ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বনানী থানার কয়েক পুলিশকে তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদ

তরুণীদের ধর্ষণের স্বীকারোক্তি আসামি সাফাতের

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৪ মে ২০১৭

তরুণীদের ধর্ষণের স্বীকারোক্তি আসামি সাফাতের

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ রাজধানীর বনানীতে রেইন ট্রি হোটেলে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণের মামলায় প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে গ্রেফতারকৃত সাফাত জিজ্ঞাসাবাদে হোটেলে তরুণীদের ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। ডিবি পুলিশ জানায়, গ্রেফতাররা তাদের কৃতকর্মের কথা স্বীকার করায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। এদিকে শনিবার পুলিশের তদন্ত দলটি বনানী থানায় কয়েক পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। অপরদিকে সেদিন রেইন ট্রি হোটেলের নিরাপত্তা তদারকি ও যন্ত্রপাতি সক্রিয় ছিল না। আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর মাস না পেরোতেই আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে এই হোটেলটি। অন্যদিকে এদিন সকালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গুলশান জোনের কর্মকর্তারা হোটেলটিতে কোন এ্যালকোহল জাতীয় কিছু পায়নি। তবে হোটেলটির ওপর নজরদারি রাখা হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দুই আসামির কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে ধর্ষণ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে? সাফাত ধর্ষণের বিষয়টি স্বীকার করেছে। ডিসি মাসুদুর রহমান জানান, এর আগে আমরা ঘটনার শিকার দুই তরুণীর জবানবন্দী নিয়েছি? কিছু আলামতও আমাদের হাতে আছে? তিনি জানান, মামলার আরও তিন আসামি ইভেন্ট ম্যানেজার নাঈম আশরাফ, ড্রাইভার বিল্লাল এবং বডিগার্ড আবুল কালাম এখনও পলাতক? তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে মাসুদুর রহমান দাবি করেন, তারা দেশের ভেতরেই আছে। দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে পারেনি তারা, এমন দাবি করেন তিনি। হোটেলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিফতরের পরিদর্শন শনিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে বনানী রেইন ট্রি হোটেলে পরিদর্শন যান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গুলশান জোনের একটি টিম। দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় আলোচিত ওই হোটেলে পরিদর্শন শেষে বাইরে এসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গুলশান জোনের পরিদর্শক ওবায়দুল কবির সাংবাদিক জানান, ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলের বিরুদ্ধে মাদক বিক্রি ও বার পরিচালনার অভিযোগ ছিল। আমরা সে কারণে পরিদর্শন করেছি। তল্লাশি চালিয়ে আমরা হোটেলটিতে এ্যালকোহল জাতীয় কিছু পাইনি। যেহেতু অভিযোগ উঠেছে সে কারণে আমরা হোটেলটির ওপর নজরদারি রাখব। ওবায়দুল কবির জানান, সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনায় এই হোটেলের বিরুদ্ধেও মদ বিক্রি ও বার পরিচালনার অভিযোগ আসে। সে কারণে আজ আমরা পরিদর্শনে এসেছি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের টিম আসার খবর পেয়ে কি তারা এ্যালকোহল সরিয়ে নিয়েছে কিনা। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বিষয়টি আমরা দেখার জন্যই এসেছিলাম। কিন্তু কিছু মেলেনি। তবে আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে হোটেলটির ওপর নজরদারি রাখব। শুধু এই হোটেল নয়। যে কোন হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। রেইন ট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলন হোটেলের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর কথা ছিল ৯ এপ্রিল। তার আগেই ২৮ মার্চ হোটেলের দুটি কক্ষ ভাড়া দেয়া হয়। আর ওই সময় হোটেলটির নিরাপত্তা তদারকি ও যন্ত্রপাতি সক্রিয় ছিল না। শনিবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক ফরগেট ও ইন্টার্নাল অপারেশন এক্সিকিউটিভ ফারজান আরা রিমি এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। ব্রিফিংয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায়, হোটেলটির গ্র্যান্ড ওপেনিং হয় ৯ এপ্রিল। এর আগে মেটাল ডিটেক্টর কার্যকর ছিল না। স্বাভাবিক তল্লাশির মাধ্যমেই হোটেলটিতে ছিল প্রবেশের সুযোগ। আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর আগেই গত ২৮ মার্চ সাফাত ও সাদমানদের হোটেলটির দুটি কক্ষ ভাড়া দেয়া হয়। তখন ম্যানুয়ালি তল্লাশি করা হয়। হোটেলটির এক্সিকিউটিভ (ইন্টার্নাল অপারেশন) ফারজানা আরা রিমি জানান, অভিযানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও মানবাধিকার কমিশন অস্বাভাবিক কিছু পায়নি। আমাদের পুরো হোটেলের স্ট্রাকচার থাইল্যান্ড থেকে করা। হোটেলটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় গত ৯ এপ্রিল। তবে এর আগে আমরা টেস্ট কেস হিসেবে কক্ষ ভাড়া দিয়েছিলাম। ওই ঘটনার পর হোটেল কর্তৃপক্ষের প্রতি গাফিলতির যে অভিযোগ করেছেন দুই তরুণী, সে সম্পর্কে হোটেলের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কিনা। সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে রিমি বলেন, এটা অনেকদিন আগের ঘটনা। এটা আমাদের মেমোরিতে নেই। অনেকদিন আগের ঘটনা হলেও এটা তো আলোচিত একটি ঘটনা। এটা হোটেল কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে কিনা। এমন প্রশ্নের জবাবে রিমি জানান, এতদিন আগের ঘটনা আমাদের পক্ষে মনে করা সম্ভব না। তাছাড়া ২৮ দিনের বেশি আমরা ফুটেজ সংরক্ষণ করি না। ফলে ওই দিনের ঘটনা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব না। এর আগে ফ্র্যাঙ্ক ফরগেট সাংবাদিকদের জানান, হোটেল রেইন ট্রির মদের লাইসেন্স নেই। মামলা দায়েরের পর ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওই রাতে ‘ধর্ষক’রা অস্ত্র নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিল। অস্ত্রের মুখে মদ খাইয়ে জোরপূর্বক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এদিকে ডিবি পুলিশ জানায়, শনিবার রিমান্ডের প্রথম দিনে গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। মামলার প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে গ্রেফতারকৃত সাফাত আহমেদ জিজ্ঞাসাবাদে হোটেলে তরুণীদের জোরপূর্বক ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন। গ্রেফতার অপর আসামি সাদমান সাকিফ জানায়, তার বান্ধবীদের জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে এনে তার বন্ধুদের হাতে তুলে দিয়ে ওই হোটেল থেকে কেটে পড়েন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ধর্ষণের আগে তরুণীদের মদপান করানো হয়। এরপর রুমে আটকে রেখে তাদের একাধিকবার পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। এরপর ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয় বলে জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানান। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে গ্রেফতাররা বিমর্ষ ও চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বনানীর দ্য রেইন ট্রি হোটেল এ্যান্ড রেস্টুরেন্টে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় বনানী থানায় মামলা না নিতে চাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানির অভিযোগ করেছেন বাদীপক্ষ। এই ধর্ষণের মামলা নিতে বনানী থানায় কোন গাফিলতি হয়েছে কিনা। পুলিশ তদন্ত টিম ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। ঘটনার পরপরই আলোচিত ওসি ফরমান আলী ৯ মে থেকে ‘একান্ত পারিবারিক’ কারণ দেখিয়ে ৫ দিনের ছুটিতে যান। তা নিয়ে বনানী থানার পুলিশ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এরপর বাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। বনানী থানায় কোন গাফিলতি আছে কিনা। এই তদন্ত কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোঃ মিজানুর রহমান, কৃষ্ণপদ রায় এবং মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন।
×