শংকর কুমার দে ॥ সারাদেশে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে প্রায় অর্ধশত গোপন জঙ্গী আস্তানার পতন ঘটিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গীবিরোধী এসব অভিযানে নিহতের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে গেছে। নিহতদের মধ্যে জঙ্গীদের স্ত্রী ছাড়াও তাদের ছোট ছোট সন্তানও রয়েছে। এখন পর্যন্ত নিহত জঙ্গীদের মধ্যে অন্তত ২০ জনের বেশি পুরুষ ও নারী আত্মঘাতী ছিল। তারা নিজেরাই নিজেদের হেফাজতে থাকা শক্তিশালী বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহত্যা করেছে। মাত্র পাঁচ মাস সময়েই অন্তত শতাধিক আত্মঘাতী পুরুষ ও মহিলা জঙ্গীকে গ্রেফতার করে তাদের দেয়া জবানবন্দীর ভিত্তিতে একের পর এক নতুন জঙ্গী ঘাঁটির আবিষ্কার অব্যাহত রেখেছেন তারা। জঙ্গী গোষ্ঠীর সর্বশেষ জঙ্গী আস্তানা কোন্টি তার ওপর চোখ রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বড় ধরনের নাশকতা ঘটানোর আগেই একের পর এক জঙ্গী আস্তানার পতন ঘটানো অব্যাহত সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে তারা। সারাদেশে চলমান জঙ্গীবিরোধী অভিযানে একের পর এক জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, সর্বশেষ জঙ্গী আস্তানার ঠিকানাটি আর কতদূর? রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিভৃত গ্রামের এক বাড়িতে অপারেশন সান ডেভিল জঙ্গীবিরোধী অভিযানে দমকল বাহিনীর এক কর্মকর্তা, পাঁচ জঙ্গীসহ ছয়জন নিহত, তিন জন উদ্ধার, পিস্তল, বোমা, বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় জঙ্গীরা যে গ্রামাঞ্চলের তৃণমূলে ঘাঁটি গেড়ে তৎপরতায় জড়িত বলে তদন্তকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ মাসে সারাদেশ থেকে যেসব জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে তাদের দেয়া জবানবন্দী ও প্রযুুক্তি ব্যবহার করে আবিষ্কৃত হচ্ছে একের পর এক জঙ্গী আস্তানা। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর এক জনবিচ্ছিন্ন গ্রামে দরিদ্র পরিবারের জঙ্গী আস্তানার অভিযান শেষে রাজশাহী অঞ্চলে আরও জঙ্গী আস্তানার খোঁজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, পুলিশ সদর দফতরের এলআইসি, গোয়েন্দা পুলিশের টিম গোপন জঙ্গী আস্তানার অনুসন্ধান করছে। গত বৃহস্পতিবার ভোরে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর পরই চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরের দুটি জঙ্গী আস্তানা শনাক্ত করে অভিযান পরিচালনা করা হলেও সেখান থেকে কিছুই পাওয়া যায়নি। বর্তমানে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গীবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। সম্প্রতি ঝিনাইদহের আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে দুটি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়। সেখানকার অভিযানে মোট ৭ জঙ্গী নিহত হয়। ঝিনাইদহের রেশ কাটতে না কাটতে গোদাগাড়ীর জঙ্গী আস্তানার খোঁজ পাওয়া যায়। এখন আবার জঙ্গীদের দেয়া জবানবন্দীর ভিত্তিতে আরও গোপন জঙ্গী আস্তানার ওপর নজরদারি করা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন রাজশাহী, চাঁপাই, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাটসহ কয়েকটি এলাকা জঙ্গীপ্রবণ। বিশেষ করে জেএমবির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ও অপারেশনাল কমান্ডার সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের এলাকা বগুড়া। ২০০৪ সালে রাজশাহীর বাগমারায় জেএমবির উত্থান ঘটে। তারপর থেকেই এ অঞ্চলে জঙ্গীদের আবির্ভাব ঘটে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকাকে ঘিরে তারা শক্ত ঘাঁটিও গড়ে তোলে। জঙ্গীবিরোধী অভিযানের কারণে তাদের শক্ত ঘাঁটিও দুর্বল হয়ে যায়। এখন আবার নব্য জেএমবির জঙ্গী আস্তানা আবিষ্কৃত হচ্ছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পাওয়ার আগে গত ২২ এপ্রিল ঝিনাইদহ ও ২৬ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুটি জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। ঝিনাইদহের আস্তানায় কোন জঙ্গীকে পাওয়া যায়নি। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের আস্তানাটি ছিল জঙ্গীদের বিস্ফোরকের ভা-ার বা স্টোর হাউস। অভিযানকালে চার জনের মৃত্যু হয়। আস্তানা থেকে নিহত জঙ্গী আবুর স্ত্রী ও এক সন্তানকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয় অভিযান পরিচালনাকারীরা। এর আগে গত ২৫ মার্চ সিলেটে জঙ্গীরা নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই জোড়া বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটায়। আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর অভিযান চলাকালে বোমা হামলায় নিহত হয় র্যাবের গোয়েন্দাপ্রধান আবুল কালাম আজাদ, পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ সাতজন। এছাড়া গত ১৭ মার্চ ঢাকার আশকোনায় র্যাব সদর দফতরের ব্যারাকে এবং ২৪ মার্চ আশকোনা পুলিশ বক্সের কাছে দুটি আত্মঘাতী হামলায় দুই আত্মঘাতী জঙ্গী নিহত হয়। গত ৭ মার্চ কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশের একটি চেকপোস্টে হামলাকালে গ্রেফতার হয় দুই জঙ্গী। দুই জঙ্গীর জবানবন্দীতে বেরিয়ে আসে নব্য জেএমবির আরও হামলার পরিকল্পনার তথ্য। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রামের সীতাকু-ে দুটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মিলে। সীতাকু- থেকে গ্রেফতার জঙ্গী দম্পতির তথ্য মোতাবেক মিলে সিলেটের আতিয়া মহলের জঙ্গী আস্তানার সন্ধান। সেখানে সেনাবাহিনীর প্যারা- কমান্ডো দল অভিযান চালায়।
পুলিশের কাউন্টার টেরজিম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছরের ১৫ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রামের সীতাকু-, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা, মৌলভীবাজারের বড়হাট ও নাসিরপুর এবং কুমিল্লার কোটবাড়ীতে পাঁচটি বাড়িতে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মিলে। আস্তানাগুলোতে অভিযানে পাঁচ শিশু, পাঁচ নারীসহ ১৯ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে ১৬ জনই আত্মঘাতী ছিল। প্রতিটি আস্তানা থেকে প্রচুর বিস্ফোরক উদ্ধার হয়। এরপর ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহীতে আরও ১২ আত্মঘাতীর ঘটনায় নিহত হয়েছে। গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে তদন্ত করতে গিয়ে ঘটনাটি নব্য জেএমবি ঘটিয়েছে বলে বেরিয়ে আসে। সারাদেশে টানা অভিযান চলতে থাকে। এসব অভিযানে কয়েক শ’ জঙ্গী গ্রেফতার হয়। এরমধ্যে অন্তত সাড়ে সাত শ’ জঙ্গীর জবানবন্দী পর্যালোচনা করা হয়। সেই জবানবন্দীতেই মিলে জঙ্গীদের অবস্থান সম্পর্কে নানা তথ্য। সেই তথ্যের সূত্রধরেই একের পর এক সন্ধান মিলতে থাকে জঙ্গী আস্তানার। ইতোপূর্বে ঢাকায় বেশ কয়েকটি আস্তানার সন্ধান মিলে। গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার পর জঙ্গীদের আর কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। শুধু উত্তরা র্যাব সদর দফতরে এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে পুলিশ চেকপোস্টে আত্মঘাতী হামলা চালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু হামলা চালানোর আগেই পৃথক দুটি ঘটনায় দুই আত্মঘাতী জঙ্গীর মৃত্যু হয়। এরপর জঙ্গীদের আর কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। জঙ্গীবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের মুখে জঙ্গী সংগঠনগুলোর মেরুদ- ভেঙ্গে যাচ্ছে।
জঙ্গীবাদ বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে একের পর এক জঙ্গীবিরোধী অভিযানে জঙ্গীদের সক্ষমতা কিছুটা কমেছে। জঙ্গীদের কয়েক সংগঠক এখনও পলাতক। তাদের সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া গেছে। বিভিন্ন জঙ্গী আস্তানা থেকে কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার হয়েছে। সেগুলো মানসম্মত নয়। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার সময়ও তাদের কাছ থেকে একে-২২’র মতো স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তারপরও দেশ জঙ্গীবাদ থেকে পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত হয়নি। জঙ্গী সংগঠনগুলোর একটি প্রচলিত নীতি রয়েছে, তা হচ্ছে তারা নতুন নতুন নামে সংগঠিত হচ্ছে। হালে নব্য জেএমবি আলোচনায় আসার পর তারা আবার নতুন কোন নামে সংগঠিত হয়ে আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা ঘটাচ্ছে, যা অতীতে এই ধরনের নজিরের ব্যাপকতা ও বিস্তৃত হওয়া চোখে পড়েনি। তবে সারাদেশের ব্যাপক জঙ্গীবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্য দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে, যা আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থার (ইন্টারপোল) প্রধানসহ বিদেশের বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হচ্ছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: