ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মা দিবসে মাতৃ পদসেবা

আর আমি যে কিছু চাহি নে চরণতলে বসে থাকিব

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৫ মে ২০১৭

আর আমি যে কিছু চাহি নে  চরণতলে বসে থাকিব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘মা’ সৃষ্টির সেই আদিলগ্ন থেকে মধুর এই শব্দটা শুধু মমতার নয়, ক্ষমতারও যেন সর্বোচ্চ আধার। মায়ের অনুগ্রহ ছাড়া কোন প্রাণীরই প্রাণ ধারণ করা সম্ভব নয়। তিনি আমাদের গর্ভধারিণী, জননী। মায়ের প্রতি সম্মান জানাতে ১৯১৪ সাল থেকে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন সংগঠনের নানা আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়েছে এবারের ‘মা দিবস’। দেশে প্রথমবারের মতো পালিত হলো মা দিবস। দারিদ্র্যবিমোচন তথা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে মা’র জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখার দাবি করেছেন বিশিষ্টজনরা। বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় বেসরকারী সংস্থা ডরপ আয়োজিত ‘বাংলাদেশে মা দিবসের একযুগ: টেকসই উন্নয়নে মায়ের স্বপ্ন’ আলোচনা সভায় বক্তারা এ দাবি জানান। এ আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক। অনুষ্ঠানে গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলার ‘স্বপ্ন মা’ লাকি বেগমকে ‘বাংলাদেশের মা দিবস সম্মাননা-২০১৭’ প্রদান করা হয়। বিশ্ব মা দিবস উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় ডরপ’র প্রতিষ্ঠাতা এএইচএম নোমান বলেন, ‘দেশীয় চিন্তায় ২০০৫ সালে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদানের মাধ্যমে মা দিবস উদযাপন শুরু হয়। যা এখন সরকার বাস্তবায়ন করছে এবং সারাদেশে সমাদৃত এ মাতৃত্বকালীন ভাতা কর্মসূচী। এসডিজির একের ভেতরে সতের লক্ষ্য অর্জনে আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’র সংখ্যা ৫ লাখ থেকে না বাড়িয়ে ভাতার পরিমাণ পাঁচশ টাকা থেকে এক হাজার টাকায় উন্নীত করার দাবি করেন তিনি। সেইসঙ্গে, ১০ উপজেলায় তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত, পরীক্ষিত, টেকসই, দেশজ স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচী সম্প্রসারণে ‘১ মা, ১ লক্ষ টাকা’ হারে, ১০০ জন করে, ১০০টি উপজেলায় মোট ১০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ রাখার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান এএইচএম নোমান। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য কাজী রোজি, বেগম ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি, বেগম নাসিমা ফেরদৌসী, সাবেক সংসদ সদস্য কবি রুবী রহমান ও মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের মহাপরিচালক শাহিন আহমেদ চৌধুরী। আলোচনা সভায় তারা সকলেই নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেন। সেই সঙ্গে দেশের তৃণমূলে থাকা মায়েদের নিজ অধিকার আদায়ে সচেতন হওয়ার কথা বলা হয়। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক বলেন, ‘মা শব্দটি ছোট হলেও খুবই শক্তিশালী। একমাত্র মায়েরাই পারে তার সন্তানের জন্য নিজের জীবনের সকল দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেই সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের নারী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে তার সন্তানের মতো ভালবাসেন বলেই দেশের উন্নয়নে তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন। কেন এদেশের মায়েরা সন্ত্রাসবাদে যুক্ত হচ্ছে? কেনইবা সন্তানরা জঙ্গী হয়ে উঠছে? এই মা দিবসে সকল মায়ের কাছে আমার অনুরোধ, কোন মা যেন জঙ্গীবাদে পা না বাড়ায়।’ ‘মায়েদের মধ্যে অলৌকিক ও জাদুকরী ক্ষমতা রয়েছে। মায়েরা শত ব্যস্ততার মধ্যেও সন্তানদের দেখভাল করেন।’ বলে মন্তব্য করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। রবিবার দুপুরে রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে আজাদ প্রোডাক্টস প্রাইভেট লিমিটেডের ‘রতœগর্ভা মা এ্যাওয়ার্ড-২০১৬’ প্রদান অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এ কথা বলেন। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মায়েদের উদ্দেশে বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্মের মায়েরা সন্তানদের শুধু পড়তে বলেন। আমি সেসব মায়েদের বলব, পরীক্ষায় ভাল করলেই ভাল মানুষ হওয়া যায় না। সন্তানকে ভাল মানুষ করার লক্ষ্যে তাদের সৃষ্টিশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।’ অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ‘সন্তানের কাছে মায়ের ভালবাসার কোন তুলনা হয় না। সন্তানকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে মায়েরা নিরলস পরিশ্রম করেন। এসব রতœগর্ভা মায়েদের অভিনন্দন জানাই। তবে মায়েদের আরও সচেতন হতে হবে। এখন ছেলে-মেয়েরা জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ছে। তারা যেন ভুল পথে চলে না যায় সেজন্য মা-বাবাকে আরও সচেতন হতে হবে।’ অনুষ্ঠানে সাধারণ ক্যাটাগরিতে ২৫ জন ও বিশেষ ক্যাটাগরিতে ৮ জন মাকে পুরস্কার দেয়া হয়। সাধারণ বিভাগে সম্মাননাপ্রাপ্ত ২৫ জন হলেনÑ জাকিয়া খানম, মেহেরুন্নেসা, আনোয়ারা বেগম, নাসরিন পারভীন, রাকিবা খানম, ফরিদা হোসেন, সামসুন নাহার, রাবেয়া রহমান, আনোয়ারা রহমান, রিজিয়া আলম, হাজেরা আক্তার, ফরিদা বেগম বেবী, রাধা দেওয়ানজী, আলম আরা বেগম, খুশনাহার বেগম, মাজেদা বেগম, রজিফা বেগম, দিলারা মেসবাহ, রাবেয়া খাতুন, সাধনা রানী চাকমা, গীতিকা পোদ্দার রেখা, বীণা পানি ঘোষ, আনোয়ারা বেগম, বিলকিস আমিন ও জাহানারা বেগম। বিশেষ বিভাগে এ সম্মাননা পেয়েছেন রাবেয়া খাতুন, নিয়তি ভৌমিক, ফজিলাতুন নেছা, ফরিদা আক্তার বেগম, হামিদা আক্তার খাতুন, রেণু রায়, রাশিদা বেগম ও দীপিকা বড়ুয়া। অন্যদিকে, রমনা রেজিমেন্ট এর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় রবিবার তেজগাঁওয়ের শাহীন হলে বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে কলেজ ও স্কুলের ৫০০ জন ক্যাডেট এবং তাদের মায়ের উপস্থিতিতে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও তরুণ রাজনীতিবিদ রাশেক রহমান। এছাড়া বিএনসিসির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফেরদৌস এবং বিএনসিসির সকল রেজিমেন্ট কমান্ডার। অনুষ্ঠানে সকল গুণী মাকে বিএনসিসির পক্ষ থেকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে প্রধান অতিথি তার বক্তব্যে বলেন, ‘মা হলেন সন্তানের প্রথম ও প্রধান শিক্ষা গুরু। তিনিই পারেন তার সন্তানকে মেধা ও মননের বিকাশ ঘটাতে। আমাদের দেশের কোমলমতি সন্তানেরা যেন পরিবারবিমুখ না হয় এবং সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও মাদকাশক্তির করাল গ্রাস হতে রক্ষা পায় সেজন্য মায়েদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ ‘আর কোন বৃদ্ধাশ্রম নয়, এসো মা’কে ভালবাসি’ এই সেøাগান নিয়ে রবিবার ইস্পাহানী বালিকা বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘মাতৃ পাদসেবা’। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ড. মারুফী খানের উদ্যোগে বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। ‘মাতৃ পাদসেবা’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছাত্রীরা তাদের মায়ের পা পানি দিয়ে ধুয়ে দিয়েছে। সেইসঙ্গে মায়েদের তারা তাদের হাতে তৈরি এমন একেকটি উপহার দিয়েছে। ছাত্রীরা তাদের মা’কে মিষ্টিমুখ করিয়েছে। সেইসঙ্গে তারা তাদের মা বলেছে ‘মা, তোমায় খুব ভালবাসি’। অধ্যক্ষ ড. মারুফী খান অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে বলেন, ‘ আমাদের সন্তানরা দিনে দিনে পরিবারের বন্ধন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ওরা সাময়িক সুখ পেতে বৃদ্ধ মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ায় বছরে একটি দিন এ ধরনের অনুষ্ঠান হয় এবং সেই দেশে বৃদ্ধাশ্রম এখনও থাবা পাতেনি বলে শুনেছেন। তিনি আশা করেন, সমগ্র বাংলাদেশের স্কুল কলেজে এ ধরনের অনুষ্ঠান প্রচলিত হবে, যাতে সন্তানরা মা বাবার প্রতি মমতাবদ্ধ হতে পারে।’
×