ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদারসহ সাত জনকে তলব

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৬ মে ২০১৭

আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদারসহ সাত জনকে তলব

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ আপন জুয়েলার্সের মালিকের ‘অবৈধ সম্পদ’ ও রেইন ট্রি হোটেলের মদসহ নানা অসঙ্গতির খোঁজে মাঠে নেমেছে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় অলঙ্কার ব্র্যান্ডের আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদারসহ চারজন ও রেইন ট্রির মালিক সাংসদ বিএইচ হারুনের তিন ছেলেসহ সাতজনকে তলব করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। একই সময় হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) মদ রাখার দায়ে সমন দেয়া হয়েছে। এদিকে গুলশান ২ নম্বর সার্কেলের সুবাস্তু টাওয়ারে সিলগালা করে দেয়া আপন জুয়েলার্সের বিক্রয় কেন্দ্রে ফের অভিযান চালিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সোনা ও ডায়মন্ড আটকের ঘটনায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ, তার বাবা, ছেলে সাফাত ও তার এক ভাইসহ পরিবারের চারজনকে এবং অবৈধ মদ রাখার দায়ে রেইন ট্রির চেয়ারম্যান নাহিয়ান হারুন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদনান হারুন ও পরিচালক মাহির হারুনকে তলব করা হয়েছে। সোমবার সকালে সংস্থাটি থেকে পাঠানো পৃথক নোটিশে তাদের তলব করা হয়। নোটিশে তাদের আগামী ১৭ মে বেলা ১১টায় শুল্ক গোয়েন্দার কাকরাইলস্থ সদর দফতরে কাগজপত্রসহ হাজির হতে বলা হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, আপন জুয়েলার্স ও রেইন ট্রির কর্তৃপক্ষের সাতজনকে আগামীকাল বুধবার বেলা ১১টার মধ্যে তাদের কাকরাইলে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের সদর দফতরে কাগজপত্রসহ হাজির হতে বলা হয়েছে। ঢাকার বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদের বাবা দিলদার আহমেদ আপন জুয়েলার্সের অন্যতম মালিক। এই পরিবারের বিরুদ্ধে সোনা চোরাচালানের অভিযোগ থাকায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশে একটি অনুসন্ধান কমিটি করে তদন্ত চালাচ্ছে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। এর অংশ হিসেবে রবিবার রাজধানীতে আপন জুয়েলার্সের পাঁচ বিক্রয় কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে ২৮৬ কেজি স্বর্ণালঙ্কার এবং ৬১ গ্রাম হীরা ‘আটক’ করেছেন শুল্ক গোয়েন্দারা। ডিজি মইনুল খান জানান, স্বর্ণ ও রতœ সংগ্রহের তথ্যে অস্বচ্ছতা এবং মালিকের ‘অবৈধ সম্পদের’ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবেই শুল্ক আইনের বিধান অনুসারে ওই অলঙ্কার তারা আটক করেছেন। তিনি জানান, রবিবার অভিযানের পর আপন জুয়েলার্সেও পাঁচটি বিক্রয় কেন্দ্রের এসব পণ্যের কাগজপত্র যাচাই করে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রতিষ্ঠান মালিকের বিরুদ্ধে চোরাচালান ও মানিলন্ডারিং আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রবিবার একই সময়ে শুল্ক গোয়েন্দারা বনানীর রেইন ট্রি হোটেলেও অভিযান চালান, যেখানে গত ২৮ মার্চ সাফাত ও তার বন্ধুরা দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণ করে বলে মামলার অভিযোগ। ওই অভিযানে হোটেলের বিভিন্ন কক্ষ তল্লাশি করে ১০ বোতল বিদেশী মদ ও নথিপত্র জব্দ করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। শুল্ক ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হোটেল কর্তৃপক্ষ বারের লাইসেন্স দেখাতে না পারলেও সেখানে মদ রাখা হয়েছিল। গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভ্যাট নিবন্ধন নিলেও কোন অর্থ পরিশোধ না করে ওই হোটেল কর্তৃপক্ষ আট লাখ ১৫ হাজার টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। রবিবার অভিযানের পর শুল্ক ও গোয়ন্দা অধিদফতরের যুগ্ম পরিচালক শাফিউর রহমান জানান, ভ্যাট ফাঁকি, শুল্ক ফাঁকি এবং মানিলন্ডারিংÑ এই তিন আইনে হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করবেন তারা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বি এইচ হারুনের ছেলে মাহির হারুন রাজধানীর বনানীর এই চার তারকা হোটেলটির মালিক। মাহিরের বন্ধু পরিচয় দিয়েই আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত ধর্ষণের ঘটনার দিন ওই হোটেলে উঠেছিলেন বলে হোটেল কর্মীরা পুলিশকে জানিয়েছেন। অভিযানের পর শুল্ক ও গোয়েন্দা সদর দফতর থেকে সোমবার রেইন ট্রি হোটেলে অবৈধ মদ রাখার দায়ে রেইন ট্রির চেয়ারম্যান নাহিয়ান হারুন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদনান হারুন ও পরিচালক মাহির হারুনকে শুল্ক ও গোয়েন্দা সদর দফতরে তলব করা হয়েছে। সোমবার সকালে সংস্থাটি থেকে পাঠানো পৃথক নোটিশে তাদের তলব করা হয়। নোটিশে তাদের আগামী ১৭ মে বেলা ১১টায় শুল্ক গোয়েন্দার কাকরাইলস্থ সদর দফতরে কাগজপত্রসহ হাজির হতে বলা হয়েছে। গুলশানে আপন জুয়েলার্সে অভিযান সোমবার বিকেল সোয়া ৩টার দিকে রাজধানীর গুলশানের সুবাস্তু টাওয়ারে সিলগালা করা আপন জুয়েলার্সে শোরুমে ফের অভিযান চালিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মঈনুল খান জানিয়েছেন, সোমবার সোয়া ৩টা থেকে টানা পাঁচ ঘণ্টা অভিযান চলে। এতে কমপক্ষে ৫০ কেজি স্বর্ণ ও হীরা আটক করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত এসব স্বর্ণালঙ্কার অবৈধ। তারা কোন বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। এসব অলঙ্কার সিলগালা করে আপন জুয়েলার্সের হেফাজতে দিয়ে দেয়া হয়েছে। ডিজি মাইনুল খান জানান, রাত ১০টা পর্যন্ত অভিযান চলবে। ইতোমধ্যে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর থেকে দিলদার ও সাফাতের ব্যাংক হিসাব চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। অপরদিকে বনানীর রেইন ট্রি আবাসিক হোটেলে ধর্ষণ ঘটনার মামলার বাদীসহ দুই ভিকটিম এবং তাদের পরিবারকে পুলিশি নিরাপত্তা দিতে আহ্বান জানিয়েছেন কাজী রিয়াজুল হক। তিনি বলেন, নিরাপত্তা দিতে পুলিশ যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে তার দায়ভার পুলিশকেই নিতে হবে। সোমবার সকালে মানবাধিকার কমিশন অফিসে সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (সিএসও) নামে একটি সংস্থার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকারবিষয়ক আয়োজিত যৌথ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে গত ৮ মে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনাটি তদন্ত করতে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। তদন্তের অংশ হিসেবে কমিশন এরই মধ্যে ওই দুই তরুণীর সঙ্গে সেদিনের ঘটনা নিয়ে কথাও বলেছে। পরে মানবাধিকার কমিশনের দুই সদস্য ঘটনাটির তদন্তে ঘটনাস্থল রেইন ট্রি হোটেলও পর্যবেক্ষণ করে। উল্লেখ্য, গত ২৮ মার্চ বন্ধুর সঙ্গে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে বনানীর দ্য রেইন ট্রি হোটেলে ধর্ষণের শিকার হন দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী। ওই ঘটনায় গত ৬ মে রাজধানীর বনানী থানায় সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ ও সাদমান সাকিফসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তারা। সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আপন জুয়েলার্সের অন্যতম মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ রাজধানীর বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি। তাকে ও তার বন্ধু রেগনাম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে সাদমান সাকিফকে সিলেট থেকে গত বৃহস্পতিবার গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। এ মামলার অন্য তিন আসামি ইমেকার্স ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মের স্বত্বাধিকারী নাঈম আশরাফ, সাফাত আহমেদের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ এখনও পলাতক। র্স্পশকাতর মামলা তদন্ত শনিবার ও রবিবার রেইন ট্রির কর্মকর্তারা উইমেন সাপোর্ট সেন্টারে পুলিশের কাছে সাক্ষ্য দেন। তদন্তে কর্মকর্তা জানান, মামলার পলাতক আসামি নাঈম আশরাফের সম্পর্কে গ্রেফতারকৃত সাফাত ও তার সহযোগী সাদমান সাকিফকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আসামিদের মুঠোফোন জব্দ করা হয়েছে। বাদী ও আসামিদের মধ্যে কথোপকথনের রেকর্ড যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রেইন ট্রির সিসিটিভি ক্যামেরার ‘সার্ভার’ পুলিশ জব্দ করে। ওই সার্ভার থেকে পুরনো ফুটেজ উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে। এর আগে বৃহস্পতিবার ওই দুই ছাত্রীর আদালতে জবানবন্দীর পর একজনের পোশাক ডিএনএ ল্যাবে পাঠানো হয়। এখনও পুলিশ প্রতিবেদন পায়নি। এছাড়া গত ৭ মে ধর্ষণের শিকার দুই শিক্ষার্থীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। গঠিত পাঁচ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। ভিকটিমের মাক্রোবায়োলজি, রেডিওলজিক্যাল ও ডিএনএ প্রোফাইলিং পরীক্ষা করা হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়া হবে বলে মেডিক্যাল বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান। মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ড. সোহেল মাহমুদ। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেনÑ ডাঃ মমতাজ আরা, ডাঃ নিলুফার ইয়াসমিন, ডাঃ কবিতা সাহা ও ডাঃ কবির সোহেল। চলচ্চিত্রের শিশুশিল্পী দীঘির প্রতিবাদ সাম্প্রতিক বনানী দুই কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। এবার প্লাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছে চলচ্চিত্রের শিশুশিল্পী দীঘি। তার সঙ্গে আর আছে আরিবা ও সারাবা। এদিকে শুধু দীঘিই নয়, এতে যুক্ত হয়েছেন অভিনেত্রী নওশাবা ও প্রসূন আজাদ। তারাও সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে সোচ্চার। মূলত হ্যাশট্যাগ দিয়ে ‘নো মিনস নো’ ও ‘স্টপ রেপ’ বাক্য লিখে এ প্রতিবাদ চলছে। এতে অংশ নিয়েছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
×