ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পোশাকের পালাবদল ॥ গ্রামীণ জনপদেও যুগের হাওয়া

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৩ মে ২০১৭

পোশাকের পালাবদল ॥ গ্রামীণ জনপদেও যুগের হাওয়া

গাঁয়ের মেয়েদের আটপৌরে শাড়ি পরার ধরণ পাল্টেছে। গ্রামীণ জীবনে পোশাকের আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সত্তরের দশকের শেষ ভাগেও যা ভাবা যায়নি, আজ তা বাস্তব। কোনটি শহর বা নগরীর পোশাক আর কোনটি গ্রামের, পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা এতই সূক্ষ্ম যে দূরবীন লাগিয়ে দেখতে হয়। গ্রামীণ উন্নত সড়কে শহর নগরের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ, কৃষি উৎপাদন বেড়ে জীবনমান উন্নয়ন এবং মাঠ পর্যায়ের আকাশ সংস্কৃতির বিস্তৃতি গ্রামীণ নারীর পোশাকে দ্রুত পালাবদল ঘটেছে। পোশাকও স্যাটেলাইট হয়ে একেবারে বায়োস্কোপের বাক্সে ঢুকে পড়েছে। একটা সময় টেলিভিশনকে বায়োস্কোপের বাক্স বলা হয়েছে। বাহারি যে পোশাক মুম্বাইয়ের ফিল্ম আর্টিস্টরা পরে অভিনয় ও নৃত্যগীত করে এই ড্রেসের নক্সা এখন আর শুধু নগরীতে নয় গ্রামেও পৌঁছে গেছে। কারণ স্যাটেলাইট কেবল লাইন এখন গ্রামেও পৌঁছেছে। গ্রামের মানুষও এখন টিভি চ্যানেলে দেশী-বিদেশী অনুষ্ঠান, সিরিয়াল, রিয়েলিটি শো, সিনেমা দেখে। এসব পোশাকের পছন্দ শহর নগরে গিয়ে একের দেখাদেখি অন্যের পাশাপাশি স্যাটেলাইট টিভি সহজ করে দেয়। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ের টেইলার্সে পোশাকের ডিজাইন বুক থাকে। একটা সময় গ্রামের মেয়েরা জিনস পরবে তা কল্পনাতেও আসেনি। বিয়ের আগে ফ্রক, কামিজ ঢিলেঢালা পায়জামাÑএই ছিল তরুণীদের প্রধান পোশাক। অতিরিক্ত ঢিলেঢালা বিশেষ ধরনের পায়জামার নাম ছিল গাড়াড়া। স্কুল ও কলেজের মেয়েরা কামিজের সঙ্গে এই গাড়াড়া পরত। ওড়না দিয়ে মাথাও ঢাকা থাকত। কামিজ বা ফ্রকের হাতা যতটা বড় করা যায়, তা করতে হয়েছে। এর বাইরে আর কোন পোশাকের কথা ভাবা হয়নি। বাড়িতে ঘটকের আনাগোনায় বিয়ের কথাবার্তা শুরু হলেই শাড়ি পরার অভিষেক হয়ে গেছে। মেয়েদের বয়স ১৩-১৪ বছর হলেই বলা হতো ‘সেয়ানা’ হয়েছে। তখন আর কামিজ ফ্রক পরা চলবে না। কিশোরীদের কামিজ পরতে দেয়া হতো না। আবার বয়স যাই হোক মেয়ে লম্বা হলে শাড়ি পরতে হতো। গার্জিয়ানদের অভিমত ছিল বড় মেয়েদের কামিজ পায়জামা পরা হবে না। মেয়ে বড় হলো কী গতরে উঠলো শাড়ি। গ্রামীণ নারীর পোশাকের পালাবদল একটু করে শুরু হয় মূলত আশির দশকের মাঝামাঝি। গ্রামীণ সড়ক উন্নত হওয়া শুরু হলে শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়তে থাকে। নানা কাজে শহর-নগরীতে গ্রামের মেয়েদের যাওয়া আসা শুরু হয়। শহর-নগর থেকে রকেটের গতিতে গ্রামে পৌঁছতে থাকে। একটা সময় প্রাথমিক পাঠের পর হাই স্কুলে মেয়েদের ভর্তির হার কম ছিল। ঝরে পড়ার হার ছিল বেশি। নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগ থেকে গ্রামের মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়তে থাকে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার অনেক নিচে নেমে আসে। শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে নিজেদের পছন্দের পোশাক পরার দিন শুরু হতে থাকে। শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে শহর নগরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা যত উন্নত হয় গ্রামীণ নারীর মানসিক পরিবর্তন দ্রুত হয়। মনের এই পরিবর্তনে সরাসরি সহযোগী হয়ে আসে আধুনিক পোশাক। মানুষের মনের বিকাশ ও আধুনিকায়নে পোশাক যে কত বড় ভূমিকা রাখে তার প্রমাণ দিচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামীণ নারী। নব্বই দশকের শেষের দিক হতেই গ্রামে নারীর পোশাকের পরিবর্তন হতে থাকে। কৃষক ঘরের মেয়েদের পরনে ওঠে আধুনিক পোশাক। অগ্রযাত্রার এই ধারায় গত ৭-৮ বছর ধরে জ্যামিতিক হারে গ্রামের নারীর পোশাক আধুনিকায়ন হয়েছে। কিশোরী তরুণীরা পরছে জিনসের প্যান্ট। একটা সময় কোন অভিভাবক কল্পনা করেনি যে, মেয়েরা ফুলপ্যান্ট পরবে। সেখানে আধুনিকতার শিখরে উঠে মেয়েরা জিনস তো পরছেই টি-শার্টও গায়ে চরিয়েছে। গ্রামে কেবল লাইন যাওয়ার পর বিদেশী চ্যানেলে প্রচারিত নানা অনুষ্ঠানে সেলিব্রেটিদের ড্রেস দেখে অবিকল পোশাক বানানো শুরু হয়েছে। শহর-নগর-বন্দরের দর্জিবাড়ির কাটার মাস্টারের বিপদ গেছে বেড়ে। তাদেরও সংগ্রহ করতে হয় পোশাকের ডিজাইন। ঈদের সময় শহরাঞ্চলে যেমন মুম্বাই তারকা ও সিনেমার নামে যে পোশাক আসে গ্রামে পৌঁছতে তা সময় লাগে না। গ্রামের নারী নিজের ঘরে এ ধরণের দেখে বায়না ধরে- হয় নগরীতে গিয়ে শোরুম থেকে কিনবে, না হয় কাপড় কিনে ডিজাইন দেখিয়ে দিয়ে বানিয়ে নেবে। এসব কথা শুনে ভাবা যায়, গ্রামে সত্যিই পোশাকে বিপ্লব এসেছে ! এবার একটি দৃশ্যপট-গ্রামের পাকা সড়ক দিয়ে ব্যাটারি চালিত ইজি বাইকে করে কলেজে যাচ্ছে কয়েক তরুণী। তাদের পরনে আধুনিক সালোয়ার কামিজ। কেউ পরেছে জিনসের প্যান্টের ওপর কামিজ। শুধু পোশাকে নয় চলনে বলনে হেভি স্মার্ট। টুকটাক ইংরেজী শব্দের পাশাপাশি একটু-আধটু হিন্দী বলে। বোঝা গেল স্যাটেলাইট টিভির প্রভাব গ্রামেও পড়েছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো : নিকট অতীতে গ্রামের মেয়েরা এ ধরণের পোশাক পরলে মুরব্বি-মাতবরদের হুঙ্কারে টেকাই কঠিন হয়ে যেত। খড়গ নেমে আসত পরিবারের ওপর। বর্তমানে এতটাই পরিবর্তন যে মাতবর প্রভাবশালী মুরব্বির বাড়ির মেয়েরাও আধুনিক পোশাক জিনস-টি-শার্ট পরছে। বর্তমানে গ্রামের গেরস্ত ঘরের বধূও আটপৌরে শাড়ি পরে না। আটপৌরে শাড়ি অর্থ- দিন ও রাতের ২৪ ঘণ্টায় আট প্রহরে যে নারী এক কাপড় পরে তাকে বলে আটপৌরে। একটা সময় গ্রামের নারী শাড়ি পরে কোন রকমে কোমর পেঁচিয়ে ঘর-গেরস্থালির তাবত কাজ করেছে। বেড়াতে যেতেও শাড়ি পরাতে কোন আর্ট ছিল না। ঘোমটা দেখেই বোঝা যেত গ্রামের নারী। বর্তমানে গাঁয়ের বধূরাও আঁচল ছেড়ে শাড়ি কুচি দিয়ে পরে। শহুরে শিক্ষিত অনেক বধূর মতো গাঁয়ের অনেক বধূ কামিজ-পায়জামা পরে। গ্রামীণ নারীর চিরন্তন পরিচিতি ছিল বেণী করা চুল। তাও আর থাকছে না। বেণী এখন খুব কম দেখা যায়। বিউটি পারলার এখন মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। পোশাকের ফ্যাশনের সঙ্গে চুলের ফ্যাশন শুরু হয়েছে। পোশাক গ্রামের নারীর মনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×