ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মীম নোশিন নাওয়াল খান

উপলব্ধি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৩ মে ২০১৭

উপলব্ধি

মা মুরগিটা উঠানে ছানাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তার পাঁচটা ছানা। কয়েকদিন আগেই ডিম ফুটে ছানাগুলো বেরিয়েছে। এখন মা মুরগি সারাদিন তাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ছানারা অবশ্য একটু বড় হয়েছে। এখন তারা একটু একটু করে নিজেরাই নিজেদের খাবার জোগাড় করতে পারে। আর কয়েকদিন পর পুরোপুরি খাবার জোগাড় করতে শিখে গেলে মা মুরগির দুশ্চিন্তা থাকবে না আর। অবশ্য দুশ্চিন্তা তার এমনিই নেই। সে যেই বাড়িতে থাকে, সেই বাড়ির মানুষগুলো খুব ভাল। সকাল-বিকেল দুইবেলা খেতে দেয়। উঠানে একটা মাটির পাত্রে খুদ দেয়। মা মুরগি সেটা ঠোঁট দিয়ে ঠুকে ঠুকে খায়। তবে তার ছানাগুলো এখনও শক্ত খুদ খেতে পারে না। মাকে তাই বাগানে ঘুরে ঘুরে ছোট ছোট পোকামাকড় জোগাড় করতে হয় তাদের জন্য। নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ বাড়ির ছোট মেয়েটা পেছন থেকে এসে মা মুরগি আর তার ছানাদের তাড়া করতে শুরু করল। মা মুরগিটা ছানাদের নিয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করল। এই মেয়েটার নাম রিনি। খুব দুষ্টু একটা মেয়ে। সারাদিন মুরগি আর তার ছানাদের পেছনে লেগে থাকে। সে তাড়া করলে মা মুরগি ছানাদের নিয়ে দৌড়াতে থাকে। এটা তার খুব প্রিয় খেলা। অবশ্য এখন সে খেলাটা বেশিক্ষণ খেলতে পারল না। তার বাবা ডাকতে শুরু করলেন। বাবা হাটে গিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই রিনির জন্য অনেককিছু নিয়ে এসেছেন। রিনি দৌড়ে বাবার কাছে গেল। বাবা দুই হাতের ব্যাগগুলো তার হাতে দিয়ে বললেন, দ্যাখ কাকে নিয়ে এসেছি! রিনি বাবার পেছনদিকে তাকাল। মাস্টারমশাই! মাস্টারমশাই হচ্ছেন এই গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষ। উনি মূলত গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার। সবাই মাস্টারমশাই বলেই ডাকে। গ্রামে সবাই তাকে খুব শ্রদ্ধা করে। মাস্টারমশাই বাড়িতে চলে এসেছেন? রিনি একটু ভয় পেয়ে গেল। বরাবরই সে পড়াশোনায় একটু ফাঁকিবাজ। মাস্টারমশাই কি তার ব্যাপারে নালিশ করতে এসেছেন? মাস্টারমশাই অবশ্য রিনির ভয় দূর করে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস মা? রিনি মাথা নেড়ে বলল, জ্বি স্যার, ভাল আছি। তারপর সে এক দৌড়ে ব্যাগগুলো নিয়ে ঘরে চলে গেল। মাকে মাস্টারমশাই আসার খবরটা দিতেই মা হন্তদন্ত হয়ে বললেন, সে কী! মাস্টারমশাই এসেছেন? দুপুর তো হয়ে এল। তাকে তো দুপুরে না খাইয়ে ছাড়া যাবে না। বাবা ঘরে ঢুকলেন। বললেন, হ্যাঁ। আমি তাকে আমাদের সঙ্গে দুপুরে খেতে বলেছি। মা চিন্তিত ভঙ্গিতে বাজারের ব্যাগগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো মাছ-মাংস কিছু আনোনি। ছোট মাছ কীভাবে মাস্টারমশাইয়ের পাতে দেব? বাবা মাথা নিচু করলেন। সত্যিই তো, মাস্টারমশাইকে কীভাবে ছোট মাছ দেয়া যাবে? কিন্তু রিনির বাবার উপার্জন খুব বেশি না। এই উপার্জনে স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলের পরিবারের প্রতি দিনের খাবার জোটানোই কষ্ট। মাছ-মাংসের কথা ভাবা তো তাদের জন্য বিলাসিতা! কিছুক্ষণের জন্য বাবা-মা দুজনই চুপ করে রইলেন। তারপর বাবা মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। উঠানে আসতেই তার চোখে পড়ল মা মুরগি আর তার ছানাগুলোকে। মনের আনন্দে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিটা মাথায় এসে গেল তার। ঘরে ঢুকে রিনির মাকে বললেন, আমাদের মুরগিটাকে রান্না করলে কেমন হয়? মাস্টারমশাইকে তো মাংস ছাড়া খাওয়ানো যাবে না। রিনির মা এক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ! এটা ভাল কথা বলেছ। মা উঠানে গিয়ে মাটির পাত্রে খুদ দিয়ে মুখে শব্দ করে মা মুরগিকে ডাকলেন। মা মুরগি তার দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হলো। কী ব্যাপার? এখন তো খাওয়ার সময় না। এখন খেতে ডাকছে কেন? অবশ্য সে আর বেশি কিছু ভাবল না। এই বাড়ির মানুষগুলো খুব ভাল। তারা বোধহয় এখন থেকে তিনবেলাই খেতে দেবে। মা মুরগি তার ছানাদের নিয়ে খাবারের পাত্রের কাছে এলো। ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই রিনির মা খপ করে তাকে ধরে ফেললেন। মা মুরগি বেশ অবাক হলো। এই মানুষটা তো তাকে কখনও এভাবে ধরে না? কী হলো তাহলে? ওদিকে তার ছানারা চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। মা মুরগি তাদের বুঝিয়ে শান্ত করল- এই মানুষটা খুব ভাল। সে নিশ্চয়ই কোন প্রয়োজনে তাকে ধরেছে। আবার সময় হলেই ছেড়ে দেবে। বাবা বঁটি নিয়ে উঠানের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। মা তার কাছে গিয়ে মুরগিটাকে তার হাতে তুলে দিলেন। ঠিক এই সময়ে হাঁপাতে হাঁপাতে রিনি দৌড়ে এলো। তাকে দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে রিনি? কোত্থেকে এলে? হাঁপাও কেন? সে উত্তর দিল না। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। মা এবার চিন্তিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে, বলো? রিনি মায়ের আঁচলে মুখ গুঁজে বলল, তুমি কখনও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো মা? মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, এটা কেমন কথা? আমি কোথায় যাব? এটা কেন বলছ? রিনি কাঁদতে কাঁদতেই বলল, পাশের বাসার সামিনার মা খুব অসুস্থ, জানো মা? আমি মাত্র দেখে এলাম। ওরা সবাই বলছে, উনি নাকি বাঁচবেন না। সামিনা খুব কাঁদছে। রিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। মা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, না মা, আমি তোমাকে রেখে কোত্থাও যাব না। বাবা বললেন, আচ্ছা, খুব হয়েছে। এত দুশ্চিন্তা কর না তো। এসো, মুরগিটাকে জবাই করতে হবে তো! মা একবার উঠানের দিকে তাকালেন। মুরগির ছানাগুলো পাগলের মতো চিঁ চিঁ করছে আর মায়ের কাছে যেতে চাইছে। এরপর তিনি মা মুরগিটার দিকে তাকালেন। সেও তার ছানাদের কিছু একটা বলছে। রিনির মা মুরগিটাকে বাবার হাত থেকে নিয়ে উঠানে ছেড়ে দিলেন। সে দৌড়ে তার ছানাদের কাছে চলে গেল। তাকে পেয়ে ছানারা সবাই ঘিরে ধরল। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, মুরগিটাকে ছেড়ে দিলে কেন? মা কান্নাভেজা গলায় উত্তর দিলেন, কোন মাকে তার সন্তানের কাছ থেকে আলাদা করে দেয়া যায়, বলো? আমিও তো মা। আমি কীভাবে আরেক মাকে তার সন্তানের কাছ থেকে আলাদা করে দেব? মাস্টারমশাই না হয় আজ ছোট মাছের তরকারি দিয়েই ভাত খাবেন, কিন্তু আমি কোন মাকে তার সন্তানের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারব না। রিনিকে আরও শক্ত করে বুকে চেপে ধরলেন মা। রিনিও উপলব্ধি করতে পেরেছে মা মুরগির তার ছানার প্রতি ভালবাসা।
×