ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেকায়দায় প্রাথমিক শিক্ষা

প্রকাশিত: ০৩:৩০, ১৬ মে ২০১৭

বেকায়দায় প্রাথমিক শিক্ষা

নতুন শিক্ষানীতিতে ২০১৮ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাস্তবায়ন করার সরকারী ঘোষণা থাকলেও সর্বশেষ অবস্থা হয়েছে লেজেগোবরে। শিক্ষানীতির আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত করা নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একদিকে পরীক্ষামূলকভাবে ৬২৭টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত চালু করে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বছরখানেক আগে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৌখিকভাবে ন্যস্ত করলেও প্রশাসনিক জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কায় তা হস্তান্তর করতে পারছে না। ফলে তা বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়ে। সর্বোপরি অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নেই। রাতারাতি এসব গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। বাজেট ঘাটতির বিষয়টিও সুবিদিত। মোটকথা, প্রাথমিক শিক্ষা সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমলাতান্ত্রিক ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছে সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়। ফলে স্বভাবতই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে সারাদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কবে নাগাদ তা বাস্তবায়িত হবে অথবা আদৌ বাস্তবায়িত হতে পারবে কিনা, তাও বলতে পারছে না কেউ। জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে হলে সময় প্রয়োজন। কেননা, এর জন্য লাগবে অর্থ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, উপযুক্ত শিক্ষক ও প্রশিক্ষণ, তাদের মর্যাদা সর্বোপরি যথাযথ পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। তাহলে এত আগেই কোন প্রস্তুতি ছাড়াই ঘোষণা করার দরকার কী ছিল? লাখ লাখ শিশু ও অভিভাবকদের কি নাকানি-চুবানি না খাওয়ালে চলত না? সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এটা তো বুঝতে হবে যে, প্রাথমিক শিক্ষা ও বইপুস্তক অবৈতনিক হলেও সমাপনী পরীক্ষার নামে শিশুদের কোচিং ও সৃজনশীল প্রশ্নের নামে গাইড বইয়ের জন্য গুচ্ছের খরচ হয়ে থাকে অভিভাবকদের। এর ওপর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ কেন্দ্র পরিবর্তনের দুশ্চিন্তা ও দৌড়ঝাঁপ তো আছেই। এই অসহায়ত্ব থেকে শিশু ও অভিভাবকদের মুক্তি দেবে কে? দেশের শিক্ষানীতি নিয়ে স্বাধীনতার পর থেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিছু কম হচ্ছে না। সবচেয়ে যা দুঃখজনক তা হলো, একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী গঠনমূলক ও স্বনির্ভর একমুখী শিক্ষানীতি আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, প্রণয়ন করা পর্যন্ত সম্ভব হলো না। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষাই চলছে কয়েক স্তরে। একদিকে প্রাথমিক শিক্ষা, অন্যদিকে এবতেদায়ী শিক্ষা ও কওমী মাদ্রাসা। কিন্ডার গার্টেনসহ ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলও চলছে। কোনটির সঙ্গে কোনটির সমন্বয় নেই। পাঠ্যপুস্তকসহ সিলেবাসও আলাদা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থাও তথৈবচ। কোন সমন্বয় নেই। কে কি কোথায় কখন কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন তা জানে না কেউই, না মন্ত্রী না আমলারা। দেশে শিক্ষা নিয়ে সৃজনশীল ও মৌলিক চিন্তকের অভাব আছে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নত ও সমৃদ্ধ একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নসহ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নেও সমস্যা বিরাজমান। প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে মাদ্রাসা ও কিন্ডার গার্টেন শিক্ষার সমন্বয় সাধন ও আধুনিকীকরণ অত্যাবশ্যক এবং জরুরী। শিশুদের জন্য একাধিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলে, শুরুতেই তা হোঁচট খেতে বাধ্য। সে অবস্থায় ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের আলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। এর পাশাপাশি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাস্তর বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো দূর করতে হবে ধাপে ধাপে। অবকাঠামো বিনির্মাণসহ শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তদনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক। যা হবে আধুনিক ও যুগপোযোগী। একাধিক মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের পরিবর্তে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা আনতে হবে একক মন্ত্রণালয়ের অধীনে। বর্তমানে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আশানুরূপ নয়। পাঠ্যপুস্তকের প্রকাশকগোষ্ঠী এবং কোচিং ও গাইড বই ব্যবসায়ীরাও কম অন্তরায় নয়। দীর্ঘদিন থেকে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এর পেছনে কাজ করছে। শিক্ষার মান উন্নয়নসহ যথাযথ শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে এসবই দূর করতে হবে।
×