ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকদিন

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১৬ মে ২০১৭

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকদিন

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দেখার ইচ্ছা ছিল অনেকদিনের। হঠাৎ মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। সেখানকার ইংরেজী বিভাগে যাওয়ার সৌভাগ্য হলো। আগেই শুনেছিলাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. রশীদ আসকারী কেবল বিদ্বান ব্যক্তিই নন। একই সঙ্গে দক্ষ সংগঠক, কর্মঠ এবং সাহিত্য সমালোচক। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হলাম। বর্তমান উপাচার্যের লক্ষ্য হচ্ছে, সেশন জাম হ্রাস করে ছাত্রছাত্রীদের নির্দিষ্ট সময়ে চাকরির বাজারের জন্য তৈরি করা। সে লক্ষ্যে তিনি বহুবিধ কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি পিতৃতুল্য। সংস্কৃতিমনস্ক উপাচার্য মহোদয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল সংস্কৃতি চর্চাই নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতি গভীর আনুগত্য ও ভালবাসার বহির্প্রকাশ ছাত্রছাত্রীদের অন্তরের অন্তস্তলে গেঁথে দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের ওপর ইংরেজী গ্রন্থসালার তিনটি খ- তিনি সম্পাদনা করেছেন। সাহিত্য সমালোচনা সাধারণের মাঝে পৌঁছে দিতে এবং জাতীয় ইস্যুতে লিখতে রশীদ আসকারী সচেষ্ট রয়েছেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কুষ্টিয়া শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটারের মতো দূরে। অন্যদিকে ঝিনাইদহ থেকেও দূরে। অর্থাৎ এর অবস্থান হয়েছে নো ম্যানস ল্যান্ডের মতো। রাজাকার শাহ আজিজুর রহমান এক রকম গায়ের জোরেই বিশ্ববিদ্যালয়টি ঐরূপ স্থানে স্থাপন করেন অথচ বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করে দেখা যায়, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের মতো তারাও স্থান সঙ্কুলারের অভাবে ভুগছে। তাদের এ অবস্থার থেকে পরিত্রাণের সহজ কোন পথ নেই। যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে টিউশনি করে থাকে তাদের জন্য হয় কুষ্টিয়া শহর কিংবা ঝিনাইদহ শহরে থাকা ছাড়া উপায় নেই। হলে জায়গা না পেয়ে শহরে থাকতে মাসিক খরচ কত লাগে জানতে চাইলে এক ছাত্রী জানাল মাসে ১৫ হাজার টাকার মতো মেসে থাকা-খাওয়া এবং যাতায়াত ভাতাদি হিসাবে খরচ হয়ে থাকে। আমার মনে পড়ে গেল ৩৫ বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে যে পরিশ্রম হতো তার কথা। পাঁচবার বাস বদল করে কিংবা শাটল ট্রেনে করে যেতে হতো। এত বছরেও কিন্তু স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে রেল স্টেশন স্থাপন করে কুষ্টিয়া থেকে ঝিনাইদহ পর্যন্ত শাটল কিংবা স্কাই ট্রেনের ব্যবস্থা করতে পারল না। জানি এটি করতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। যদি ৭ম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় সম্ভব না হয় তবে ৮ম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে রেল স্টেশন স্থাপন করে সেখানে কুষ্টিয়া থেকে ঝিনাইদহ পর্যন্ত শাটল ট্রেন স্থাপন করার কথা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন। এ ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের শিক্ষার মান উন্নয়নে সদা সচেষ্ট রয়েছেন এবং তিনি এ ব্যাপারে ৮ম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনা ছাড়াও ভারতীয় কিংবা চাইনিজ ক্রেডিট লাইনের আওতায় রেল স্টেশন স্থাপন এবং শাটল ট্রেন কিংবা স্কাই ট্রেন স্থাপন করার কথা ভাববেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সবুজের সমারোহ। যতœ করে সবুজকে লালন করা হচ্ছে। পড়াশোনার মানও উন্নত হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের আবাসান সঙ্কট সমস্যা সমাধানকল্পে বেসরকারী উদ্যোক্তারা বাড়ি তৈরি করে, মেসের ব্যবস্থা করতে পারেন। আশা করব বেসরকারী উদ্যোক্তারা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবেন- এটি সামাজিক দায়বদ্ধতা। আবার যে সব ছাত্রছাত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তারাও কিন্তু চাঁদা তুলে একটি ছাত্র এবং একটি ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণ করতে পারেন। ড. রশীদ আসকারীর যে বেগবান গতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি উন্নত করতে চান সেটি সার্থক করতে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। ছাত্রছাত্রীরা এ দেশের সংস্কৃতি-সাহিত্য চর্চায় অগ্রগণ্য। ইতোপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের উপস্থাপিত অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এক অদ্ভুত সুন্দর ঘোর লাগা অনুষ্ঠান। সারাদিন রোজা রেখে ছোট এক মেয়ে যে দ্বিতীয় বর্ষ আন্ডার গ্র্যাজুয়েটে পড়ে নাচ পরিবেশ করল তখন বিদেশ থেকে আগত ড. মানিতসহ সবাই মুগ্ধ হয়ে পড়ল। ‘ফেলে আসা দিনগুলোর কথা’ বার বার মনে পড়ে। এখনও এ সমাজে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী অনেক কষ্ট করে অনুষ্ঠান করে থাকেন। যার মধ্যে থাকে আন্তরিকতার ছোঁয়া। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই অনেক স্বপ্ন। তিনি আন্তর্জাতিকীকরণের প্রয়াস গ্রহণ করেছেন। বিদেশ থেকে ছাত্রছাত্রীদের আনার ব্যবস্থা করেছেন আবার এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায় তিন-চার মাসের জন্য বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার ব্যবস্থা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগতমান উন্নয়নের জন্য ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি এস্যুরেন্স সেল গঠনে প্রফেসর ড. রশীদ আসকারী ও প্রফেসর ড. আব্দুস সোবহান কাজ করে চলেছেন। দেশে বিশেষত উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে যে উন্নয়নের ছোঁয়া একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে গড়ে উঠেছে তার লক্ষ্যে বর্তমান ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল মান্নান ও কোয়ালিটি এস্যুরেন্স সেলের প্রধান ড. সঞ্জয় কুমার অধিকারী কাজ করে চলেছেন। একটি সমন্বিত পদ্ধতির আওতায় এ কার্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বহুমুখী উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা পদ্ধতির বদলে একমুখী উন্নয়ন পদ্ধতি কোয়ালিটি এস্যুরেন্স সেলের মাধ্যমে গ্রহণ করলে ভাল হয়। উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিম-লে ব্যালেন্স স্কোর কার্ডের ব্যবহারের পাশাপাশি আউট কাম বেইজড টিচিং-লার্নিং, কেবল ক্লাসে পাঠদানের ক্ষেত্রে নয়, বরং পরীক্ষা পদ্ধতিতেও চালু করা দরকার। উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে স্ট্র্যাটেজিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য ভিশন ও মিশনকে একই সূত্রে গাঁথতে হবে। যদিও এ লক্ষ্যে উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য দু’জন কাজ করছেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি সুন্দর পরিবেশ ভাল লাগল ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের গবেষণা কর্ম করে চলেছেন। বিভাগ থেকে জার্নাল প্রকাশিত হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণার্থে বিদেশে দেখেছি প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের দেশেও এমনটি দেখব বলে আশা করি। ইংরেজী বিভাগের চেয়ারম্যান থেকে আরম্ভ করে সেলফ এ্যাসেসমেন্ট (ংবষভ ধংংবংংসবহঃ) কমিটির প্রধান ও সদস্য সবাই পড়াশোনার মান উন্নয়নে সচেষ্ট। উপাচার্য মহোদয় মজা করে স্মরণ করিয়ে দিলেন পুরনো কথাÑ ইংরেজী শিখতে হলে হয় অক্সফোর্ডে যাও নচেত অক্সফোর্ডের মতো পরিবেশ তৈরি কর। সে লক্ষ্যে অবশ্য ইংরেজী বিভাগের শিক্ষকের কাজ করছেন। আসলে ইংরেজী বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা ভবিষ্যতে যাতে কমিউনিটি এ্যাঙ্গেজমেন্টে সম্পৃক্ত হয় সেটাই প্রত্যাশা। হেকেপের প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত ইংরেজী ল্যাবটি অত্যন্ত আধুনিক। আবার কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ভাবনার সময় এসেছেÑ যারা ইংরেজী পড়বেন তারা কেবল এমসিকিউর মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন কি না! এটি অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। তবে যারা প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হবেন তাদের মধ্যে প্রথম হাজার-বারো শ’ ছাত্রছাত্রীকে রচনা বর্ণনামূলক জাতীয় প্রশ্ন পরীক্ষায় দ্বিতীয় দফায় অংশ নেয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। এমসিকিউ পরীক্ষা দিতে বুদ্ধির প্রয়োজন তেমন লাগে না। বরং দক্ষতার সঙ্গে বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর দিলে পার্থক্য বোঝা যায়। গবেষণার জন্য ফান্ড কেবল সরকার দেবে তা নয়। বিদেশে দেখেছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণার ফান্ড যোগাড় করে থাকেন অধ্যাপকরা। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করলে তা ছাত্রছাত্রীদের মান উন্নয়নে সহায়তা করে থাকে। এদিকে পিএইচডি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বহিস্থ সুপারভাইজার থাকার ব্যবস্থা করা দরকার। ড. মোঃ মামুনুর রহমান ডরিস লেডিংয়ের দ্য গ্যাস হজ সিংগিং বইটি উপহার দিয়ে বাধিত করেছেন, বইটির অনুবাদ অত্যন্ত সাবলীল। শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ী দেখার সৌভাগ্য হলো। কিন্তু সমস্যা হলো দূর-দূরান্ত থেকে যারা কুঠিবাড়ী দেখতে আসেন বেহাল সড়কের কারণে তাদের অবস্থা কাহিল। সে জন্য রাস্তা নির্মাণের কাজটি অগ্রাধিকারভিত্তিক করা বাঞ্ছনীয়। রবীন্দ্রনাথ যে স্থানে বসে লিখতেন, বজরায় করে বেড়াতে যেতেন তা দেখতে বেশ লাগল। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহে রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হলে বেশ হতো। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে হরেকরকমের মেলা বসেছিল। সেই মেলায় নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হতে হয়। আজকালকার আধুনিক মেলা কিন্তু অনেকটা প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। মহিষের শিংয়ের ফুলদানি একটি চমৎকার নিদর্শন। আমরা গরু-মহিষের শিংয়ের ফুলদানি বিদেশে রফতানি করতে পারি। লালন শাহের মাজারে গেলাম। সেখানে লালন শাহ ও তার প্রিয় শিষ্যদের কবর রয়েছে। সুন্দরভাবে পরিবেশিত হচ্ছিল লালনগীতি। আগেরবারের মতো লালন শাহের মাজারে কিন্তু গাঁজার আসর বসে না। বরং কাছের মাঠে গাঁজার আসর বসে। তবে বিশ্ব ভারতীর সঙ্গে পার্থক্য হচ্ছে, সেখানে জিনিসপত্রের দাম খুব বেশি চায় না অথচ এখানকার দোকানগুলোতে দাম যেন আকাশচুম্বী। আগতরাও চড়া দামে জিনিস কিনছে। মনে মনে ভাবলাম, যার যার মতো করে নিজের আখের গোছাচ্ছে। মন্দ কি! লালনের গান ‘কোন্ নামে ডাকিলে তারে হৃদ আকাশে উদয় হবে/আপনার আপনি যা না হলে/তারা জানা যাবে...।’ চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ [email protected]
×