ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গৌরব জি. পাথাং

মায়ের অপর নাম ভালবাসা

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১৪ মে ২০১৭

মায়ের অপর নাম ভালবাসা

মা দিবসের সূচনাই হয় মায়ের প্রতি ভালবাসা প্রকাশের জন্য। মা দিবস উদযাপনের প্রচলনের কৃতিত্বটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানা মেরী জার্ভিস নামের এক মহীয়সী নারীর। তার মা অ্যানা মেরী রীভস জার্ভিস ছিলেন শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য একজন সক্রিয় কর্মী। গৃহযুদ্ধের সময় তিনি প্রশমনের জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ৯ মে, ১৯০৫ খ্রি. মৃত্যুবরণ করলে তার মেয়ে মেরী জার্ভিস তার মা এবং সকল মাকে সম্মানিত করার জন্য মা দিবস পালনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মায়ের অবহেলার শিকার বহু সন্তান। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জাতীয়ভাবে মা দিবস পালনের জন্য উদ্যোগী হন। ১৯০৭ খ্রি. ১২ মে, তিনি সেন্ট এন্ড্রুস মেথোডিস্ট গির্জায় উপাসনার আয়োজন করেন। সেখানে তিনি উপস্থিত সবাইকে গোলাপী সুগন্ধী ফুল উপহার দিয়েছিলেন যে ফুল তার মায়ের প্রিয় ছিল। মাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্র্যাফটনে মায়ের স্মরণে একটি গির্জা তৈরি করেন। ১৯০৮ খ্রি. ১০ মে, তার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে আবার প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন। পরের বছর তিনি পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়া শহরে এক প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন এবং মা দিবস পালন করেন। তারপর থেকে তিনি জাতীয়ভাবে মা দিবস পালন করার জন্য ও সরকারী ছুটির দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলেন, চিঠি লিখেছেন মন্ত্রণালয়ে ও গিয়েছেন মানুষের ঘরে ঘরে। ১৯১৪ খ্রি. মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে জাতীয়ভাবে মা দিবস হিসেবে পালন করার জন্য ছুটির ঘোষণা করেন। সেই থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস পালিত হয়ে আসছে। তার পথ ধরেই সারা বিশ্বে এখন মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটি মা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ইতোমধ্যে মাকে নিয়ে অনেক গান ও সাহিত্য রচনা হয়েছে। মাকে নিয়ে লেখা ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাংলা সাহিত্যে আনিসুল হকের উপন্যাস ‘মা’ খুবই বিখ্যাত। তিনি এখানে বাংলা মায়ের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। তিনি লিখেছেন, আজাদ ছিলেন এক দুর্দান্ত মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকায় গেরিলা অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে ধরা পড়লেন পাকিস্তানীদের হাতে। রমনা থানায় তাঁকে রাখা হলো। খবর পেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন তার মা। মা বললেন, ‘শক্ত হয়ে থেকো বাবা। সহযোদ্ধাদের নাম বোলো না।’ আজাদ বললেন, ‘না মা, বলব না। তুমি কাল যখন আসবে, আমার জন্য ভাত নিয়ে এসো। কত দিন ভাত খাই না।’ পরদিন ছেলের জন্য ভাত নিয়ে গেলেন মা। গিয়ে দেখেন, ছেলে নেই। নেই তো নেই-ই। মা ছেলেকে আর ফিরে পাননি। তারপর ১৪ বছর বেঁচে ছিলেন আজাদের মা। কিন্তু একটি দিনের জন্যও ভাত মুখে দেননি। তাঁর ছেলে ভাত খেতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি ছেলের মুখে ভাত তুলে দিতে পারেননি। যে ভাত তিনি ছেলের মুখে তুলে দিতে পারেননি, সেই ভাত তিনি কেমন করে নিজের মুখে তুলে নিবেন! এই হচ্ছে আমাদের মা। বাংলার মা। মায়ের ভালবাসা অপরিসীম। সন্তান তাকে দূরে ঠেলে দিলেও, আঘাত করলেও সন্তানকে কখনও ফেলে দেন না। বরং মা তার সন্তানকে আপন করেই নেন। গল্পে আছে; এক ছেলে তার মাকে খুব ভালবাসত। মা ছাড়া সে কিছুই বুঝত না। সব সময় মাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত। তার সব কিছুই ছিল শুধু মাকে ঘিরে। একদিন ছেলেটি বড় হলো। তরুণ বয়সে পা দিতেই এক মেয়ের প্রেমে পড়ল। ছেলেটি মেয়েকে বলল, তোমাকে খুব ভালবাসি। মেয়েটি বলল, ভালবাসার কি প্রমাণ দিতে পারো? ছেলেটি বলল, তোমার জন্য সব কিছু করতে পারি। মেয়েটি বলল, সব পারো? ছেলেটি বলল, হ্যাঁ সব পারি। তুমি চাইলে এমন কিছু নেই এনে দিতে পারব না। মেয়েটি বলল, তাহলে যাও, তোমার মায়ের হৃৎপি-টা নিয়ে আস। ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কাছে গেল আর মাকে হত্যা করে মায়ের হৃৎপি-টা নিয়ে দৌড়াতে লাগল মেয়েটির দিকে। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল। তখনি মায়ের হৃৎপি-টা কথা বলে উঠল, খোকা, ব্যথা পেলি নাতো? এ হচ্ছে মায়ের হৃদয়। মায়ের হৃদয় মানেই ভালবাসায় পরিপূর্ণ। এই হলো মায়ের ভালবাসা। মাকে আমরা যতই ভুলে যাই না কেন, মাকে যতই অবজ্ঞা করি না কেন, অপমান নিন্দা করি না কেন, মা তার ভালবাসা থেকে আমাদের বঞ্চিত করেন না। তিনি পরম মমতায় তার সন্তানকে কোলে তুলে নেন। সন্তানের কাছে মায়ের স্থান সবার ওপর। পিসি, মাসী যাই থাকুক কেন কেউ মায়ের স্থান দখল করতে পারে না। মায়ের অভাব পূরণ করতে পারে না। মায়ের তুলনা শুধু মা। অন্য কিছু নয়। পৌরাণিক কাহিনীতে মায়ের প্রতি সন্তানের যে ভালবাসার প্রকাশ তা লক্ষ্য করা যায়। মা দুর্গা তার দুই সন্তান কার্তিক ও গণেশকে বললেন, তোমরা দু’জনই বিশ্ব ঘুরে আস। যে আগে ঘুরে আসতে পারবে, সে-ই বেশি মাতৃ¯েœহ পাবে। কার্তিকের বাহন ময়ূর দ্রুত উড়াল দিয়ে চলে গেল আকাশে বাতাসে। আর গণেশ ইঁদুর বাহন নিয়ে কোথায় যাবে? সে মায়ের চারপাশে এক চক্কর ঘুরে এসে বলল, মা, সারা বিশ্ব ঘুরে এলাম। এই গল্প থেকে বুঝতে পারি, মা কি বিস্ময়কর! মায়ের সঙ্গে অন্য কারও তুলনা হয় না। মায়ের সঙ্গে অন্য কারও তুলনা হয় না। মায়ের স্থান কোন কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয় এবং তার ঋণও কখনও শোধ করতে পারব না। তাই গানে বলে, ‘মায়ের একধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম, পাপোশ বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না আমার মা।’ শিশু জন্মের আগেই মা তার সন্তানের জন্য প্রতীক্ষার আঁখি মেলে দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে। সন্তান বাইরে গেলে খাবার নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকে। অসুস্থ হলে অপেক্ষা করে, কেউ বাড়ির বাইরে থাকলে মা অপেক্ষায় থাকে। ছেলেমেয়েদের জন্য মায়ের অপেক্ষার শেষ নেই। গানে আছে, ‘সেই রেল লাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে/ এক মধ্য বয়সী নারী এখনও রয়েছে হাত বাড়িয়ে। খোকা ফিরবে, ঘরে ফিরবে, কবে ফিরবে, নাকি ফিরবে না।’ কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘কোন এক মাকে’ কবিতায় দেখতে পাই যে, এক মা তার ছেলের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে থাকেন। ‘কুমড়ো ফুলে ফুলে/ নুয়ে পড়েছে লতাটা/ সজনে ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা/ আর, আমি ডালের বড়ি/ শুকিয়ে রেখেছি- খোকা, তুই কবে আসবি। কবে ছুটি?’ ছেলের জন্য মা খাবার প্রস্তুত করে রাখে। আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রতীক্ষায় থাকে কখনোবা নিজেই প্রদীপ হয়ে যায়। গানে আছে, ‘প্রদীপ হয়ে মোর শিয়রে/ কে জেগে রয় দুঃখের ঘরে/ সেই তো আমার মা।’ মা-ই সন্তানের জন্য শেষ আশ্রয়স্থল। হতাশা, নিরাশা, দীনতা, ব্যর্থতা, দুঃখ শোকে কেবল মা-ই পারেন সন্তানকে সান্ত¡না দিতে, আশা জাগাতে, দুঃখ কষ্ট লাঘব করতে। মায়ের কোল যেন সন্তানের শেষ আশ্রয়স্থল। তাই গানে বলে, ‘আজ ঐ শুভ্র কোলের তরে/ ব্যাকুল হৃদয় কেঁদে মরে।’ মায়ের ভালবাসা ও ¯েœহ আদরের তুলনা দিতে গিয়ে কবি লিখেছেন, ‘মাগো তোমার মতো নেয় না কেহ আমায় বুকে টানি/ আঁচল দিয়া মোছায় না কেহ আমার চোখের পানি/ হায়রে মা জননী আমার, হায়রে মা জননী। মড়ঁৎড়নপংপ@মসধরষ.পড়স
×