ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অতিথি পাখিবরণ

মানুষ বদলায়, বদলায় না পাখি- পরিযায়ীরা অন্তহীন রহস্য

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৩ মে ২০১৭

মানুষ বদলায়, বদলায় না পাখি- পরিযায়ীরা অন্তহীন রহস্য

সমুদ্র হক ॥ মানুষ বদলে যায়। পাখিরা বদলায় না। মানুষ গান ভুলে যায়। পাখিরা ভোলে না। পাখিরা পূর্বসূরিদের সকল রং-সৌন্দযর্, শিল্প, গীত নিয়ে সত্য হয়ে জন্মায় সুন্দর পৃথিবীতে, পূর্বসূরিদের সঙ্গে তারা বেঈমানি, প্রতারণা করে না। পাখিরা চিরকালই একই রকম, ওরা চিরকালের হয়ে থাকে। পৃথিবীতে এই পাখিরা আজও রহস্য হয়ে আছে। পরিযায়ী পাখির (মাইগ্রেটরি বার্ড) রহস্য অন্তহীন। তুষারবরফ, সুমেরু-কুমেরু অঞ্চলের পাখি একটু উষ্ণতা পেতে ছুটে আসে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। বিশেষ করে বাংলাদেশে শীত মৌসুমে দূর দেশ থেকে হাজারো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আসে পাখিরা। মধুর সুর ও ছন্দে কিচিরমিচির করে নেচেগেয়ে প্রকৃতির হৃদয় ভরিয়ে দেয়। নদীর জলে, খালবিলে, বড় জলাশয়ে পাখিদের ওড়াউড়ি, চখা-চখি, পানকৌড়ির ডানা ঝাঁপটানো, ঠোঁটে ঠোঁট নাড়িয়ে অপার রোমান্টিকতার অপরূপ দৃশ্য মানব হৃদয়কে মধুময় করে তোলে। পাখি বিশারদ ও ভূবিজ্ঞানীগণ বলছেন, পাখিদের অভিপ্রয়াণ শুরু হয় অন্তত ৫ কোটি বছর আগে। আকাশপথে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে, মরুভূমির ওপর দিয়ে বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে পাখিরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। এই বিষয়টির গভীর রহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। বর্তমানে বলা হয়, বিশ্বের জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনে পাখিদের আবাসস্থল আর ঠিক থাকছে না। এভাবে পাখিদের নীড় ভেঙ্গে পড়ায় খাদ্য ও আশ্রয়ের চরম সঙ্কটে পড়ে পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। একসময় পরিযায়ী পাখিদের বলা হতো অতিথি পাখি। বর্তমানের গবেষণায় দেখা গেছে এরা অতিথি নয়। যখন যে দেশ যায় সেখানে প্রজননের পালায় ডিম দেয়। সেই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে দেয়া পর্যন্ত বাস করে। তারপর বাচ্চাকে রেখে উড়ে যায় ওর দেশে। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর গোলার্ধের বেশিরভাগ দেশে শীত মৌসুমে তুষারপাত হয় না। যে কারণে ইউরোপ,সাইবেরিয়া অঞ্চল, চীন এবং হালে আফ্রিকা ও দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চলের দ¦ীপপুঞ্জ থেকে ঋতু পরিবর্তনের নানা সময়ে পরিযায়ী পাখিদের একটা অংশ বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আসে। বিশ্বে প্রায় দশ হাজার প্রজাতির পাখির ২০ শতাংশ (প্রায় আড়াই হাজার প্রজাতি) পরিযায়ী। বাংলাদেশে ৬শ’ ৫০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩শ’ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এদের ৮ প্রজাতি গ্রীষ্মে এই দেশে থাকে, শীতে চলে যায়। বাকিরা শীতে এই দেশে কিছুটা সময় থাকে। এই সময়ে পরিযায়ী পাখিদের যারা ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের করে দেয় এই শিশুপাখিদের পালক গজিয়ে বড় হলে তারা শেষ পর্যন্ত এই দেশে থেকে যায়। এভাবে অনেক পাখি প্রকৃতি থেকেই বাংলাদেশী পাখি হয়ে গেছে। সম্প্রতি রাজশাহীতে নতুন এক পাখি দেখা গেছে। ডোরাকাটা এই পাখির নামকরণ করা হয়েছে খয়রাটুপি বাটুকুড়ালি। বাংলাদেশের টিয়া পাখি আকাশে মুঠো মুঠো সবুজ রাঙিয়ে উড়ে বেড়ায়। এই পাখি এতই সৌভাগ্যবান যে তার নামেই টিয়া রং নামকরণ হয়েছে। ঠোঁট হীরার মতো ধারালো। টিয়া পাখি আরেক দিকে সৌভাগ্যবান। টিয়ার গোশত কেউ খায় না। সবচেয়ে হতভাগা পখি বক। এই বক পাখি শিকারির কবলে পড়ে বেশি। একশ্রেণীর শিকারি বক পাখিকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে বকের ঝাঁককে ধরে। বক পাখিকে নিয়ে কালজয়ী ভাওয়াইয়া “ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে..” গেয়েছেন আব্বাস উদ্দিন আহমেদ। এই বক পাখি এতটাই অতিথিপরায়ণ যে পরিযায়ী পাখিদের সঙ্গে সহজে মিশে যায়। অন্য পাখিরাও মেশে, তবে বক পাখি এগিয়ে। বক পরিযায়ী পাখিদের ভাষা সহজে বুঝতে পারে। পরিযায়ী পাখিরা বককে পেলে আনন্দে মেতে ওঠে। শীত মৌসুমে পরিযায়ী পাখির আগমনে স্বাগত জানায় বক পাখি। আকাশে উল্টো তীরের আকৃতিতে উড়ে আসা অতিথি পাখিরা জলাশয়ের ওপর আসা মাত্র একঝাঁক বকপাখি উড়ে ওই পাখিদের বরণ করে নিয়ে আসে। মনে হবে বকপাখিরা গার্ড অব অনার দিচ্ছে। দেশে আরেক ধরনের পাখি আছে। অনেকে মনে করেন, বহু বছর আগে পরিযায়ী পাখি হয়ে আসা পাখি ডিম পেড়ে তাদের বংশধরদের ফুটিয়ে রেখে গেছে। সেই থেকে এই পাখি বাংলাদেশকে আপন করে নিয়ে রয়ে গেছে। ছোট্ট এই পাখিকে বলা হয় উদাস পাখি। বেশিরভাগ সময় গাছের শাখায় চুপচাপ উদাসী হয়ে থাকে। মনে হবে, কবিতার প্লট নিয়ে আনমনে বসে ভাবছে। হালকা জঙ্গল ঝোপঝাড়ে ধীরগতিতে হেঁটে শিল্প-সাহিত্য চর্চা করছে। পাখির ডানা ও লেজ সুন্দর দেখতে। এই উদাস পাখির নাম হয়েছে চটক। এমন উদাস পাখি পরিযায়ী পাখিরা পথ খুঁজে পায় বাতাসের গতি, গন্ধ, ভূমির অবয়ব দেখে। তাদের ভেতরে জিওম্যাগনেটিক বিষয় এতটাই সক্রিয় থাকে যে, পূর্বের বছরে কোন্ দেশে গিয়েছিল তা বুঝতে পারে। এক্ষেত্রে আগে সেই দেশে গিয়েছে এমন পাখি দিকনির্দেশক লিডার হয়ে ঝাঁকের সঙ্গে এসে ফিরে গিয়ে আরেক ঝাঁককে নিয়ে যায়। কত পাখি এই দেশে আসে কত পাখি রয়ে যায় তার হিসাব পাওয়া যায় না। পাখিদের একটাই পৃথিবী। গোটা পৃথিবী তাদের দেশ। বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি অতিথি হয়ে আসার পর শিকারিরা সুন্দর পাখিকে হত্যা করে খাবার টেবিলে নিয়ে যায়। এটাই ওদের ব্যথিত অধ্যায়। সাথী নিয়ে আসে আবার সাথী ছাড়াই ফিরে যায়।
×