ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসবিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন জরুরী

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৩ মে ২০১৭

গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ  ইতিহাসবিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন জরুরী

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেক ব্যথা, বেদনা, সংগ্রাম ও গৌরবের ইতিহাস, অশ্রু ও রক্তের ইতিহাস। মহান ত্যাগ ও মহৎ অর্জনের ইতিহাস। কোন ব্যক্তির একটা হুইসেলে নয়, এটি ১৯৪৯ সালের স্বাধিকার আন্দোলন, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬’র ছয় দফা, ’৬৯-এর উত্তাল গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য নেতৃত্বের ফসল। ’৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে বাংলার মাটিতে ভয়াবহ ও নৃশংস গণহত্যাটি শুরু করে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে ওরা বাঙালী জাতিসত্তাকে হত্যার নিষ্ঠুর যজ্ঞে মেতে উঠেছিল। হায়েনার দল ২৫ মার্চ রাতে অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর- রাজধানী ঢাকায় প্রথম হামলা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের ওপর, পুলিশ ও ইপিআরের সদর দফতরে। আগুন ধরিয়ে দেয় বাজার ও বস্তিতে, আতঙ্কে হাজার হাজার নারী, পুরুষ, শিশু ঘর থেকে বের হলে তাদের ওপর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে একটানা, যতক্ষণ না প্রতিটা মানুষ মারা না যায়। বাংলার অগণিত প্রাণ সেদিন ভেসে গিয়েছিল রক্ত গঙ্গায়। ওই রাতেই ওরা গ্রেফতার করে স্বাধীনতার মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, তছনছ করে বঙ্গবন্ধুর ধানম-ির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়ি। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ÒThis may be my last message from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.” এ প্রসঙ্গে সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বই থেকে অনূদিত একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে চাই, “দোজখের দরজাগুলো একবারেই খুলে দেয়া হলো। যখন বন্দুকের প্রথম গুলিটি ছোঁড়া হলো, শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর পাকিস্তানের সরকারী রেডিওর কাছাকাছি তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যে ভেসে এলো। এটা নিশ্চয় যা হবে এবং সে মতো জানান দিল, শেখ সাহেব পূর্ব পাকিস্তানকে ঘোষণা করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে।’ (পৃষ্ঠা ৭৫) ’৭১-এর ২৯ মার্চ সিডনির মর্নিং হেরাল্ড লিখেছে, ‘ঢাকার মাটিতে ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তান বাহিনী ১ লাখ বাঙালীকে হত্যা করেছে।’ মাত্র ৯ মাসে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রতিদিন গড়ে ৯ থেকে ১২ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। ২০ মে ৭১, চুকনগরে একদিনে হত্যা করা হয় ১০ হাজার মানুষকে। ৮১ সালের ডিসেম্বরে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩৩তম বার্ষিকী উপলক্ষে জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়- বিশ্বের ইতিহাসে যে সমস্ত গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তি নিহত হয়েছে বাংলাদেশে ’৭১ সালের গণহত্যায়। বলা হয়েছে ’This is the highest daily average in the history of Genocides” আর্মেনিয়াতে গণহত্যা হয়েছে ৬ বছরে ১৫ লাখ, ভিয়েতনামে ২০ বছরে ৩৬ লাখ আর বাংলাদেশে মাত্র ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। ’৭১-এর অক্টোবরে সিআইএ মার্কিন সিনেটকে অবহিত করেছিল ‘ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানে ২৫ লাখ বাঙালীকে হত্যা করেছে।’ মার্কিন সিনেটের এ্যাডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন ’৭১ সালে। তিনি পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যার অভিযোগ আনয়ন করেন। ‘গিনিস বুক অব ওয়ার্ল্ডস রেকর্ডস’ এই গণহত্যাকে বিশ শতকের ৫টি ভয়ঙ্কর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে, ‘নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ’ এর অবমুক্তকরণ দলিলে এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞকে ‘ঝবষবপঃরাব মবহড়পরফব’ বা ‘এবহড়পরফব’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। স্যামুয়েল টটেন সম্পাদিত ‘সেঞ্চুরী অব জেনোসাইড’ গ্রন্থে বাংলাদেশের গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ বলা হয়েছে। এনসাইক্লোপেডিয়া আমেরিকানা, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকেও ৩০ লাখ বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় টাইম ম্যাগাজিন মন্তব্য করেছিল, “It is the most incredible, calculated thing since the days of the Nazis in Poland” সে সময় ঢাকায় অবস্থানরত ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং বলেছেন, ‘২৫মার্চ গণহত্যার যে চিত্র আমি ঢাকায় প্রত্যক্ষ করেছি এবং পরবর্তী ৯মাসে সমগ্র বাংলাদেশে যা অব্যাহত ছিল তার ভিত্তিতে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ হতে পারে।’ ১৩ জুন ’৭১-এ এই নিষ্ঠুর গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তানী সাংবাদিক এ্যান্থনি মাসকারেনহাসের একটি প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেদন বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দেয় যা লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই গণহত্যা বন্ধ করার লক্ষ্যে জর্জ হ্যারিসন ও পন্ডিত রবি শংকর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেন। জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ধ্বনি এখনও আমাদের শিহরণ জাগায়। শাহরিয়ার কবিরের ডকুমেন্টারি ‘জার্নি টু জাস্টিস’ এ বিশ্বের খ্যাতনামা গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ও আইন প্রণেতাগণ এই গণহত্যা সম্পর্কে মর্মস্পর্শী ও হৃদয় বিদারক বর্ণনা দিয়েছেন, যা দেখলে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটে, এদের মধ্যে উইলিয়াম স্লোগান, গিতা সেগাল, ফেডরিখ মাল্ম, বিধুকুমারী দেবি ও আরও অনেকে রয়েছেন। এমনকি খোদ পাকিস্তানের সীমা কার্মানী, সৈয়দ হায়দার ফারুখ মাহমুদী (জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুুদির পুত্র), আহমদ সালিম, তাহিরা আব্দুল্লাহ এই নৃশংস গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছেন, বিচার চেয়েছেন। এটি ছিল পরিকল্পিত গণহত্যা। পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ডায়েরীতে লিখেছিল, চধরহঃ ঃযব মৎববহ ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ জবফ” প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিল, “করষষ ঃযৎবব সরষষরড়হ ড়ভ ঃযবস ধহফ ঃযব ৎবংঃ রিষষ বধঃ ড়ঁঃ ড়ভ ড়ঁৎ যধহফং” মহান মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানীদের নিষ্ঠুরতার চিত্র বিশ্বের প্রায় সকল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। ৫ এপ্রিল- ১৯৭১ এ নিউজ উইকে প্রকাশিত একটি সংবাদে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য ছাপা হয়েছিল, ‘শেখ মুজিব ও তার দল পাকিস্তানের শত্রু, বিনা শাস্তিতে এদের রেহাই দেয়া হবে না’ -প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। শেষ শত্রু সৈন্য নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত যে কোন মূল্যে শত্রুদেরকে মোকাবিলা কর এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিষ্ঠুর স্বৈরশাসনের কবল থেকে দেশকে বাঁচাও”- শেখ মুজিবুর রহমান। (সূত্র: বাংলাদেশ জেনোসাইড এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, মূল সংগ্রহ ও সম্পাদনা: ফজলুল কাদের কাদেরী, বাংলা অনুবাদ সম্পাদনা : দাউদ হোসেন, পৃষ্ঠা: ৩৪) আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধটি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল, প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। অস্ত্র হাতে বীর বাঙালী সেদিন পরাজিত করেছিল বর্বর পাকিস্তানীদের, ওরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ভুট্টো-ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের মিয়ানওয়াল কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রেখেছিল। কারাগারের ভেতর কবর খুঁড়েছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “যে মানুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, কেউ তাকে মারতে পারেনা।” মৃত্যুর মুখে এমন প্রত্যয় যিনি ব্যক্ত করতে পারেন তিনি আমাদের জাতির পিতা, বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতা এনে দেবার জন্য তাঁর জীবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছিলেন। চলবে... লেখক : সংসদ সদস্য
×