ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টিনের সেই জঙ্গীবাড়ি ঘিরে মানুষের ভিড়, সুমাইয়া রিমান্ডে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৫ মে ২০১৭

টিনের সেই জঙ্গীবাড়ি ঘিরে মানুষের ভিড়, সুমাইয়া রিমান্ডে

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ॥ রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বেনীপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে অপারেশন সান ডেভিল পরিচালনাকালে আত্মসমর্পণকারী নারী জঙ্গী সুমাইয়াকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। রবিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সুমাইয়াকে রাজশাহীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে ১৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়। শুনানি শেষে আদালতের বিচারক সাইফুল ইসলাম তার ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে, গোদাগাড়ী উপজেলার বেনীপুরের জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের ‘অপারেশন সান ডেভিল’ অভিযানে হতাহত ও বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় শনিবার মামলা দায়ের করা হয়। গোদাগাড়ী থানায় দায়ের করা মামলায় সুমাইয়াসহ ১৫ জন জঙ্গীকে আসামি করা হয়েছে। যাদের মধ্যে নিহত পাঁচ জঙ্গীর নামও উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেন, গোদাগাড়ী থানার এসআই নাঈমুল হক বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন। সন্ত্রাস দমন আইনে দায়ের করা মামলায় ফায়ার সার্ভিসের ফায়ারম্যান আব্দুল মতিনকে হত্যা, পুলিশ সদস্যদের হত্যার চেষ্টা, অস্ত্র, বিস্ফোরকদ্রব্য ও জিহাদী বই রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে গোদাগাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলতাফ হোসেনকে বলে জানান ওসি মুন্সি। এদিকে গোদাগাড়ী উপজেলার বেনীপুরের জঙ্গীবাড়িটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ভিড় জমাচ্ছে উৎসুক মানুষ। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ছুটে যাচ্ছে উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরের নিভৃত পল্লীর ওই বাড়িটি দেখতে। সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়িটির দুই পাশে টিনের বেড়া। আর দুই পাশে কঞ্চির ওপর মাটি দিয়ে তৈরি বেড়া। অভিযানের শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বাড়ির পূর্ব পাশের দেয়ালে পানি ছিটিয়ে কিছুটা অংশ ধসিয়ে দিতে পেরেছিলেন। কাদা ধসে ওই অংশটি কঞ্চির জানালার মতো হয়ে গেছে। সেখান দিয়েই বাড়ির ভেতর দেখার চেষ্টা করছেন উৎসুক মানুষ। এখনও ঘরের ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আসবাবপত্র, দুটি সাইকেল, নিহত জঙ্গী বেলী আক্তারের সেলাই মেশিন, সাজ্জাদ আলীর ব্যবসার কাপড়, ওষুধ, বিভিন্ন ধরনের বই, থালা-বাসন, প্লাস্টিকের টুলসহ বাড়ির সব জিনিসপত্র। বাড়ির আশপাশের বাতাসে এখনও ভেসে আসছে পচা লাশের গন্ধ। বাড়ি থেকে সামান্য দূরেই কেটে নেয়া ধানক্ষেতের ভেতর চার জায়গায় দেখা গেল রক্তের দাগ। রক্তের চারপাশে পড়ে রয়েছে বিয়ারিংয়ের অসংখ্য বল, যেগুলো শক্তিশালী বোমায় ব্যবহার করা হয়। গোদাগাড়ী থানার ওসি হিফজুল আলম মুন্সি জানান, জঙ্গীদের ওই বাড়িটি নিহতদের কোন স্বজনকে দেয়া হয়নি। সেটি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের জিম্মায় আছে। পুলিশ প্রয়োজন মতো বাড়িটিতে গিয়ে তদন্ত করবে। প্রসঙ্গত,‘সান ডেভিল’র অভিযানের প্রস্তুতির মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ‘আত্মঘাতী’ হয়েছে এক পরিবারের চারজনসহ পাঁচজন। তাদের হামলায় নিহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আব্দুল মতিন। পরে দুই শিশুসহ সুমাইয়া আত্মসমর্পণ করে। গোদাগাড়ী উপজেলার নিভৃত পল্লী বেনীপুরের মাঠের মধ্যে জঙ্গী আস্তানায় আত্মঘাতী আশরাফুল ছিল জেএমবির রাজশাহী অঞ্চলের সামরিক কমান্ডার। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার ও আইটি বিশেষজ্ঞ আশরাফুল চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে পুলিশের তাড়া খেয়ে আগের দিন বেনীপুরের আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছিল। আর ওই আস্তানায় আরেক আত্মঘাতী আলামিন ও নাচোলে গ্রেফতার হারুন-অর-রশিদ ছিল জেএমবির ইউনিট কমান্ডার। সেখানে গ্রেফতার হারুনের তথ্যে বেনীপুরের জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মেলে বলে দাবি করেন নাচোল থানা পুলিশ। আশরাফুল ইসলাম রাজশাহী অঞ্চলের জেএমবির কমান্ডার ছিল বলেও নিশ্চিত করেছে জঙ্গী আস্তানায় আত্মসমর্পণকারী নারী জঙ্গী সুমাইয়া। জঙ্গী হারুনের বরাদ দিয়ে পুলিশ জানায়, বেনীপুরের আস্তানায় সুইসাইডাল ভেস্ট পরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত আশরাফুল ইসলাম ছিল জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) রাজশাহী অঞ্চলের সামরিক কমান্ডার। তার নেতৃত্বে রাজশাহী অঞ্চলে জেএমবি সংগঠিত এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ করে। আশরাফুল বোমা তৈরিতেও পারদর্শী ছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার দেবীনগর ইউনিয়নের চর চাকলা গ্রামের আব্দুল হকের ছেলে আশরাফুল কবে জেএমবিতে যোগ দিয়েছে তা হারুন জানাতে পারেনি বলে জানান ওসি ফাছির উদ্দিন। তিনি বলেন, বেনীপুরের জঙ্গী আস্তানায় আত্মঘাতী আলামিন ও নাচোলে গ্রেফতার হারুন ছিল জেএমবির ইউনিট কমান্ডার। আশরাফুলসহ জেএমবির নেতারা আলামিন ও হারুনের বাড়িতে গোপন বৈঠক করত। দমকলকর্মীর মৃত্যু, পুলিশ বলছে ‘অপারেশনাল এ্যাকসিডেন্ট’ রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বেনীপুরের জঙ্গী আস্তানায় আত্মঘাতী হামলায় দমকল বাহিনীর সদস্য আবদুল মতিন নিহত হওয়ায় পুলিশের গাফিলতির অভিযোগ উঠলেও পুলিশ বলছে, এটি ‘অপারেশনাল এ্যাকসিডেন্ট’। পুলিশ জানায়, অভিযান শুরুর প্রস্তুতির মধ্যেই জঙ্গীরা একসঙ্গে বেরিয়ে এসে হামলা চলায়। সাধারণ কোন অভিযানে এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে বেনীপুর আস্তানার জঙ্গীরা যেভাবে আচমকা বেরিয়ে হামলা চালাবে তা ছিল ধারণার বাইরে। রাজশাহী পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অভিযান শুরু হলে সাধারণত জঙ্গীরা কখনও আস্তানা থেকে বের হয়ে আসে না। তারা আস্তানার ভেতরেই সুইসাইডাল ভেস্ট বিস্ফোরণ ঘটায়। শুধু বেনীপুর আস্তানায় থাকা জঙ্গীরা ঘটিয়েছে ব্যতিক্রমী এ ঘটনা। এ কারণে পুলিশ রি-এ্যাকশনের সুযোগ পায়নি। মাত্র ৫/৬ মিনিটের ভেতরে জঙ্গীরা পিঠের ওপর ভেস্ট বিস্ফোরণ ঘটনায়। আর দমকল বাহিনীর দায়িত্বরত কর্মী আবদুল মতিনকে কাস্তে ও লোহার ছুরি দিয়ে কোপাতে থাকে। ঘটনার পর থেকেই পুলিশের গাফিলতিতে দমকল কর্মী আবদুল মতিন নিহত হন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়, জঙ্গীরা এক থেকে দেড়শ গজ দূর থেকে দৌড়ে এসে নিরস্ত্র ফায়ার দমকল কর্মীর ওপর হামলার সময় পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। প্রতিরোধ না করে পুলিশ পেছনে সরে আসে। এ কারণে মৃত্যু হয় মতিনের। দমকল বাহিনীর পাশাপাশি মতিনের পরিবারও একই অভিযোগ করেছেন। নিরাপত্তায় গাফলতির কারণে জঙ্গীদের হামলা ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মতিনের মৃত্যু হয়। যা ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়েছে বলে অভিযোগ করেন মতিনের ভাগ্নে লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, অভিযানের যে ভিডিও দেখেছি তাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এমন বড় অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মেডিক্যাল টিমও রাখা হয়নি। যাতে আহতদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেয়া যায়। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা পেলে মামা (মতিন) হয়তো মরতেন না। মতিনের স্ত্রী তানজিলা বেগম বলেন, আমার স্বামী যখন সেখানে কাজ করছিল তখন তার পাশে পুলিশের লোক ছিল না। বেশ একটু দূরে অপ্রস্তুতভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি টিভির খবর ও ভিডিও ফুটেজে দেখেছেন। জঙ্গীরা যখন বাড়ি থেকে বল্লম ও হাসুয়া হাতে নিয়ে বের হয় তখন পুলিশ গুলি করেনি। যখন তার স্বামীর ওপর হামলা চালিয়ে বল্লম ও হাসুয়া দিয়ে কোপাতে থাকে তখনও পুলিশ গুলি চালায়নি। পুলিশ এগিয়ে গিয়ে প্রথম থেকেই গুলি চালালে হয়তো আমার স্বামীকে মারতে পারতো না বলে মনে করেন তানজিলা। তিনি বলেন, সব জঙ্গী অভিযানে পুলিশের বিশেষ বাহিনী যেমন কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াট থাকে। এক্ষেতে কেন তাদের ডাকা হলো না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের রাজশাহী সদর দফতরের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গীদের হামলায় ফায়ারম্যান আব্দুল মতিন নিহত হওয়ার ঘটনায় সদর দফতর থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটির প্রধান তিনি নিজে। ওই অভিযানের সময় নিরাপত্তায় কোন গাফিলতি ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের এ তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তবে তদন্ত ছাড়া এখন সে ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না। নির্ধারিত ১৫ দিন সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
×