ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

ফল উৎপাদনে শীর্ষ তালিকায় আম

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১৪ মে ২০১৭

ফল উৎপাদনে শীর্ষ তালিকায় আম

আম আমাদের জাতীয় ফল না হলেও আমের জনপ্রিয়তা ফলের মধ্যে শীর্ষে। তাই আমকে ফলের রাজাও বলা হয়ে থাকে। পৃথিবীতে আম উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় এক মিলিয়ন টন আম উৎপাদিত হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশগুলোতে আমের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমের চাষ বেড়েছে অনেক গুণ। ২০১০ সালের ১৫ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে আমগাছকে বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তার চেয়েও আনন্দের সংবাদটি হলো- বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আমের নতুন রফতানি বাজারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রায় ৩০০ টন আম রফতানি করেছে। তা ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশে যেখানে বাংলাদেশীরা প্রবাস জীবনযাপন করছেন তাদের চাহিদা পূরণের জন্য বাংলাদেশের আম বিভিন্নভাবে বিশ্বে পরিচিতি পয়েছে। আম সম্পর্কে জানা-অজানা পৃথিবীর আমের অন্যতম আদি ভূমি বাংলাদেশ। আদি প্রজাতি ছাড়াও বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বেশকিছু জাতের আম ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সুদর্শন, সুস্বাদু জনপ্রিয়তার কারণেই আম ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপিন্সের জাতীয় ফল। সরকারী হিসাবে মৌসুমে দেশের মানুষ গড়ে তিন কেজি করে আম খায়। বাংলাদেশের মাথাপিছু আম উৎপাদনের পরিমাণ দেড় কেজি। ভারত ও পাকিস্তানে এ হার যথাক্রমে ১১ ও ৬ কেজি। তাঞ্জানিয়ায় মাথাপিছু উৎপাদন ৭ কেজি, সুদানে সাড়ে ৭, ফিলিপিন্সে ৬ ও জায়ারে ৫ কেজি। দেশে শতাধিক প্রজাতির আমের মধ্যে প্রায় ৫০ প্রজাতির আম টিকে আছে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষীরসাপাত (গোপালভোগ), হিমসাগর, লক্ষণভোগ, মোহনভোগ, গোপালভোগ ও বোম্বাই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের হিসেবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৮০০ জাতের আম চাষের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর বাইরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ১১টি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ২১টি আমের জাত উদ্ভাবন করেছেন। আম্রপালি হচ্ছে সবচেয়ে জনপ্রিয় উদ্ভাবিত জাত। শীর্ষ তালিকায় নাম তুলেছে আম ধারাবাহিক উৎপাদন বৃদ্ধির সুবাদে আম উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দশে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম আম উৎপাদনকারী দেশ। আম উৎপাদনকারী শীর্ষ তালিকায় অন্য দেশগুলো হচ্ছে- ভারত, চীন, কেনিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মেক্সিকো, ব্রাজিল, নাইজিরিয়া। আবার দেশে বিভিন্ন ধরনের ফলের মধ্যে সর্বাধিক উৎপাদিত ফল আম ও কাঁঠাল। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন, সম্ভাবনাময় অঞ্চলগুলোয় আবাদ বৃদ্ধি ও প্রক্রিয়াজাত শিল্প সম্প্রসারণের কারণেই বাংলাদেশে ফল উৎপাদনের কাঁঠালকে ছাড়িয়ে উৎপাদনের শীর্ষে এখন আম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, দেশে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৮ লাখ ৪২ হাজার টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৯ লাখ ৯২ হাজার টন এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদন হয়েছে ১১ লাখ ৬১ হাজার ৬৮৫ টন। শুধু কাঁঠাল নয়, সব ধরনের ফলের মধ্যেই আম উৎপাদন এখন সবচেয়ে বেশি। দেশে সবেচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হচ্ছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। সব মিলিয়ে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত এগিয়ে এলে আম উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুফলও আসবে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। অর্থনীতিতে আমের অবদান রাজকীয় ফল আম অর্থকরী ফসল হিসেবেও জাতীয় অর্থনীতিতে শক্ত ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ আম উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী সমিতির হিসাবে, দেশে বর্তমানে আমের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার। জানলে অবাক হতে হয়, শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকে কেন্দ্র করে বছরে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। বছরে কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জেই বিক্রি হচ্ছে প্রায় ছয় কোটি টাকার দুই লাখ আমের চারা। আমবাগান বৃদ্ধির পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত কর্মজীবীর সংখ্যাও বাড়ছে। আমের মৌসুমে এখানে ৮ থেকে ১০ লাখ লোক আম গাছ পরিচর্যা, বাগান পরিষ্কার রাখা, আম সংগ্রহ, বিক্রি ও পরিবহন ইত্যাদি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। পুরো রাজশাহী অঞ্চলে আমকে কেন্দ্র করে আম বাগানি, বাগান লিজদার, বাগান প্রহরী, বাগান পরিচর্যাকারী, বহনকারী, আড়তদার, অস্থায়ী হোটেল ব্যবসায়ী, ঝরা আমের কারবারি এসব নানা কর্মের চাঞ্চল্যতা লক্ষণীয়। সেখানকার নারী থেকে শিশুরাও আম কেন্দ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। আম কেটে শুকিয়ে তৈরি করা আমচুর কিংবা আমসত্বেও নাকি কোটি টাকার বাজার। ফ্রুটি, ফ্রুটিকা ইত্যাদি আদুরে নামে দেশে আমের জুসের তৈরি ফ্রুট ড্রিঙ্কস শিল্প হিসেবে আমের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে প্রাণ-আরএফএল, আকিজ গ্রুপ, একমি, সজীব, ট্রান্সকম ও পারটেক্সের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। জানা গেছে এসব প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর উৎপাদিত আমের ১৫-২০ শতাংশ সংগ্রহ করছে যা ক্রমশ আমের দেশীয় বাজারকে শক্তিশালী করে তুলছে। আশাবাদের ব্যাপার হচ্ছে- দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমের জুস এখন রফতানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে দেশ ও রফতানি মিলে জুসের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার। দেশে তৈরি জুস রফতানি হচ্ছেÑ আরব আমিরাত, আবুধাবি, দুবাই, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, ইতালি, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের বাজারে। স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ আম রফতানির নতুন আশা বাংলাদেশের আম নিয়ে বিদেশিদের নেতিবাচক ধারণা কাটতে শুরু করায় ইউরোপের দেশগুলোতে আমের চাহিদা বাড়ছে। এ বছর রফতানির পরিমাণ বেড়ে এক হাজার টনে উন্নীত হচ্ছে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আম রফতানির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনাটি হলোÑ বাংলাদেশের আম যখন পাকে তখন বিশ্ববাজারে অন্য কোন দেশের আম আসে না। যুক্তরাজ্যের ক্রেতারা বিশ্বের অন্যতম সুস্বাদু ফল হিসেবে বাংলাদেশের আমকে বেশ পছন্দ করছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকমান বজায় রেখে উৎপাদন করতে পারলে বছরে ১ হাজার টন আম রফতানি করা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, এ বছর হিমসাগর, ল্যাংড়া, লহ্মণভোগ, আম্রপালি আম রফতানি হবে। ইতালি, স্পেন, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, গ্রীসসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে আম রফতানি হলেও সবচেয়ে বেশি আম রফতানি হবে যুক্তরাজ্যে। বিদেশে রফতানিযোগ্য আম সংগ্রহে কিভাবে নিরাপদ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় সে বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে চাষীদের। এ ছাড়াও এবার প্রথম বারের মতো ২ টন হিমসাগর আম ইতালি রফতানি করা হয়। পাশাপাশি আমের বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে চাহিদা সৃষ্টি করতে প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিকাশ ঘটানো হচ্ছে।
×