ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দাশিয়ারছড়ার শতাধিক নারী পুরুষ শিশু ভারতের জেলে বন্দী

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৪ মে ২০১৭

দাশিয়ারছড়ার শতাধিক নারী পুরুষ শিশু ভারতের জেলে বন্দী

রাজুমোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম থেকে ॥ কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার চন্দ্রখানা, নাগদাহসহ অধুনালুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ার কামালপুর গ্রামের প্রায় শতাধিক দিনমজুর নারী-পুরুষ ও শিশু ভারতের বিভিন্ন জেলখানায় আটক রয়েছে। ভিটেমাটি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে দালালদের টাকা দেয়ার পরেও দেশে ফিরতে পারছে না তারা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জেলখানায় বন্দী থাকায় অতিকষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাদের। আটকে থাকাদের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, ছিটমহল আন্দোলনের এক নেতা ভারতীয় জেল থেকে কয়েকজনকে ছাড়িয়ে আনার কথা বলে তাদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা নিলেও ১৭ মাসেও তাদের দেশে ফেরত আনতে পারেননি। ফুলবাড়ী উপজেলাটি ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা হওয়ার কারণে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে এবং উত্তম কর্মসংস্থানের কথা বলে কিছু দালাল ওই এলাকার নারী-পুরুষ ও শিশুদের উপজেলার কাশিপুর সীমান্ত দিয়ে কৌশলে কাঁটাতারের বেড়া টপকে অবৈধ পন্থায় ভারতে পাচার করে দেয়। অনেকেই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে পারলেও কাজ শেষে বাংলাদেশে ফেরার সময় ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় দালালচক্র কৌশলে মজুরদের সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ, মোবাইলসহ যাবতীয় মূল্যবান সম্পদ লুটে নেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে সটকে পড়ে দালালরা। পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট থানার পুলিশ সদস্যরা তাদের ধরে অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পর জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়। এখন তারা বালুরঘাট জেলখানায় আটক রয়েছে। অন্যদিকে দালালচক্র ২০১৫ সালের ১৪ অক্টোবর দাশিয়ারছড়ার বাসিন্দা হাজরা নামের ২৪ বছরের এক যুবতীকে ভুরুঙ্গামারী সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করার সময় ভারতের অভ্যন্তরে সাহেবগঞ্জ ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। সে এখন কোচবিহার জেলখানায় আটক রয়েছে। আটক ওই বাংলাদেশী নারী-পুরুষ ও শিশুরা আইনী কোন সহযোগিতা না পাওয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের ভারতের জেলে বন্দী থাকতে হচ্ছে। ভারতের বালুরঘাট জেলখানায় আটকৃতরা হলোÑ উপজেলার কামালপুর দেবীরপাঠ এলাকার কুদ্দুস আলীর ছেলে সাইদুল হক (৩৮), তার স্ত্রী শাহিনুর বেগম (৩৫), জমশেদ আলীর ছেলে খোরশেদ আলম (৩৫), আব্দুল কাদেরের ছেলে মহির উদ্দিন (৩২), মোঃ বেলাল হোসেনের ছেলে লাভলু মিয়া (২৯), লাভলু মিয়ার স্ত্রী জাহানারা বেগম (২৬), শিশুকন্যা লাবনী (৩), মৃত আব্দুল কাদেরের ছেলে হাসেন আলী (৫০), তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম (৪২), ছেলে হেলাল হোসেন (৩৫), শিশুসন্তান রাব্বি (১২), আব্দুর রশিদের ছেলে হাফিজুর রহমান (২২), নাগদাহ গ্রামের মজনু মিয়ার ছেলে নাজমুল হক (১৩) এবং উপজেলার ঘোগারকুটি গ্রামের আব্দুল ব্যাপারীর ছেলে স্বাধীন মিয়া (১০) ও মাইদুল ইসলাম (১৯)। ভারতের জেলখানায় আটক হাসেন আলীর ছেলে মমিনুল ইসলাম, হেলালের মা রুজিনা বেগম, লাভলুর শাশুড়ি রহিমা বেগম, হাফিজুলের মা শিল্পী বেগম, ছাইফুল ইসলামের বাবা কুদ্দুস আলী, খোরশেদের বাবা জমসের আলী জানান, গত দেড় বছর আগে যখন তাদের স্বজনরা ভারতীয় বিএসএফ ও পুলিশের হাতে আটক হয়ে জেলখানায় যাওয়ার খবর বাড়িতে পৌঁছে, তখন আমাদের সাবেক ছিটমহল আন্দোলনের এক নেতা আটক স্বজনের প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছে। কিন্তু দেড় বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে ভারতের জেল থেকে ছাড়াতে পারেনি। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত মোবাইল ফোনে জানান, আমি কোচবিহার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রাজ্য সরকারের কারা দফতরের সঙ্গে কথা বলেছি। আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত এসব আটক ব্যক্তির বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করেছি। তিনি আরও জানান, যদি বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিলুপ্ত ছিটমহলের অধিবাসী হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে আটককৃতদের ব্যাপারে কোর্টে সুপারিশ পাঠিয়ে দেন তাহলে এদের বাংলাদেশে ফেরতে কোন বাধা থাকবে না। এ বিষয়ে ভারতীয় বালুরঘাট জেলা জজকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী নিরঞ্জন চক্রবর্তী জানান, আটককৃতদের বিষয়ে যদি ভারতীয় হাইকমিশন বিলুপ্ত ছিটমহলের অধিবাসী হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে একটি সুপারিশ কোর্টে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে এদের বাংলাদেশে ফিরতে আর কোন বাধা থাকবে না। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা খান জানান, আটক ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনরা জোর করে আমাকে কিছু টাকা দিয়েছে। আমি ওই টাকা দীপ্তিমান সেনগুপ্তের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে বন্দীদের জন্য সঠিকভাবে যোগাযোগ করতে পারিনি। তবে খুব দ্রুত ভারতে গিয়ে হাইকোর্টে তাদের বিষয়ে আপীল করব। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবেন্দ্র নাথ ঊরাঁও জানান, বন্দীদের বিষয়ে সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে তারা অবৈধভাবে ভারতে গেছে। আটক ব্যক্তিদের পরিবারগুলো সহযোগিতা চাইলে বন্দীদের ব্যাপারে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
×