ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সাক্ষাতকার;###;অনুবাদ : সহুল আহমদ

‘পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বেই যিনি দেখেছিলেন পাকিস্তানের ভবিষ্যত!’

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১৬ মে ২০১৭

‘পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বেই যিনি দেখেছিলেন পাকিস্তানের ভবিষ্যত!’

(গতকালের পর) ১) তারা লুণ্ঠন ও নৃশংসতার শিকার হবে এবং পাকিস্তানে চলে যাবে; কিন্তু সেখানেও কতজন মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে? ২) তারা হত্যা ও অন্যান্য অত্যাচারের কবলে পড়বে। এই প্রজন্মের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এবং দেশভাগের দুঃসহ স্মৃতি বিস্মৃত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানদের এই অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। ৩) একটা বিরাট সংখ্যক মুসলমান দারিদ্র্য, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও আঞ্চলিকতার উৎপাতে ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য হবে। মুসলিম লীগের বিশিষ্ট মুসলমানরা পাকিস্তান চলে যাবে এবং ধনী মুসলমানরা সকল শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসার দখল করে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে কুক্ষিগত করে ফেলবে। কিন্তু ৩০ মিলিয়নের অধিক মুসলমান ভারতে পড়ে থাকবে। পাকিস্তান তাদের জন্য কি রেখেছে? পাকিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখদের বিতাড়ন তাদের পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলবে। পাকিস্তান নিজেই অনেক সমস্যার সম্মুখীন হবে। সবচেয়ে বড় বিপদটা আসবে আন্তর্জাতিক শক্তির কাছ থেকে, যারা এই নতুন দেশটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন হবে। বহির্শক্তির চাপসংক্রান্ত এই সমস্যা ভারতের থাকবে না; তার ভয় পাকিস্তানের শত্রুতা। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা মি. জিন্নাহর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে, সেটা হচ্ছে বাংলা। তিনি জানেন না যে, বাঙালীরা বাইরের নেতৃত্ব পছন্দ করে না এবং আজ না হয় কাল তারা সেটা প্রত্যাখ্যান করবেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, মি. ফজলুল হক জিন্নাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন এবং মুসলিম লীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হলো। মি. সোহরাওয়ার্দীও জিন্নাহ সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন না। শুধু মুসলিম লীগ কেন, কংগ্রেসের ইতিহাসের দিকে তাকান। সুভাষ চন্দ্র বোসের বিদ্রোহের কথা সবাই জানে। বোস সভাপতি হওয়া গান্ধীজী খুশি হতে পারেননি এবং রাজকোটে আমরণ অনশন করার মাধ্যমে গান্ধীজী জনস্রোতকে বোসের বিরুদ্ধে নিয়ে যান। সুভাষ বোস গান্ধীজীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন এবং নিজেকে কংগ্রেস থেকে সরিয়ে নিলেন। বাংলার পরিবেশটাই এমন যে, এরা বাইরের নেতৃত্ব অপছন্দ করে এবং যখনই নিজেদের অধিকার ও স্বার্থ ক্ষুণœ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তখনই তারা বিদ্রোহ করে। জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী যতদিন জীবিত আছেন, ততদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান আস্থা হারাবে না। কিন্তু তাদের পরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাও তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও শত্রুতা তৈরি করবে। আমার মনে হয়, পূর্ব পাকিস্তান বেশি দিন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে পারবে না। নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করেÑ এটা ছাড়া তাদের মধ্যে আর কোন সাদৃশ্য নেই। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও- আমরা মুসলমান এই ভিত্তিতে স্থায়ী কোন রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের সামনে আরব বিশ্ব আছে; তাদের ধর্ম এক, সভ্যতা এক, সংস্কৃতি এক এবং একই ভাষায় তারা কথা বলে। বস্তুত এরা স্থানিক ঐক্যের কথাও স্বীকার করে। তবু তাদের সরকার ব্যবস্থা আলাদা এবং প্রায়ই নিজেদের মধ্যে উক্তি-প্রত্যুক্তি ও বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবন প্রবাহ সবই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। যে মুহূর্তে পাকিস্তান সৃষ্টির এই উষ্ণতা শীতল হবে, তখন থেকেই অসঙ্গতিগুলো স্পষ্ট হতে থাকবে এবং বিরোধ বাড়তে থাকবে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এতে আরও ইন্ধন যোগাবে এবং পরিশেষে দুই অংশ আলাদা হয়ে যাবে। পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ার পর, সেটা যখনই ঘটুক, পশ্চিম পাকিস্তান বিভিন্ন আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠবে। পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত এবং বেলুচিস্তান নিজেদের আলাদা আলাদা জাতি হিসেবে ঘোষণা করবে এবং এটা বহির্শক্তির হস্তক্ষেপ বাধ্য করবে। আন্তর্জাতিক শক্তি পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৈচিত্র্যময় উপাদানগুলো ব্যবহার করে আরব এবং বলকানের মতো পাকিস্তানকেও খণ্ড খণ্ড করে ফেলবে। হয়তবা এ অবস্থাতেই আমরা নিজেদের প্রশ্ন করব কী পেলাম, আর কী হারালাম? মূল বিষয়টা হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং অগ্রগতি। সেটা মোটেও ধর্ম নয়। মুসলমান ব্যবসায়ী নেতারা নিজেদের সক্ষমতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে নিজেরাই সন্দিহান। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্য গ্রহণে তারা এতটা অভ্যস্ত যে, মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে ভয় পাচ্ছে। নিজেদের সেই ভয় গোপন রাখার জন্য দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচার করে যাচ্ছে এবং উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতিযোগিতা ছাড়াই পুরো অর্থনীতিকে একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে একটা মুসলিম রাষ্ট্র তারা চায়। দেখা যাক, কতদিন তারা এই প্রতারণা চালিয়ে যাতে পারে। আমি মনে করি শুরু থেকেই পাকিস্তান কিছু মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হবে : ১) অযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক স্বৈরশাসনের পথ প্রশস্ত করবে, যা বিভিন্ন আরব দেশে ঘটেছে। ২) প্রচুর বৈদেশিক ঋণের বোঝা বইতে হবে। ৩) প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনুপস্থিত থাকবে এবং সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা থাকবে। ৪) অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও আঞ্চলিক অন্তর্কোন্দল চলতে থাকবে। ৫) নব্য ধনী ও শিল্পপতিরা পাকিস্তানের জাতীয় সম্পদ লুট করবে। ৬) নব্য ধনীদের শোষণে শ্রেণী সংগ্রাম শুরু হতে পারে। ৭) যুবকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেবে এবং ধর্ম থেকে তাদের বিচ্যুতি ঘটবে, যা ‘পাকিস্তান তত্ত্ব’কেই ধ্বংস করে দেবে। ৮) পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলবে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়ে যাবে এবং মুসলিম দেশগুলোও কোন কার্যকরী সাহায্য দেয়ার মতো অবস্থায় থাকবে না। অন্যান্য জায়গা থেকেও শর্ত ছাড়া কোন সাহায্য আসবে না এবং এটা পাকিস্তানকে আদর্শিক ও স্থানিক মূল্য দিতেও বাধ্য করবে। প্রশ্ন: কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলমানরা কিভাবে তাদের সম্প্রদায়ের পরিচয় (পড়সসঁহরঃু রফবহঃরঃু) বজায় রাখতে পারে এবং কিভাবে একটা মুসলমান রাষ্ট্রের নাগরিকের গুণাবলী অর্জন করতে পারে? উত্তর: ফাঁকা বুলি দিয়ে যেমন মূল বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না, তেমনি বাঁকা প্রশ্নও উত্তরকে দুর্বল করে দেয় না। এটা শুধু আলোচনাকে বিকৃত পর্যায়ে নিতে পারে। সম্প্রদায়ের পরিচয় বলতে কি বোঝায়? যদি এই সম্প্রদায় ব্রিটিশ দাসত্বেও তাদের পরিচয় বজায় রাখতে পারে, তাহলে মুক্ত ভারতে কিভাবে এটা হুমকির মুখে পড়তে পারে, যেখানে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে মুসলমানরা সমভাবেই অংশগ্রহণ করতে পারবে। মুসলমান রাষ্ট্রের কী কী গুণাবলী আপনি ধারণ করতে চান? মূল বিষয়টা হচ্ছে, বিশ্বাস এবং ধর্মচর্চায় স্বাধীনতা এবং এই স্বাধীনতায় কে বাধা দিতে আসবে। স্বাধীনতা কি ৯০ মিলিয়ন মুসলমানকে এমন অসহায় পরিস্থিতিতে ফেলবে, যেখানে তারা ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবে না? যেখানে বিশ্ব শক্তি হিসেবে ব্রিটিশই এই স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারেনি, সেখানে হিন্দুদের হাতে কি এমন ক্ষমতা বা জাদু থাকতে পারে যে, তারা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে পারে? এই প্রশ্নগুলো তারাই তুলছে, যারা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে নিজেদের ঐতিহ্যকে ভুলে গিয়েছে এবং এখন রাজনৈতিক ফন্দিফিকিরের মাধ্যমে এসব কাদা ছুড়ছে। মুসলিম ইতিহাস ভারতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনার কি মনে হয়, মুসলমান রাজারা ইসলামের যথেষ্ট সেবা করেছিলেন? ইসলামের সঙ্গে তাদের নামমাত্র সম্পর্ক ছিল। তারা ইসলাম প্রচারক ছিলেন না। ভারতের মুসলমানরা সুফীদের কাছে ঋণী এবং অনেক সুফীকেই ওই রাজাদের নৃশংসতার শিকার হতে হয়েছিল। অধিকাংশ রাজাই ওলামাদের একটা বড় গোষ্ঠী তৈরি করতেন, যারা ইসলামিক মূল্যবোধ প্রচারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াত। ইসলাম তার প্রাথমিক যুগে অসাধারণ আবেদন তৈরি করেছিল এবং প্রথম শতাব্দীতে হেজাজের আশপাশের মানুষের মন ও হৃদয় কেড়েছিল। কিন্তু যে ইসলাম ভারতে প্রবেশ করেছিল সেটা ভিন্ন ছিল, এর প্রচারকরা অনারব ছিল এবং এর মূল চেতনাটা অনুপস্থিত ছিল। তবু ভারতের সংস্কৃতি, গান, শিল্প, স্থাপত্য ও ভাষাতে এখনো মুসলমান যুগের ছাপ স্পষ্ট। ভারতের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যেমন দিল্লী এবং লক্ষেèৗ কি প্রকাশ করছে? এর অন্তর্নিহিত মুসলিম চেতনাটা স্পষ্ট। যদি মুসলমানরা এখনও আশঙ্কা করে এবং বিশ্বাস করে যে, স্বাধীন ভারতেও দাসত্ব করতে হবে, তাহলে আমি শুধু তাদের বিশ্বাস ও হৃদয়ের জন্য প্রার্থনাই করতে পারি। একজন মানুষ যদি নিজের জীবন নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়, তাহলে তাকে উদ্ধারে সাহায্য করা যেতে পারে। কিন্তু কেউ যদি ভীরু হয় এবং সাহসের অভাবে ভোগে, তাহলে তাকে তো আর নির্ভীক ও সাহসী করে তোলা সম্ভব নয়। মুসলমানরা সম্প্রদায়গতভাবেই কাপুরুষ হয়ে গিয়েছে। তারা আল্লাহকে ভয় না করে মানুষকে ভয় করে। এটাই ব্যাখ্যা করে কেন তারা নিজেদের অস্তিত্বের হুমকি নিয়ে এতটা আচ্ছন্ন! সবই তাদের বানানো কল্পনামাত্র। ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখলের পর মুসলমানদের ওপর যতটা অত্যাচার করা সম্ভব, সবই করা হয়েছিল। কিন্তু মুসলমানরা তো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। বিপরীতে তাদের বৃদ্ধি ছিল গড়ের কিছুটা বেশি। মুসলিম সংস্কৃতির মূল্যবোধে একটা আবেদন আছে। তারপর ভারতের তিন দিকেই মুসলমান প্রতিবেশী আছে। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠরা কেনই বা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে? এটার সঙ্গে কিভাবে তাদের স্বার্থ জড়িত? ৯০ মিলিয়ন মুসলমানদের শেষ করে দেয়া কি খুব সহজ? বস্তুত, মুসলিম সংস্কৃতির আকর্ষণে ভারতে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক এর অনুসারী হয়ে ওঠে, তাহলেও আমি অবাক হব না। স্থায়ী শান্তি ও জীবন দর্শন- পৃথিবীর দুটোই প্রয়োজন। যদি হিন্দুরা মার্কসের অনুসারী হতে পারে এবং পাশ্চাত্য জ্ঞান ও দর্শন অনুশীলন করতে পারে, তাহলে তারা ইসলামকেও অস্বীকার করবে না এবং এর নীতি থেকে উপকার পেয়ে খুশিই হবে। বস্তুত, তারা ইসলামের সঙ্গে অনেক পরিচিত এবং স্বীকার করে যে, ইসলাম মানে কৌলিক গোষ্ঠীগত সঙ্কীর্ণতা নয় কিংবা নিপীড়ক শাসন ব্যবস্থাও নয়। চলবে...
×