ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইরাকে আইএসের নৃশংসতার পর

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৩ মে ২০১৭

ইরাকে আইএসের নৃশংসতার পর

গ্রীষ্মের পড়ন্ত এক বিকেল। চরম তাপপ্রবাহে মসুলের মাটি ও আকাশ একাকার। সময়টা ইরাকের সবচেয়ে শুষ্ক মৌসুম। কিন্তু এমন বৈরী পরিবেশে এতটুকু বিশ্রাম ও অবকাশের সুযোগ নেই মসুলবাসীর। চারদিকে কেবল উত্তেজনা ও আতঙ্ক। টাইগ্রিস নদীর তীরবর্তী পাহাড়ে সতর্ক পাহারায় কুর্দির পেশমারগার সদস্যরা। পাহাড়ের এ অংশ হতেই আইএসের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণের প্রস্তুতি। অন্য প্রান্তে জড়ো হয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকার সম্মিলিত বাহিনী। ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে আন্তর্জাতিক বাহিনীর এটা সবচেয়ে বড় মহড়া। ফালুজার পর তারা সকলে এখন সুন্নি অধ্যুষিত এ অঞ্চলটি আইএস মুক্ত করতে চান। মসুল ইরাকে আইএসের সর্বশেষ ঘাঁটি। ফালুজা, রামাদি শহর হারিয়ে আইএস জঙ্গী গোষ্ঠীর অবশিষ্ট সদস্য এখানেই আশ্রয় নিয়েছে। মসুল শহরের ভিতরের পরিস্থিতি আরও নাজুক। আইএস মসুল দখলের পর দশ লাখ অধিবাসী শহর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। অবশিষ্টদের বাস করতে হয় চরম আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায়। প্রায় প্রতি রাতে টাইগ্রিস নদীর কিনার ঘেঁষা পাহাড়ের পথে শহর থেকে পালিয়ে আসে অবরুদ্ধ মসুলবাসী। তাদের সহায়-সম্বল কেবল কিছু কাপড় ও খাদ্য। পালিয়ে আসা মসুলের অধিবাসীদের সতর্কভাবে পথ বাতলে দেন কুর্দি এক কমান্ডার। যদিও ভাষাগত বিড়ম্বনার কারণে দোভাষীর মাধ্যমেই তিনি মসুলবাসীকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। প্রতিরাতেই নতুন দল আসার আগাম খবর পান এ কমান্ডার। সে অনুযায়ী নেন ব্যবস্থা। শহরের চারপাশে আইএস জঙ্গী গোষ্ঠীর স্নাইপার ওঁৎ পেতে থাকে। তাই অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে পথ দেখাতে বেশ সতর্ক থাকতে হয় পেশমারগার সদস্যদের। পাছে স্নাইপারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হোন এ কারণেই এত সতর্কতা। এত ভয় আতঙ্কের মধ্যেই আজ রাতে বেশ ক’জন ব্যক্তি মসুল ছাড়ছেন। মসুল শহর ছেড়ে পালিয়ে আসা ক্ষিপ্ত, বিধ্বস্ত মানুষ যেন নতুন জীবন পায়। মসুল শহরজুড়ে তীব্র পানি ও খাবার সঙ্কট। চারদিকে কেবল ধ্বংসযজ্ঞ ও গলিত লাশ। শহরের ভিতর জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। শহরজুড়ে কেবল চরম উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক। ২০১৪ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময় প্রথম শহরটি দখলে নেয় জঙ্গী গোষ্ঠী আইএস। উগ্রপন্থী এ সংগঠন তখন পুলিশ ফাঁড়ি ও সেনাচৌকি পুড়িয়ে দেয়। নিজেদের তথাকথিত সাদা-কালো পতাকা ওড়ায়। শহর দখলের পর জঙ্গীরা প্রতিটি মসজিদে নতুন ইমাম ও স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ দেয়। আল কায়েদার বিচ্ছিন্ন অংশের নেতা আবু বকর বাগদাদী নিজেকে তখন ইসলামী হুকুমতের নতুন খলিফা দাবি করেছিলেন। স্থানীয় আল নুরি মসজিদে এই জঙ্গী বিশ্বের সকল মুসলিমকে তার বায়াত গ্রহণেরও আদেশ দেন। এ পরিস্থিতিতে মসুলের অধিকাংশ অধিবাসী শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। বাকিদের অধিকাংশ শহরে আটকে থাকে। শহরের কিছু সংখ্যক আইএস আগমনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। সুন্নিদের প্রতি ইরাকের শিয়া শাসক নুরি আল মালিকীর অন্যায় শাসনের বিকল্প হিসেবেই তারা এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিল। প্রথম দিকে অবশ্যই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা মানুষগুলোর সময় খারাপ যায়নি। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছিল, অন্ন-বস্ত্রের জোগানও ছিল প্রতুল। কিন্তু অল্প কিছুদিন পর অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। কঠোর শরিয়া আইন জারি হয়। অধিবাসীদের বাধ্য করা হয় দাড়ি রাখতে। সঙ্গে আফগান স্টাইলের প্যান্ট। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মহিলাদের চলাফেরার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরিবারের সদস্য ছাড়া মহিলারা রাস্তায় বের হতে পারত না। যদি কোন মহিলা উঁচু হিলের জুতা পায়ে রাস্তায় বের হওয়ার সাহস দেখাত তখন তাকে প্রকাশ্যে প্রহার করা হতো। এ কারণে ধীরে ধীরে মার্কেটগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ে। অব্যবস্থাপনার জন্য পানি ও বিদ্যুতহীন হয় শহর। ২০০৬ সাল থেকে জঙ্গী গোষ্ঠী আইএসের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়। ২০০৩ সালে সাদ্দামের পতনের পর আইকিউআই (ওছও) ব্যানারে ইরাকের বাথ পার্টির সদস্যরা সবে জড়ো হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি ২০১২-১৩ সালে তারা সিরিয়ায় নিজেদের কর্মকা- বিস্তার করে। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি ইরাকের রামাদি শহর দখলে নেয় এ গোষ্ঠী। মসুলের মতোই শতাধিক জঙ্গী রামাদি শহরের সরকারী স্থাপনা দখলে নেয়। জঙ্গীদের দৌরাত্ম্যে সরকারী বাহিনী তখন পিছু হটে। যদিও তারা শহরের একটি অংশে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সচেষ্ট হয় ও শহর দখলমুক্ত করার যুদ্ধ চালিয়ে যায়। দীর্ঘ দুটি বছর রামাদির অধিবাসীদের এমন যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই বাস করতে হয়। দখল-পাল্টা দখলের এ পরিস্থিতি যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বার্লিন । শিয়া মিলিশিয়া ও মার্কিন কোয়ালিশন বাহিনীর সহায়তায় ২০১৫ সালের শেষ দিকে আইএস দখলমুক্ত হয় রামাদি। শহরের অধিবাসীরা ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করে। কিন্তু দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতার জন্য চেনা শহর তাদের কাছে বড় অচেনা দেখায়। চারদিকে কেবল ধ্বংসযজ্ঞ, লাশ ও আর্তনাদ। ইরাকের অন্যান্য শহরের তুলনায় রামাদির পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ ও নাজুক। আইএস জঙ্গীরা এই শহরের অধিকাংশ স্থান বিশেষ করে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। শহরের সর্বত্র কেবল ধ্বংসযজ্ঞ। দখলের প্রথম দিকে সরকার ও আইএসের মধ্যে কিছুটা ভঙ্গুর সমঝোতা ছিল। ফলে আইএস অধিকৃতরা শহরের অন্য অংশে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারত। সরকার ও আইএসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিয়েই এমন আসা-যাওয়া। আইএস অধিকৃত অধিকাংশ দোকান ও বাসবভনে স্প্রে দিয়ে লেখা থাকত ‘আইএসের নিজস্ব সম্পত্তি।’ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর বিপরীতও ছিল। সেখানে আইএসের কোন চিহ্ন থাকত না। তবে তা নিতান্তই ব্যতিক্রম। রামাদি শহরের যে অংশ আইএসের দখলে ছিল সে অঞ্চলে পণ্যের বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড সব নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। নামাজের ওয়াক্ত হলে দোকান বন্ধ রাখা ছিল বাধ্যতামূলক। সর্বত্র তখন আইএস জঙ্গীগোষ্ঠীর সাদা-কালো পতাকা। রামাদি শহরে আইএস বহু কিশোরকে অপহরণ করে মুক্তিপণও আদায় করেছে। মুক্তিপণ প্রদানে ব্যর্থ হলে সেসব কিশোরকে জোরপূর্বক নিজেদের দলে কাজে লাগাত। তাদের আস্তানা থেকে পালানোর কোন সুযোগ কিংবা পথ থাকত না অপহরণকৃত কিশোরদের। সার্বক্ষণিক কড়া নজরদারির ব্যবস্থা ছিল। বাগদাদ শহরের দক্ষিণ অঞ্চল হতে সিরিয়া, তুরস্ক ও সৌদি আরব সীমান্তবর্তী অধিকাংশ অঞ্চল দখল করেছিল আইএস। শত শত শহর ও গ্রামে তাদের ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বেশকিছু দুর্লভ নিদর্শন ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে আইএস। ইয়াজিদি ধর্মাবলম্বীদের ওপর ছিল তারা সবচেয়ে বেশি খ—গহস্ত। ইয়াজিদিদের তারা মূর্তি পূজাক ভাবত। তেলকূপে আগুন জ্বালিয়ে পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি করে আইএস। মাসের পর মাস জ্বালিয়ে দেয়া জ্বালানি তেলের ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় পুরো অঞ্চল। ইরাকজুড়ে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ আইএস জঙ্গীদের কারণে নিজেদের বসতভিটা ছাড়তে বাধ্য হয়। শুরুতে একটি শক্তিশালী ও আদর্শ রাষ্ট্রের জিগির তুলে আইএস ইরাকী সুন্নিদের নিজেদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। নারী, পুরুষ, ধনী, গরিব সকলের প্রতি ছিল তাদের এমন আহ্বান। কিছু ইরাকীকে অবশ্য আইএসের ব্যাপারে অতিউৎসাহী হতেও দেখা যায়। মূলত নুরী আল মালিকীর সরকারের বৈষম্যের শিকার সুন্নিরাই ছিল আইএসের মূল টার্গেট। এ সুন্নিদের আবেগকে কাজে লাগায় আইএস। এ কারণে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে আইএসের সমর্থক বেশি ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু দেশ তখন আইএসকে আর্থিকভাবে সহায়তা করে। যার মধ্যে সৌদি আরব, কাতার ও তুরস্কের নাম বেশি উচ্চারিত হয়। গ্রামাঞ্চলে আইএসের জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গে ইরাকের একজন জেনারেল জানান, ‘নিরক্ষর ও আধুনিক বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন মানুষই মূলত আইএসের সমর্থক।’ নিজেকে মসুল অপারেশনের মূল পরিকল্পনাকারী দাবি করা এই জেনারেল দাবি করেন ‘আইএসের অধিকাংশ সদস্যই সমকামী। এরা আসলে সব ... বাচ্চা। এদের মানুষ বলতেও দ্বিধা হয়।’ জেনারেলের গাড়ির পেছনে বসা অন্য অফিসার মাথা নাড়িয়ে তার বক্তব্যকে সমর্থন করেন। জেনারেলের গাড়ি বাগদাদ হতে মসুলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছে তাদের। কারণ রাস্তার দুই ধারে মাইন পোঁতা। একটু এদিক-সেদিক হলেই দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা। এ কারণে গাড়ির ড্রাইভারকে বার বার সতর্ক করছিলেন জেনারেল। গাড়ির কনভয়টি জাহালা নামক একটি গ্রামে এসে থামল। সেখানে হাজারও উদ্বাস্তু জড়ো হয়েছে। তারা সকলে খাবারের আশায় লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রোদের প্রচ- তাপ। অসংখ্য মানুষের ভিড়। গ্রামের শীর্ষস্থানীয় এক ব্যক্তি ছুটে এলেন জেনারেলের কাছে। তিনি জানালেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। অথচ খাবার মজুদ আছে মাত্র ৭০০ মানুষের। সহায়-সম্বলহীন এসব মানুষÑ সকলেই জেনারেলের দিকে তাকিয়ে। একটি রেশন কার্ডের জন্য হাত বাড়িয়ে আছে। কিছুটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ চোখে পড়ল। সকলেই জেনারেলের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চায়। জানাতে চায় নিজের দুর্ভোগ-দুর্দশার কথা। কিন্তু জেনারেল সে সুযোগ তাদের দিলেন না। কিছুটা কর্কশ ভাষায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বললেন, ‘লাইনে দাঁড়াও’। কিন্তু সকলে নির্বিকার। জেনারেলের সঙ্গে আসা ট্রাকে আজকের মতো খাবার ফুরিয়ে যায়। এ কারণে অনেকেই খাবারের আশায় জেনারেলকে ঘিরে ধরে। জেনারেলের অধীনস্থ একজন সঙ্গী খাবারের আশায় ভিড় করা এমন যুদ্ধপীড়িত মানুষকে সরিয়ে দিতে হাতে থাকা রাইফেল হতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। কিন্তু সকলেই নির্বিকার। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের ডামাডোলে থাকা মানুষের কাছে গুলি/কামান/বোমা নিতান্তই সাধারণ ব্যাপার। ভিড় ঠেলে জেনারেল গাড়ির পানে এগিয়ে গিয়ে দরজা খোলার প্রস্তুতি নিলেন। একটি রুগ্ন মহিলা হাত বাড়াল কিছু খাবারের আশায়। কিন্তু জেনারেল অপারগ। ত্রাণ আজকের মতো শেষ। আগামীকাল আরও অধিক ত্রাণ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন তিনি। কিছুটা কৌতুকছলে তিনি বলে উঠলেন ‘আজকের মতো শেষ হলো খাবার। আশা কর আগামীর।’ তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) নেতা বাগদাদী তার বর্বর মানসিকতার জন্য আল কায়েদা থেকে বেরিয়ে নতুন দল গঠন করেন। কথিত আছে আল কায়েদা নেতা আইমান আল জাওহিরির সঙ্গে জিহাদজনিত মতপার্থক্যের কারণেই বাগদাদী দলছুট হন। আল কায়েদার মতো উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর দৃষ্টিতেও আইএস একটি চরমপন্থী সংগঠন। যাদের মতাদর্শের সঙ্গে আল কায়েদার রয়েছে তুলনামূলক মতপার্থক্য ও ব্যবধান। কারণ, আল কায়েদার প্রয়াত নেতা ওসামা বিন লাদেন মনে করতেন ইসলামের মূল শত্রু হলো ‘দূরের শত্রু’ তথা সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তি। অন্যদিকে আইএস নেতা বাগদাদীর অভিমত ইসলামের মূল শত্রু হলো ‘কাছের শত্রু’ অর্থাৎ মুসলিম বিশ্বের অপবিত্র শাসক। যারা ইসলামী রীতিতে দেশ পরিচালনা করতে ব্যর্থ। প্রথম দিকে বাগদাদীর লক্ষ্যবস্তু ছিল শিয়া। যাদের তিনি ইসলামের মধ্যে জীবন্ত ক্যান্সার হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ইরাকের বাথ পার্টির বহু বছরের পুরনো মতাদর্শকে তিনি আসলে সামনে এনেছেন। আশির দশকে ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন যখন ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তখন একটি ডায়ালগ আওড়াতেন। ইসলামের প্রকৃত রক্ষক ও সৈনিক পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন সাদ্দাম হোসেন। আরব বিশ্বের সুন্নি জনগণকে ইরানের শিয়া থেকে রক্ষার জন্য উক্ত বুলি আওড়াতেন সাবেক এই স্বৈরশাসক। সপ্তম শতাব্দী থেকে চলে আসা এই বিরোধের পুনরায় সূচনা ঘটান আল বাগদাদী। প্রথম দিকে তার হামলার মূল লক্ষ্যবস্তুই ছিল ইরাকের শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শেষ দিকে বাগদাদী ও তার দল আইএস শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের চেয়ে সুন্নি সম্প্রদায়ের মানুষকেই বেশি নিশানায় ফেলে। আল কায়েদার সঙ্গে তাদের তাত্ত্বিক মতপার্থক্যও এ জায়গায়। আইএস কেবল অবিশ্বাসী, সুন্নি, শিয়া কিংবা অন্য ধর্মের মানুষই হত্যা করেনি, বরং যারাই হত্যাযজ্ঞে শামিল হয়নি তাদের হামলার নিশানা করেছে। এই উগ্রপন্থার সূচনা মূলত সাবেক ফিলিস্তিন নেতা আবদুল্লাহ আযমের হাত ধরে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময়কালে আল কায়েদা প্রতিষ্ঠা করেন এই তাত্ত্বিক জিহাদি নেতা। তার মতে, ভয় কিংবা সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে অবশ্যই লাশের প্রয়োজন। তিনি লিখেছেনÑ মুসলিম বিশ্বের এই লাঞ্ছনার জন্য দায়ী তাদের অস্ত্র ত্যাগ ও জিহাদের প্রতি বিমুখতা। আবদুল্লাহ আযমের এই জিহাদি তত্ত্ব কতটা আত্মঘাতী তা আইএসের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ২০১৬ সালে আইএস যোদ্ধাদের অধিকাংশ নিজেদের সহযোদ্ধাদের হাতে প্রাণ হারায়। সম্মুখযুদ্ধ কিংবা বিমান হামলায় হতাহতের চেয়ে সহযোদ্ধার হাতে প্রাণ হারানো আইএসের সংখ্যা ছিল বেশি। ২০১৬ সালের জুন মাসে ইরাকের স্পেশাল ফোর্স ফালুজা পুনরুদ্ধান করে। ইরাক ছেড়ে সিরিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমায় জঙ্গী সংগঠনটি। কিন্তু তার আগেই ফালুজা শহরের আনাচে-কানাচে রেখে যায় নিজেদের অসংখ্য বর্বরতার নিদর্শন। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম ফালুজা দখলে নেয় আইএস। পুলিশ ও সেনা জোয়ানরা নিজেদের অস্ত্র ও অর্থসহ যা কিছু সম্বল তা নিয়ে পালিয়ে যায়। বাকিরা আইএসের কাছে আত্মসমর্পণ করে কিংবা শহরের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকে। আত্মসমর্পণ করা ইরাকের পুলিশদের প্রকাশ্য জনসম্মুখে তাদের অতীত কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে হতো। আইএসের ধর্মীয় পুলিশ ‘হিসবাহ’ কখনও জনসম্মুখ, কখনওবা মসজিদ প্রান্তরে তাদের শাস্তির বিধান করত। লঘু অপরাধের জন্য বেত্রাঘাত ও গুরুতর অপরাধের জন্য তাদের হত্যাও করা হতো। ফালুজার মহিলা শিক্ষা ইনস্টিটিউটে ছিল আইএসের আদালত ও বিচার বিভাগ। একই ভবনে আসামিদের মৃত্যুদ- দেয়া হতো। ভবনটি ২০১৬ সালে আইএস দখলমুক্ত হওয়ার পর সেখানে ফালুজার স্থানীয় বাসিন্দারা পুনরায় ফিরে আসে। দেখে সেখানে মৃত মানুষের পচা গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে এসেছে। হলরুমগুলোতে কেবল লাশের স্তূপ। কার্পেট কিংবা প্লাস্টিক দিয়ে দেহগুলো ঢাকা। পচাগলা সেসব দেহ বিকৃত আকার ধারণ করেছিল। স্থানীয় একজন পুলিশ অফিসারের ধারণা এসব মৃতদেহের অধিকাংশ আইএস যোদ্ধাদের। যুদ্ধজনিত মতভেদ কিংবা অন্য কোন কারণে এদের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিল। ফালুজা দখলের পর স্থানীয় হাসপাতালটিকে আইএস নিজেদের প্রধান ঘাঁটি বানায়। যুদ্ধকালীন সময়ে স্থানীয় অধিবাসীরা নিজেদের সন্তান কিংবা অন্য আত্মীয়স্বজন যারা নিহত হতেন তাদেরও হাসপাতালের আশপাশে কবর দিতেন। আবারও মসুল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। যুদ্ধবিধ্বস্ত মসুল থেকে পালিয়ে আসা অধিবাসীদের পরদিন কুর্দিশ জেনারেলের সামনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির করা হতো। জীর্ণ পোশাকে মসুল থেকে পালিয়ে আসা নিদ্রাহীন সেসব মানুষ মাত্র একদিনের তৃপ্ত নিদ্রায় কতটা উৎফুল্ল দেখাত তা না দেখে বর্ণনা করা যায় না। দাড়ি কামিয়ে, গোসল সেরে, পরিষ্কার পোশাকে যখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের হাজির করা হতো তখন তাদের চেনা দায় ছিল। এমনি একজন ব্যক্তি আলি। কুর্দিশ জেনারেল তাকে গুগল ম্যাপের দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলেন তার বাড়ি শহরের ঠিক কোন্ দিকে? আলি জেনারেলকে ম্যাপে তার বাড়ির স্থানটি দেখাল। তার পাশেই ছিল আইএসের একটি ভবন। এরপর জেনারেল জানতে চাইলেন সে কেন এতদিন শহর ছেড়ে পালিয়ে আসেনি? উত্তরে আলি তার অপারগতার কথা জানাল। কারণ, পুরো শহরের সবদিকেই বোমা পুঁতে রাখা। যারাই শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছে তাদের মরতে হয়েছে। জেনারেল তার প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউ আইএসের সমর্থক আছে কিনা জানতে চাইলেন। আলি কয়েকজনের নাম উচ্চারণ করতেই জেনারেল হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এদের নাম আমি জানি। অন্য কারও সম্পৃক্ততা থাকলে জানাও’। জেনারেল আলিকে প্রশ্ন করলেন তার কোন ফেসবুক এ্যাকাউন্ট আছে কিনা। আলি জানাল, ‘তার কোন ফেসবুকে এ্যাকাউন্ট নেই। এমনকি তার কোন মোবাইল নেই।’ এটা পরিষ্কার আলির উত্তরে জেনারেল মোটেও সন্তুষ্ট নন। কারণ, মসুল থেকে পালিয়ে আসা অধিকাংশই ছিল আইএসের সমর্থক। কিন্তু তারা তা গোপন করেছিল। শেষ দিকে জেনারেল আলিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অনেক হয়েছে, সব আরব মিথ্যাবাদী। তারা কম-বেশি সকলেই আইএসের সমর্থক।’ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আলি কিছুটা আবদারের সুরে জানাল, সে শরণার্থী শিবিরে যেতে চায় না। কারণ, তার বিবি এখন বয়সে তরুণ এবং সেখানে অনেক কম বয়সী যুবক থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। জেনারেল হুকুমের সুরে বললেন, ‘আমাদের সবার বউ-বাচ্চা আছে। আমি গত ছয় মাস আমার বিবিকে দেখিনি।’ আলি ও তার পরিবারকে নতুন একটি শরণার্থী শিবিরে স্থানান্তর করা হলো। মসুল যুদ্ধের বহু আগেই এই ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্যাম্প এখনও নতুন। টয়লেটও বেশ পরিষ্কার। আলি জানে সে এখানে বেশিদিন থাকবে না। তার এক নিকট আত্মীয় তাকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবে। ইরাকের অন্য কোন শহরেই হবে আলির পরবর্তী ঠিকানা। কিন্তু এরপর? আলির ভাগ্যে কি লেখা আছে তা তার জানা নেই। আইএসের উত্থানের পর ইরাকে জীবনের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। বদলেছে মূল্যবোধ। অতীতের ভয়াবহ স্মৃতি তাদের কাছে এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন। সে অতীতে ইরাকী জনগণ আর কখনও ফিরে যেতে চায় না। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
×