ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাড়ি আর বাঙালী নারী- লেগেছে বিবর্তনের ছোঁয়া

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৩ মে ২০১৭

শাড়ি আর বাঙালী নারী- লেগেছে বিবর্তনের ছোঁয়া

পোশাকের প্রধান কাজ ক্ষতিকর বস্তুর হাত থেকে শরীরকে সুরক্ষা দেয়া, যেমন প্রখর সূর্যতাপ, শীতল বায়ু, বৃষ্টির পানি প্রভৃতি যে সবের মাত্রাতিরিক্ত সংস্পর্শ মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া পোকা-মাকড় বা অন্যান্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে প্রাথমিকভাবে শরীরকে রক্ষা করাও পোশাক ব্যবহারের অন্যতম প্রধান কারণ। মানব সভ্যতার আদিতে আমাদের পূর্বপুরুষেরা গাছের লতা-পাতা, ছাল-বাকল, পশু-পাখির চামড়া-পালক প্রভৃতি দিয়ে পোশাকের কাজ চালাত। মূলত অঞ্চলভেদে আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর নির্ভর করে পোশাকের ধরণ। পোশাক তৈরির উপাদান হিসেবে ওই অঞ্চলে প্রাপ্য ও সহজলভ্য বস্তুর ওপরই নির্ভরশীল ছিল আদিম মানুষ। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পোশাকের ক্ষেত্রেও বিবর্তন ও আধুনিকায়ন চোখে পড়ে। পোশাক ব্যবহারের মৌলিক কারণগুলো ছাড়াও ঐচ্ছিক কিছু কারণও যুক্ত হয়, যেমন সৌন্দর্য বর্ধন, যৌনাঙ্গ ঢেকে রাখা ইত্যাদি। এ ধারাবাহিকতায় সকল বিবেচনায় পোশাক হিসেবে শাড়িকেই বেছে নিয়েছে বাঙালী নারী। ‘কন্যা ভাবিয়া করিস কী, কন্যা চিন্তা করিস কী, এবার পাটা ব্যাচেয়া আনিয়া দেইম তোকে ফুল তোলা শাড়ি’ প্রয়াত শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের এ ভাওয়াইয়া গানটি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় সে সময় গ্রামীণ নারীদের কাছে শাড়ি কতটা আকর্ষণীয় ছিল। শাড়ি কেবল নদী-বিধৌত এই ব-দ্বীপের নারীদের পোশাকই নয়, উপমহাদেশের অনেক অঞ্চলে হাজার হাজার বছর ধরে ১২ হাত লম্বা এই পোশাকটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু বাঙালী নারীর মতো এতটা আপন করে আর কেউ শাড়িকে গ্রহণ করতে পারেনি। বাঙালী নারীর পোশাক বলতে চোখ বন্ধ করলে প্রথমেই কল্পনায় যে ছবি ভেসে ওঠে তা হচ্ছে ‘শাড়ি পরিহিতা বাঙালী নারী!’ বাঙালী নারীর পোশাকের ইতিহাস মূলত শাড়ির ইতিহাস! দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায়, শাড়িতে লেগেছে বিবর্তনের ছোঁয়া। একগিট, এক কুঁচি থেকে কয়েক কুঁচি; যুগে যুগে পরিবর্তন এসেছে বাঙালী নারীর শাড়ি পরার ধরণে। অন্যান্য সংস্কৃতির প্রভাবে আধুনিক বাঙালী নারীর পোশাক হিসেবে শাড়ির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্লাউজ, পেটিকোট প্রভৃতি। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের মুঘল শাসন, পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসন; নানাবিধ সংস্কৃতির প্রভাব সত্ত্বেও শাড়ি টিকে গেছে বাঙালী নারীর প্রধানতম পোশাক হিসেবে। বাঙালী নারীর জন্য শাড়ি মানেই হচ্ছে এক সৌন্দর্যের ব্যাকরণ। বাঙালী নারী আর শাড়ি, একই মুদ্রার এ-পিঠ আর ও-পিঠ। একটা সময় ছিল যখন বিবাহিত নারী মাত্রই শাড়ি পরত। শাড়ি ছাড়া বাড়ির বউ যেন একেবারে বেমানান, কোন কোন পরিবারে অগ্রহণযোগ্য। তখন গ্রাম বা শহরের কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা শাড়ি পরেই কলেজে যেত। আর শিক্ষিকাদের তো শাড়ি ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষের জীবনাচরণে পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে রুচিতে। গত কয়েক বছরে শহুরে মেয়েদের ওয়ারড্রবে সালোয়ার-কামিজ, জিন্স-টপস, বোরকা-হিজাব, টিশার্ট ঢুকে পড়েছে। কমে যাচ্ছে শাড়ির ব্যবহার। বিশেষ অনুষ্ঠানাদি ছাড়া শহরের মেয়েরা কমই শাড়ি পরে। গ্রামীণ বা আধা-শহুরে সমাজেও এর ঢেউ লেগেছে। গ্রামীণ কর্মজীবী মেয়েরাও এখন আটপৌরে শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার-কামিজ বা ম্যাক্সি পরা শুরু করেছে। গল্পে উপন্যাসে আমরা ডুরেপাড় শাড়ি পরা যে গ্রামের চঞ্চলা দুরন্ত কিশোরীর কথা জেনেছি তাদের আর দেখা যায় না। তারা এখন শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার কামিজ ধরেছে। কাউনিয়া উপজেলার মীরবাগ ডিগ্রী কলেজ মাঠে খড় শুকানোর কাজ করছিলেন গৃহবধূ আমিনা ও তার কয়েক সঙ্গী। তাদের সকলের পরনে ম্যাক্সি। জিগ্যেস করলাম, আপনারা কি নিয়মিত ম্যাক্সি পরেন? জবাব এলো, না। সালোয়ার কামিজ পরি, মাঝে মাঝে শাড়িও পরি। আগে সব সময় শাড়ি পরতাম, এখন পরি না। বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া গ্রামের মেয়েদের শাড়ি পরার অভ্যাস এখন কমেছে। তারা জানালেন, শাড়ির চেয়ে কম খরচে সালোয়ার কামিজ পাওয়া যায়। পরতে আরাম। তাছাড়া শাড়ি সামলাতে অনেক ঝামেলা। আমাদের দিনভর কাজ করতে হয়। শাড়ি পরে কাজ করতে তেমন সুবিধা হয় না। তাই কাজের সময় শাড়ি পরা হয় না। রংপুরের ম্যানস্টাইল টেইলার্সের মালিক শহীদুল ইসলাম খোকন বলেন, গ্রামের মেয়েরা এখন সালোয়ার কামিজ বেশি পরছে। এর বড় কারণ, গণমাধ্যম। বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া। তারা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে, বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে যেসব নাটক সিনেমা দেখছে সেসব থেকে ওই ধরনের পোশাকের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আমরা এ বিষয়টি বেশ বুঝতে পারি। কারণ তারা যখন কাপড় কাটাতে আসে তখন তারা পছন্দের সিরিয়ালের অভিনেত্রীদের পোশাকের ডিজাইন অনুযায়ী অর্ডার দেয়। তবে এ বিয়য়ে এক পোশাক ব্যবসায়ী বললেন ভিন্ন কথা। তিনি জানালেন, অনেকে ধর্মীয় কারণেও শাড়ি ত্যাগ করেছে। শাড়িতে নাকি শরীরের বিভিন্ন অংশ দেখা যায়। নব্বইয়ের পর থেকে এক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী পরিকল্পিতভাবে নারীদের শাড়ি পরা নিয়ে আপত্তি করে আসছে। ওয়াজ-মাহফিল, তাবলীগ-বয়ানের মাধ্যমে প্রথমে ‘হিদুয়ানি পোশাক’ বলে শাড়িকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এরপর নারীদের অন্যান্য পোশাকেরও সমালোচনা করে বোরকা-হিজাব পরতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে শহরে বা আধা-শহুরে সমাজে বোরকা-হিজাব পরিহিতা নারীর সংখ্যা বাড়ছে। সচেতনভাবেই সংস্কৃতির পরিবর্তে ধর্মীয় পোশাকের নামে বোরকা-হিজাব পরিয়ে নারীকে ফের পৃথক করার ষড়যন্ত্র চলছে। বোঝানোর চেষ্টা চলছে, ওরা মানুষ নয় নারী। Ñআবদুর রউফ সরকার, রংপুর থেকে
×