ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অর্পিত সম্পত্তির মামলায় ঘুষ দিতে হয়েছে ২ হাজার ২শ’ কোটি

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৫ মে ২০১৭

অর্পিত সম্পত্তির মামলায় ঘুষ দিতে হয়েছে ২ হাজার ২শ’ কোটি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘প্রতিটি পরিবার অর্পিত সম্পত্তির মামলা করতে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এমন কোন পর্যায় নেই, এমন কোন ধাপ নেই; যেখানে অর্থ ছাড়া কাজ হয়। ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ তা ঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারবে না।’Ñকথাগুলো বলছিলেন ফরিদপুর থেকে আসা ভুক্তভোগী উজ্জ্বল কুমার। আর জমির দলিল দেখিয়ে মামলার ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করতে করতে অশ্রুসিক্ত হলেন পাবনার চাটমোহর থেকে আসা ভুক্তভোগী বৈকুণ্ঠ সাহা। অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে এক সেমিনারের চিত্র এটি। আর এতে তুলে ধরা এক গবেষণার তথ্যে বলা হয়েছে, মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে প্রতিটি পরিবারের ব্যয় হচ্ছে গড়ে ২ লাখ ২৭ হাজার টাকা। এর অর্ধেক প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয় হয়েছে ঘুষ দিতে। অর্পিত সম্পত্তি ফিরে পেতে এ যাবৎ ২ লাখ আবেদনকারীকে ঘুষ দিতে হয়েছে কমপক্ষে ২ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, যা ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ২ শতাংশ। ফলাফল তুলে ধরার পর মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন না করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সঙ্গেই মুনাফিকি করছে সরকার। তারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বলে মুখে ফেনা তুললেও আদতে মুনাফিকির সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের এই মুনাফিকি করতে দেয়া হবে না। ১৯টি সুপারিশ জানিয়ে এতে বলা হয়, অর্পিত সম্পত্তির বিষয়ে নতুন করে আর কোন তালিকা যেন নাজিল না হয়। যেসব মামলায় রায় এসেছে তা বাস্তবায়নে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। রবিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে কনফারেন্স লাউঞ্জে ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার ফলাফল’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরতে আয়োজিত এক সেমিনারে ভুক্তভোগী, অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা এসব কথা বলেন। এলআরডির সহায়তায় এই গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। গবেষণার সারসংক্ষেপ তুলে ধরে ড. আবুল বারকাত বলেন, অর্পিত সম্পত্তি আইনে প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে গড়ে ২ লাখ ২৭ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক, অর্থাৎ ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয় হয়েছে ঘুষ দিতে। সম্পত্তি ফিরে পেতে এ যাবৎ ২ লাখ আবেদনকারীকে ঘুষ দিতে হয়েছে কমপক্ষে ২ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, যা ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ২ শতাংশ। এছাড়াও আদালতের ভেতর বিলম্বের জন্য বিপুল সংখ্যক মামলার তুলনায় আদালত বা বিচারকের সংখ্যা স্বল্পতা এবং অর্পিত সম্পত্তি মামলার প্রতি কম গুরুত্ব প্রদান বিশেষভাবে দায়ী। তিনি বলেন, আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়ায় আগে থেকেই ঘুষ পর্ব শুরু হয়। তহশিলদার, উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় থেকে নথি তোলার সময়ই বেশি পরিমাণ অর্থ ঘুষ দিতে হয়। এরপর আদালতে দীর্ঘ সময় ধরে মামলা ঝুলে থাকে। সে সময় আইনজীবীদের ফি বাবদ ব্যয়, যাতায়াত ইত্যাদি নানা খরচ করতে হয় সম্পত্তি ফেরত চাওয়া ভুক্তভোগীদের। ঢাকা, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে ৪৩টি কেস স্টাডিতে ৪৬ জন মূল তথ্য দাতার সাক্ষাতকার নেয়া হয়। গবেষণায় অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়নে সরকারের কাছে ১৯টি সুপারিশ করা হয়। ফলে উত্থাপনের পর প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বক্তারা। ভুক্তভোগীরাও তুলে ধরেন মাঠ পর্যায়ের চিত্র। সভাপতির বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, তারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা বলে মুখে ফেনা তুলেন। বাস্তবতা হচ্ছে মুনাফিকেরও একটা সীমা থাকে। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ থাকছে না। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বলে যারা দায়িত্ব নিয়েছে তারাই সব ভুলে গেছে। আমরা সেই মুনাফিকি করতে দেব না। এই দেশের পেছনে প্রতিটি মানুষের ও বংশের রক্ত রয়েছে। এলআরডি’র চেয়ারপার্সন ও মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির বলেন, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও যে আইনটি নিয়ে কথা বলছি এটি সাংঘাতিক লজ্জার। গবেষণায় এসেছে, আইন হয়েছে। বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কোর্টের নির্দেশনাও বাস্তবায়ন করছে না প্রশাসন। কোর্ট যেহেতু নির্দেশনা দিয়েছে, তা না মানা মানে কোর্টকে অবমাননা। সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা যদি খুব শক্তিশালী হয় তাহলে তাদের কথা শুনছেন। মিলিটারিদের কথা শুনছেন। আর ইসলাম ধর্মের নামে যেসব সংগঠন, তাদের কাছেও মাথানত করছেন। এই তিন গোষ্ঠীকে আপনারা প্রাধান্য দিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, বনানীতে ধর্ষণের ব্যাপারে সবাই যখন রাস্তায় নেমে এসেছে তখন দু’জনকে গ্রেফতার করেছেন। তাহলে কি আমরা প্রতিটি বিষয়ে রাস্তায় নেমে আসব? আর্পিত সম্পত্তি আইন বাস্তবায়নের বিষয়ে সবাইকে আরও জোর গলায় কথা বলতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠদের সম্পদ মুসলামনরা দখল করবে তা আমরা চাইনি। নারায়ণগঞ্জে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনে বাধা দেয়া হয়েছে, আমরা এই বাংলাদেশ দেখতে চাইনি। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. রানা দাশগুপ্ত বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব রক্ষা করেই করতে হবে। কিন্তু এই ভাবনাটি যেমন বিএনপির মধ্যে দেখি না, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকারের ৯ বছরের শাসনামলেও তা দেখা যায়নি। সংখ্যালঘু রক্ষায় কেন সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয় না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ২১ শতাংশ থেকে দেশে সংখ্যালঘু নেমে এসেছে ৮ শতাংশে। আপনার সময়েই মূর্তি ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে, হিন্দুরা গ্রামে থাকতে পারছে না। কিন্তু সবই তো বঙ্গবন্ধুর কন্যার সময়ে হচ্ছে। তিনি বলেন, জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিশন গঠন করতে হবে, যেখানে সবাই যেতে পারবে। যদি প্রধানমন্ত্রী মেনে নেন, তাহলে এই কমিশনে তার একজন প্রতিনিধিও থাকবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘুদের জন্য জাতীয় কমিশন থাকে, আমাদের দেশেও তা ভেবে দেখা দরকার। অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ১৯৭২ সালের পর এ আইনটি হলে আন্দোলন শুরু হয়। ’৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু এ আইনটি বাতিল করেন। কিন্তু কোন সরকার বুঝতে পারছে না বঙ্গবন্ধু এ আইনটিকে মৃত ঘোষণা করেছেন। কেউ এটি বুঝতে পারছে না। বঙ্গবন্ধুর আইনটি পর্যন্ত আপনারা মানেন না, জাতির সঙ্গে তামাশা করছেন। বছরের পর বছর ধরে অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে এ হয়রানি মেনে নেয়া হবে না। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সহ-সভাপতি এ্যাড. তবারক হোসেইন বলেন, এটি একটি কালো আইন। এটি নিয়ে দ্বিমত থাকার কোন কথা নয়। একটি শ্রেণীকে সম্পত্তি থেকে বাতিল করার জন্য সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ আইনটি করা হয়েছিল। এখন থেকে অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে আর কোন তালিকা যেন নাজিল না হয়। যে মামলাগুলোতে আপীলের রায় এসেছে তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হোক।
×