ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভাল নেই বৃদ্ধাশ্রমে মায়েরা... দিন কাটে অশ্রুজলে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৪ মে ২০১৭

ভাল নেই বৃদ্ধাশ্রমে মায়েরা... দিন কাটে অশ্রুজলে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু যেন ভাই/ এর চেয়ে নামটি মধুর ত্রিভুবনে নাই/। ছোট্ট শিশু যেমন বেঁচে থাকে মাকে আঁকড়ে ধরে। ঠিক একইভাবে বৃদ্ধ বয়সে সেই মা সন্তানকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চান। মা যেমন সন্তানের সবচেয়ে বড় আশ্রয় তেমনি এক সময় সন্তানের ওপর নির্ভর করেই বৃদ্ধ মা বেঁচে থাকে। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে অনেক মায়েরই সৌভাগ্য হয় না সন্তানকে আঁকড়ে থাকার। বেলা শেষে বৃদ্ধাশ্রমই হয়ে ওঠে অনেক মায়ের সর্বশেষ আশ্রয়। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে কেমন আছেন বৃদ্ধ মায়েরা? বিশ^ মা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের হিতৈষী প্রবীণ নিবাস ঘুরে দেখা গেল বৃদ্ধাশ্রমে মায়েরা বেঁচে আছেন অশ্রুজলকে অবলম্বন করে। সন্তানরা তাদের রেখে গেছেন শান্তিতে থাকার জন্য। মায়েদের থাকার জন্য বৃদ্ধাশ্রম বাবদ প্রতিমাসে টাকাও খরচ করছেন। কিন্তু তারা কি শান্তিতে আছেন? কোন মা কি তার সন্তানদের ছেড়ে শান্তিতে থাকতে পারেন? রাজধানীর হিতৈষী প্রবীণ নিবাসের ৪১৩ নম্বর কক্ষে চার বছর ধরে থাকছেন ৬০ বছর বয়সী মেরী মাধুরী। গত ৭ মে দুপুরে তাকে দেখা গেল নিজ কক্ষে চুপচাপ বসে থাকতে। মা বলে ডেকে যখন তার কাছে জানতে চেয়েছি ‘মা কেমন আছেন’? তখন তার চোখ ছলছল করছিল। এর পর শীতল কণ্ঠে বললেন, ‘আছি মোটামুটি। ভাল থাকার চেষ্টা করছি আজও।’ মাত্র দুপুরের খাবার খেয়ে নিজ কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। জানালেন তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। দুই ছেলে ভাল রোজগার করেন। একজন ব্যবসায়ী আরেকজন চাকরিজীবী। বড় মেয়েও চাকরি করেন। আর ছোট মেয়ে গৃহিণী। চার বছর আগে তিনি তার বড় মেয়ের সঙ্গেই থাকতেন। বড় ছেলের বাসায়ও মাঝে মাঝে থাকতেন। কিন্তু তার ছেলের বউ একদিন কথা কাটাকাটির সময় তার মাথায় আঘাত করেন। এরপর থেকে তিনি তার স্বামীর সঙ্গে বড় মেয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। কিন্তু তার স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেমেয়ের কাছে বোঝা হয়ে ওঠেন গর্ভধারিণী মা। তাকে কোন কিছু না জানিয়েই ডাক্তার দেখানোর নাম করে হঠাৎই নিয়ে আসে আগারগাঁওয়ের এই হিতৈষী প্রবীণ নিবাসে। ৬০ বছর বয়সী এই মা বললেন, ‘ভেবেছিলাম কিছুদিনের জন্য এখানে থাকতে হবে। কিন্তু পরবর্তীতে সন্তানরা বলেছে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত এটাই নাকি আমার একমাত্র আশ্রয়কেন্দ্র।’ কথাগুলো বলতে বলতে তিনি আর চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি। বাঁধ ভেঙ্গে চোখের কোণে গড়িয়ে পড়তে লাগল জল। মেরী মাধুরী খ্রীস্টান ধর্মের অনুসারী। তাই বড়দিন তাদের একমাত্র ধর্মীয় উৎসব। এদিনটিও তিনি বৃদ্ধাশ্রমে এই ছোট্ট ঘরটিতেই কাটান। জানালেন ‘মেয়েরা দেখতে আসে। কিন্তু ছেলেরা আসে না। মেয়েরাই এসে টাকা, রুম ভাড়া ও খাবারের টাকা দিয়ে যায়। কিন্তু আমার হাত খরচের টাকা দেয় না। আমি বলি এক হাজার টাকা হাত খরচের জন্য দিতে। কিন্তু তারা দেয় না। উৎসবের সময় নতুন কাপড় নিয়ে দেখতে আসে। ছোট নাতি-নাতনিদের দেখতে ইচ্ছে করে কিন্তু উপায় নেই। অনেকবার বলেছি ওদেরÑ দু’একদিনের জন্য আমাকে তোরা বাসায় নিয়ে চল। কিন্তু আমাকে তারা বোঝা ভাবে। তাই তো আমাকে এখানে রেখে ঘাড়ের বোঝা সরিয়েছে।’ পরক্ষণে তিনি বললেন, ‘ভাল আছি। এভাবেই ভাল থাকতে চাই। এখানে সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করি। এখানকার সবার মনেই কষ্ট। আমরা সবাই সন্তানের পরিবারের উচ্ছিষ্ট মাত্র।’ ১১৩ নম্বর কক্ষে মেরী মাধুরীর সঙ্গে থাকেন আরও একজন। তার নাম মীরা চৌধুরী। ৭ মে দুপুরে তাকে দেখা গেল তার বিছানায় শুয়ে থাকতে। কাছে যেতেই বলে উঠলেন, ‘তুমি কি ডাক্তার’? সকাল থেকেই পেটে ব্যথা করছে। কিছু খেতে পারছি না।’ এটা স্পষ্ট যে শারীরিকভাবে তিনি খুবই অসুস্থ। উঠে বসতে পারলেন না। শুয়ে শুয়েই কথা বললেন তিনি। সাংবাদিক বলতেই পরক্ষণেই তিনি বললেন, ‘সামনে মা দিবস, তাই জানতে এসেছ কেমন আছি, তাই না? তাও ভাল বিশেষ দিবসে তোমরা আমাদের মনে করো। কিন্তু আমার সন্তানরা তো ওদের জীবনের সবচেয়ে বড় খুশির দিনগুলোতেও আমাকে মনে করে না।’ মীরা চৌধুরী ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন খুলনা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে। পরে তিনি ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) ডিরেক্টর পদে কর্মরত ছিলেন। ৭০ বছর বয়সী এই মা জানালেন, ‘সারা জীবনের অর্জিত সম্পদ দিয়ে একমাত্র সন্তানকে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় পাঠিয়েছিলাম। ছেলে বিদেশ যাওয়ার কিছুদিন পরই স্বামী মারা যান। তখন আমাদের বাংলামোটরের দিলু রোডে ছয় তলা একটি বাড়ি ছিল। বাড়িটি ২ কোটি টাকায় বিক্রি করে একমাত্র সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালাই। ভেবেছিলাম বাড়ি দিয়ে কী হবে। সন্তান মানুষের মতো মানুষ হলেই তো আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ হবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! ছেলে মানুষের মতো মানুষ হয়েছে, কিন্তু ছেলের কাছে আমার আশ্রয় হয়নি। সবকিছু হারিয়ে এখন আমি বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা। শেষজীবনে পেনশনের সামান্য কিছু টাকা দিয়ে কোনমতে খেয়ে-পরে বেঁচে আছি।’ ছেলের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমার জন্য সমাজে ওর সম্মান নষ্ট হোক তা আমি চাই না। দোয়া করি ও সন্তানদের নিয়ে সুখে থাকুক।’ কথাগুলো বলতে বলতে জলে চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে মীরা চৌধুরীর। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলতে থাকেন, ‘ইচ্ছে ছিল শেষ বয়সে নাতি-নাতনির সঙ্গে মজা করে দিন পার করব। কিন্তু মজা করা তো দূরের কথা, ওদের মুখখানিই আজও দেখা হয়নি। আল্লাহ যেন এমন দিন আর কাউকে না দেন।’ কীভাবে সময় কাটছে জানতে চাইলে মীরা চৌধুরী বলেন, ‘নামাজ পড়ি। এখানে বেশ বড় একটা লাইব্রেরি আছে। ওখানে বসে বই, পত্রিকা পড়ি। বিকেলের দিকে কয়েকজন মিলে করিডরে বসে গল্প করি। এখানকার পরিবেশ ভাল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তবে খাবারের মান খারাপ।’ ‘সব সময় সন্তানদের কথা মনে পড়ে। রাতে ঘুম আসে না। আর ঘুমালেও গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন ছেলেমেয়েদের মুখগুলো খুব দেখতে ইচ্ছে করে। বারবার মনে করি ওদের কথা মনে করব না, কিন্তু ভুলতে তো পারি না।’ আবেগাপ্লুত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন প্রবীণ নিবাসের আরেক নিবাসী নাদিরা বেগম। তিনি মহিলা পরিষদের রামপুরা ব্রাঞ্চের আহ্বায়ক ও সদস্য। জড়িত ছিলেন বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্মকা-ের সঙ্গেও। ছেলেমেয়ে কতজন, কোথায় থাকেন জানতে চাইলে তিনি সন্তানদের সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে রাজি হননি। নাদিরা বেগম জানান, ‘দুই বছর হচ্ছে এখানে এসেছি। বাবার বাড়ি রামপুরা। স্বামী মারা যাওয়ার পর কয়েক বছর ওখানেই ছিলাম। ভাইরা জায়গাটা ডেভেলপারকে দিয়েছে। কাজ চলছে তাই প্রবীণ নিবাসে উঠেছি। অভিমানী সুরে নাদিরা বেগম আরও বলেন, ছেলেরা যেখানেই আমায় ফেলে রাখুক ওরা সামনে এলে সব কষ্ট ভুলে যাই। শুধু অপেক্ষায় থাকি কখন ওরা আমাকে দেখতে আসবে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের হিতৈষী প্রবীণ নিবাসে যারা শেষ বয়সে আশ্রয় পেয়েছেন। তাদের অনেকেই নিজে রান্না করে খান। আবার অনেকেই এখানকার খাবার খেতেই অভ্যস্ত। নারগিস জাহান নামে এক মা নিজে রান্না করে খেতেই পছন্দ করেন বলে জানালেন। হিতৈষী প্রবীণ নিবাসের চার তলার বারান্দা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে রান্নাঘর। সেখানে দেখা গেল তাকে চুলায় ভাত চড়িয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ৭৫ বছর বয়সী এই মা জানালেন, দুই ছেলে, দুই মেয়ে মিরপুর-১ নম্বরে থাকে। শুধু ছেলেমেয়েই নয়, তার ভাইবোনরাও থাকেন আশপাশে। তবুও তাকে থাকতে হয় একা, এই নিবাসে। কতদিন ধরে প্রবীণ নিবাসে আছেন জানতে চাইলে নারগিস জাহান বলেন, ‘তিন বছর ধরে এই নিবাসে আছি। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিন মাস তিন মাস করে ছেলেদের কাছে থাকতাম। কিন্তু ছোট ছেলে শ^শুরবাড়িতে ওঠায় বড় ছেলে জানিয়ে দেয় তার একার পক্ষে আমাকে সারা বছর বাড়িতে রাখা সম্ভব নয়। তাই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে। অবশ্য মাকে দেখতে আসার তেমন একটা সময় না পেলেও ছেলেরা প্রতিমাসেই বৃদ্ধাশ্রমের খরচ পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন করে। এখানে খাওয়া-দাওয়ার মান খুব খারাপ। তাই ঠিকমতো চলাফেরা করতে কষ্ট হলেও নিজেই রান্না করে খাই। এখানে কর্মরত অনেকেরই ব্যবহার খারাপ। তবুও ধন্যবাদ এরা আমাদের বোঝা তো বহন করছে।’ প্রবীণ নিবাসের পরিবেশ সম্পর্কে এভাবেই সোজাসাপটা জানালেন নারগিস জাহান। আমাদের দেশে দরিদ্র প্রবীণদের সংখ্যা শতকরা ৩৭ জন। তাই বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা এবং সদস্য দুটোই ধীরে ধীরে বাড়ছে। বৃদ্ধাশ্রমে যারা থাকেন তাদের শতকরা ৭০ ভাগই নারী এবং তাদের বেশিরভাগই কারও না কারও মা। হিতৈষী প্রবীণ নিবাসে বর্তমানে ৪৩ নারী রয়েছেন। গাজীপুর গিভেন্সি গ্রুপের বৃদ্ধাশ্রম, সাভার বৃদ্ধাশ্রম এবং সমাজসেবা অধিদফতরের বৃদ্ধাশ্রমেও বাড়ছে বয়সী মায়েদের সংখ্যা। বৃদ্ধাশ্রমে ভাল নেই মায়েরা। একদিকে স্বজন ছাড়া একাকী জীবন। অন্যদিকে বৃদ্ধাশ্রমের নানা সমস্যা। অসুখবিসুখে সেবা করার তেমন কেউ নেই। আয়া আছে তবে তাদের পাওয়া দুষ্কর। প্রবীণ নিবাসে আশ্রিত মায়েদের উদ্দেশে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের মহাসচিব অধ্যাপক এ এস এম আতিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘নিত্যদিন চোখের পানি অবলম্বন করে তারা বেঁচে আছেন। এখানকার একেকজন মায়ের জীবনের গল্প কখনও ছোট গল্প, কখনওবা একেকটি উপন্যাসের মতো। সাংবাদিকদের সঙ্গে এখানকার অনেকেই কথা বলতে চান না। অতীতে বেশ কিছু সংবাদ প্রকাশের পর অনেক মায়ের সন্তানরা এসে আমাদেরকে কথা শোনান। তাদের মায়েদেরকে অপমান করে যান। তাদের ভাষ্য ‘তারা তাদের মায়েদের জন্য টাকা খরচ করে এখানে রেখেছেন। চিড়িয়াখানার পশু-পাখি নাকি তারা যে সবাই দেখতে আসবে।’ বৃদ্ধ বয়সে সন্তানই মায়ের শেষ ভরসা। কিন্তু এসব অসহায় মায়েরা আজ সন্তানের সঙ্গে থাকতে পারছে না। কেউবা ছেলের বউয়ের অত্যাচারে, কেউবা ছেলে ও মেয়ের সংসারের উচ্ছিষ্ট হওয়ায় তাদের আশ্রয় হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। তবুও এক হিসেবে তারা সকলে ভালই আছেন। সংসারের অশান্তি তো তাদের স্পর্শ করছে না। এখানে যারা আছে সবার গল্পই প্রায় একই। তাই এখানকার সবাই সবাইকে দেখে উৎসাহ পায় বেঁচে থাকতে।
×