ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ময়নাতদন্ত!

প্রকাশিত: ০৪:১২, ১৪ মে ২০১৭

ময়নাতদন্ত!

দেশে ময়নাতদন্ত নিয়ে বিতর্ক আছে। এ ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও কিছু কম নেই। সর্বোপরি ১৮৭১ সালের সেই ব্রিটিশ আমলে প্রণীত আইন দিয়েই চলছে ময়নাতদন্তের কাজ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত করানো হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রী-ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত চিকিৎসক এবং প্রশিক্ষণবিহীন লোকজন দিয়ে। এ ক্ষেত্রে এমনকি সমাজে অদ্যাবধি অস্পৃশ্য-অশুচি হিসেবে বিবেচিত ডোম সম্প্রদায়ের লোকদের দ্বারা। ফলে প্রায়ই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে যথার্থ সত্যের-তথ্যের প্রতিফলন ঘটছে না। এতে চরম বিঘœ ঘটে থাকে ন্যায়বিচারে আর বিচারবঞ্চিত থেকে যায় ভিকটিম ও পরিবার। একটি পূর্ণ এবং বিতর্কিত ময়নাতদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধান বিচারপতি স্বয়ং। ২০১৫ সালের ৩ জুন ফরিদপুর জেলা জজ আদালতের একটি অনুষ্ঠানে মামলার ক্ষেত্রে ময়নাতদন্তের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগই ত্রুটিপূর্ণ। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি একটি সমস্যা।’ দেশের প্রধান বিচারপতি স্বয়ং যখন এই কথা বলেন, তখন আশঙ্কা জাগে বৈকি! প্রায় শতভাগ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন যদি ভুল বা ভুয়া বিবেচিত হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ তথা বিচারপ্রার্থীর আস্থার জায়গাটা থাকে কোথায়? অথচ এর ওপরই এক বা একাধিক ব্যক্তির শাস্তি অথবা ক্ষমার বিষয়টি জড়িত ওতপ্রোতভাবে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে এ নিয়ে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে উঠে এসেছে সাপ। এ বিষয়ে বলতে গিয়ে দেশের একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ বলেন, বর্তমানে যে বা যারা ময়নাতদন্ত করেন, তাদের ৯০ ভাগেরই এই বিষয়ে কোন ডিগ্রী, ডিপ্লোমা এমনকি প্রশিক্ষণ পর্যন্ত নেই। বরং অধিকাংশ ময়নাতদন্ত ডোমনির্ভর। হাতেগোনা কয়েকজন ফরেনসিক ও জুরিসপ্রুডেন্স বিশেষজ্ঞ থাকলেও ধোপদুরস্ত বিধায় স্ট্যাটাস বজায় রাখতে গিয়ে তারাও পারতপক্ষে শব ব্যবচ্ছেদ করতে চান না। বরং অনেকক্ষেত্রেই হয়ে পড়েন ডোমের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে দেশের ৩০টি জেলায় মেডিক্যাল কলেজ আছে। সেসব স্থানে ফরেনসিক বিভাগ থাকলেও ময়নাতদন্তের কাজ হয় না। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সিভিল সার্জনরা ময়নাতদন্তের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও ব্যস্ততার কারণে এই দায়িত্ব গিয়ে পড়ে মেডিক্যাল অফিসারের ওপর। সেক্ষেত্রে সিভিল সার্জনের লিখিত আদেশের ভিত্তিতেই চলে ময়নাতদন্তের কাজ। এভাবেই চলে আসছে দীর্ঘদিন। যা চলতে দেয়া যায় না কোন অবস্থাতেই। সমস্যা আছে অন্যত্রও। আজকাল মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সহজে কেউ ফরেনসিক, জুরিসপ্রুডেন্স পড়তে চায় না। বরং প্রায় সবাই ঝুঁকে পড়ে সার্জারি, হৃদরোগ, কিডনি অথবা অন্য কোন অর্থকরী বিষয়ের দিকে, রোজগার বাড়ানোর জন্য। মানবিক আইনের বিজ্ঞান, দর্শন-চিকিৎসা-বিদ্যা সহজে কেউ পড়তে চায় না। পোস্টমর্টেম বা সব ব্যবচ্ছেদে তাদের তীব্র বিরাগ ও অনীহার ফলে চিকিৎসক সঙ্কট চলছেই। ময়নাতদন্তের সঙ্গে প্রায় সরাসরি সম্পৃক্ত স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য ও আইন মন্ত্রণালয়। দেশে এই তিনের মধ্যে আদৌ কোন সমন্বয় নেই। বিলেতে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রীধারীরা মরচুয়ারি এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ডোমের কাজ করে থাকেন। আর বাংলাদেশে ময়নাতদন্তের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলেও কাজটি করে থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত ডাক্তার অথবা তাদের পক্ষে ডোম সম্প্রদায়ের লোকজন। এই দুরবস্থার অবসানে সংশ্লিষ্ট তিন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যথাযথ সমন্বয়সহ ফরেনসিক মেডিসিন ও জুরিসপ্রুডেন্সে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। তদুপরি আদিকালের আইন সংস্কারসহ প্রচলিত ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
×