ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বরিশালের চর আবুপুরবাসী অসহায়

ভূমিহীনদের আতঙ্ক মজু বাহিনী

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ১৪ মে ২০১৭

ভূমিহীনদের আতঙ্ক মজু বাহিনী

খোকন আহম্মেদ হীরা, চর আবুপুর (হিজলা) থেকে ফিরে ॥ নদী ভাঙ্গনকবলিত এলাকা হিসেবে পরিচিত বরিশালের হিজলা উপজেলার রাক্ষুসী জয়ন্তী নদীর তীরবর্তী হরিনাথপুর ইউনিয়নের চর আবুপুর গ্রাম। নদীতে মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করছে ওই গ্রামের কয়েক শ’ পরিবার। প্রতিবছর নদীভাঙ্গনে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিলেও এবার গ্রামবাসীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাাঁড়িয়েছে স্থানীয় ভূমিদস্যু সাবেক সর্বহারা নেতা মজিবর রহমানের সন্ত্রাসী ‘মজু বাহিনী’। সূত্রমতে, ওই বাহিনীর বেপরোয়া চাঁদাবাজি, দখল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতনের পর এবার স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসকের নির্দেশ অমান্য করে চরের জেগে ওঠা ভূমিহীনদের ১২শ’ একর জমি দখল করে নিতে মজু বাহিনীর সন্ত্রাসীরা ৭০ বছরের বৃদ্ধকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। গত ৫ মে মজু বাহিনীর ক্যাডাররা সশস্ত্র অবস্থায় অসহায় ভূমিহীনদের পাঁচটি বসতঘর, একটি মাছের আড়তে হামলা চালিয়ে ভাংচুরসহ লুটপাট ও একটি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। ভুক্তভোগী সহস্রাধিক গ্রামবাসী শুক্রবার সকালে নদীর তীরে দুই ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন এবং বিক্ষোভ সভা করে সন্ত্রাসী মজু বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। সরেজমিনে ভুক্তভোগী এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, রাক্ষুসী জয়ন্তী নদী ১৯৯৬ সাল থেকে চর আবুপুর গ্রামের কয়েক পরিবারের সহয় সম্পত্তি গ্রাস করে নেয়ার পর অধিকাংশ পরিবারের সদস্য আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। ১৯৯৮ সাল থেকে নদীর অপরপ্রান্তে চর জেগে ওঠার পর নদীভাঙ্গনে সর্বস্বান্ত ভূমিহীন পরিবারগুলো নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সম্পূর্ণ আশ্রয়হীন অর্ধশতাধিক পরিবারের সদস্য দীর্ঘদিন থেকে জেগে ওঠা চরে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস শুরু করে। ও হরিনাথপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি আবুল বাশার গাজী জানান, নদীভাঙ্গনে সর্বস্বান্ত হওয়ার পর জেগে ওঠা চরে বসতি নির্মাণ করে ২০১১ সাল পর্যন্ত নদীতে মাছ ধরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করে আসছিলেন। এরই মধ্যে পুরো চরের প্রায় ১২শ’ একর জমির ওপর লোলুপ দৃষ্টি পরে স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যু, সাবেক সর্বহারা নেতা ও একসময়ের জলদস্যু মজিবর রহমান ওরফে মজু সরদারের। তিনি আরও জানান, ১নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি মজু সরদার কৌশলে জেগে ওঠা চরের জমিতে বসবাস করা বাসিন্দাসহ অন্যান্য ভূমিহীনদের সরকারী ডিসিআরের (এক নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত) কার্ড করে দেয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা উত্তোলন করে। ওইসময় সে সিএস ও আরএস জমির মালিকদের সম্পত্তিও সরকারী খাস খতিয়ানভুক্ত করে দেয়। পরবর্তী সময়ে ডিসিআর এর কার্ড করে দেয়ার জন্য যাদের কাছ থেকে মজু সরদার টাকা উত্তোলন করেছে তাদের কার্ড করে না দিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বরিশালের সম্পত্তি শরিয়তপুর জেলার গোসাইরহাট এলাকার গফুর জমাদ্দার, হায়দার দেওয়ান, মুলাদীর সোহেল আকন, লতিফ সরদার, সজল আকন, মোতালেব খন্দকার, মৃত সাদেক দেওয়ানসহ নামে-বেনামে ও মৃত ব্যক্তিদের নামে ডিসিআরের বন্দোবস্ত এনে দেয়। সমাজসেবক সামসুদ্দিন খান জানান, উল্লিখিত বিষয় নিয়ে মজু সরদারের সঙ্গে ভূমিহীনদের চরম বিরোধ দেখা দেয়ার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একাধিকবার সমাধান বৈঠকের আয়োজন করা হলেও মজু সরদার সমাধান বৈঠক অমান্য করে। সে (মজু সরদার) ক্ষিপ্ত হয়ে ভাড়াটে লোকজনদের নিয়ে নিজের নামে ‘মজু বাহিনী’ নামের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে একমাত্র নদীভাঙ্গনের শিকার ভূমিহীনদের অধিকার জেগে ওঠা চরের ১২শ’ একর সম্পত্তি দখল করতে একাধিক ভূমিহীনকে ভয়ভীতিসহ প্রাণনাশের হুমকি প্রদর্শন করে। ভূমিহীন আবুল হাওলাদার জানান, হুমকির ঘটনায় ভূমিহীনদের পক্ষে তিনি চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ভূমিহীনদের জীবনসহ ভোগ দখলীয় চরের সম্পত্তি রক্ষার দাবি জানিয়ে হিজলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু জাফর রাশেদের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি আবেদনের প্রেক্ষিতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ওইদিনই হিজলা থানার ওসিকে নির্দেশ প্রদান করেন। নদীভাঙ্গনে সর্বস্বান্ত চর আবুপুর গ্রামের ভূমিহীন সোহরাব সিকদার, হারুন ঢালীসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রকৃত ভূমিহীনদের বঞ্চিত করে মজু সরদার নামে-বেনামে ও মৃত ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য দিয়ে সরকারী খাস জমি বন্দোবস্ত নেয়ার বিচার দাবি করে গত ২০ মার্চ জেলা প্রশাসকের কাছে অর্ধশত ভূমিহীনের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র দাখিল করা হয়। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক কর্তৃক চরের জমি ভোগ দখলে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারিসহ হিজলা উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সরেজমিনে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়াও সম্প্রতি সময়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ সরেজমিনে এসে ভূমিহীনদের সম্পত্তির ওপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে জনসম্মুখে শাসিয়ে দিলেও কর্ণপাত করেনি ভূমিদস্যু মজু সরদার। সূত্রমতে, উল্টো এসব ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ভূমিদস্যু মজু সরদার তার সন্ত্রাসী ‘মজু বাহিনী’সহ ভাড়াটিয়া ২-৩শ’ সন্ত্রাসীদের নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় গত ৫ মে সকালে চরের জমিতে ভূমিহীনদের রোপিত বোরো (পাকা) ধান লুটসহ চর দখলের জন্য একাধিক বোমা বিস্ফোরিত করে হামলা চালায়। হামলাকারীরা সশস্ত্র অবস্থায় অসহায় ভূমিহীনদের পাঁচটি বসতঘর, একটি মাছের আড়তে হামলা চালিয়ে ভাংচুরসহ লুটপাট ও একটি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ভূমিহীনরা বাধা প্রদান করলে উভয়ের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে। খবর পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিন রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। হামলা ও সংঘর্ষে উভয়গ্রুপের কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়। গুরুতর আহত মুলাদী উপজেলার বাসিন্দা মোসলেম সরদার, চান্দু হাওলাদার, শাহআলম ঢালী, আলীম দেওয়ানকে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করার পর ওইদিন সন্ধ্যায় মুলাদীর মোসলেম সরদার (৭০) মারা যায়।
×