপড়ার জায়গাটা ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে থাকবে, সামগ্রিকভাবে যার নেতিবাচ প্রভাব পড়বে গোটা সমাজ তথা রাষ্ট্রের ওপর। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×