ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুসলমানদের দ্বন্দ্ব সংঘাতে লাভবান হচ্ছে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৩ মে ২০১৭

মুসলমানদের দ্বন্দ্ব সংঘাতে লাভবান হচ্ছে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মুসলমানদের নিজেদের মধ্যকার জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লাভবান হচ্ছে কেবল অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। আমরা (মুসলিমরা) নিজেরাই বিশ্বের মধ্যে বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধরত রয়েছি আর অস্ত্র ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটছে। এই যুদ্ধ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সৌদি আরবের মজলিসে শূরার স্পীকার ড. আব্দুল্লাহ বিন মোহাম্মদ বিন ইবরাহিম আলী সৌজন্য সাক্ষাত করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন। বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর ফলে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে এবং মুসলমানেরা ভিটেমাটিছাড়া হয়ে অন্যদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হচ্ছেন। এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং এগুলো বন্ধে আমাদের বিপথগামী মুসলমানদের বোঝাতে হবে। তিনি বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই শেষ বিচারের মালিক সুতরাং মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নির মতো নানামতের এই বিভাজন কেন? এগুলো বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিপথগামী মুসলিমদের অনেকেই নানারকম বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন, কেউ কেউ মনে করছেন জীবন্ত বোমা হয়ে আত্মাহুতি দেয়ার মাধ্যমে তারা বেহেশতে যাবেন, আসলে তারা যাবেন দোজখে। এ সময় সৌদি স্পীকার বলেন, টাকার বিনিময়েও অনেককে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে সমস্যাটি রয়েছে। টাকা ছড়িয়ে কৃত্রিম বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব বিপথগামীকে সত্যিকারের ইসলামের পথে পরিচালিত করতে আলেম ওলামার অবশ্য করণীয় রয়েছে। তিনি বলেন, আগামী ২১ মে রিয়াদে অনুষ্ঠিতব্য ইসলামিক আমেরিকান হিস্টোরিকাল সম্মেলনে এসব বিষয় আলোচনায় স্থান পেতে পারে। সৌদি মজলিসে শূরার স্পীকার বৈঠকে সৌদি বাদশাহ এবং মুসলামানদের পবিত্র দুটি মসজিদের জিম্মাদার সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদের শুভেচ্ছাও প্রধানমন্ত্রীকে জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, সৌদি বাদশাহ আশা প্রকাশ করেছেন আসন্ন সম্মেলনে যোগদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং সৌদি আরবের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে। সৌদি আরব সবসময়ই বাংলাদেশীদের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে এবং উভয়ের আবেগের বন্ধন খুব দৃঢ় যেহেতু মুসলিমদের দুটি পবিত্র মসজিদ সেখানে রয়েছে। বৈঠকে সৌদি মজলিসে শূরার স্পীকার প্রধানমন্ত্রীকে তাদের শূরার অবকাঠামো সম্পর্কে অবহিত করে জানান, তাদের সংসদে ৩০ জন মহিলা সদস্য রয়েছেন। যাদের সকলেই উচ্চশিক্ষিত এবং ডক্টরেট ডিগ্রীধারী। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে বজলুল হক হারুন এমপি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব সুরাইয়া বেগম এবং বাংলাদেশে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত আব্দুল্লাহ এইচ এম মুতাইরি উপস্থিত ছিলেন। শ্রমিক-মালিকের সহযোগিতা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিম চালুর জন্য মালিক এবং শ্রমিক সংস্থাগুলোর কার্যকর সহযোগিতা কামনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এ সময় উৎপাদন আরও জোরদার করতে শ্রমিকদের প্রতি মালিকপক্ষকে আরও সহানুভূতিশীল হবারও আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা শ্রম দিয়ে কলকারখানাগুলো সচল রেখে উৎপাদন বাড়াচ্ছেন সেইসব শ্রমিকদের কল্যাণে আমি মালিকপক্ষকে আরও সহানুভূতিশীল হতে বলব। একই সঙ্গে আমি চাই শ্রমিকরাও যে সব কলকারখানা থেকে তাদের জীবন-জীবিকার সংস্থান হয় সেগুলো সচল রাখতে আরও আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্য এবং তাদের পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আর্থিক সহায়তার চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বড় ধরনের দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। তৈরি পোশাক শিল্পের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় আমরা তা উপলব্ধি করেছি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হলো দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিম চালু করা। এ লক্ষে আমরা কাজ শুরু করেছি। এক্ষেত্রে জার্মান সরকার ও আইএলও আমাদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সরকার, মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিগণ জার্মানির এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিম সরেজমিনে পরিদর্শন করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের উপযোগী এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিম গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যার মাধ্যমে শ্রমিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান সহজ হবে। এ বিষয়ে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করে তিনি বলেন, যেকোন শ্রমিক দুর্ঘটনার কারণে বা পেশাগত রোগ-ব্যাধির কারণে মৃত্যুবরণ করলে বা কর্মক্ষমতা হারালে তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের বিধান বাংলাদেশ শ্রম আইনে রয়েছে। শ্রমিকদের সুস্বাস্থ্য ও উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপের আওতায় দেশে প্রথমবারের মতো অকুপেশনাল ডিজিস হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়ে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাসপাতালে ৩৩ শতাংশ শয্যা শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জন্য রিজার্ভ থাকবে এবং শ্রমিকরা কম খরচে এ হাসপাতালে পেশাগত রোগ ব্যধির চিকিৎসা নিতে পারবেন। এ সময় তিনি শ্রম আইন, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল গঠন, তহবিলে স্থিতির পরিমাণ ৮ লক্ষ ৪৪ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ২০০ কোটি টাকায় উন্নীতকরণ, তহবিল থেকে ১ হাজারের বেশি শ্রমিককে সাড়ে ৫ কোটি টাকা প্রদানসহ শ্রমিকদের কল্যাণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই সরকারে এসেছে সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেছে। কারণ আমাদের রাজনীতিই হচ্ছে এদেশের গরিব মেহনতি মানুষের জন্য। দোয়া করবেন যেন আপনাদের সেবা আমরা করে যেতে পারি, আপনারা দেশের সেবা করে যাবেন আমরা আপনাদের সেবা করে যাব। তিনি বলেন, উন্নয়ন ও উৎপাদনের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত, দেশ গঠনে যারা জড়িত, যারা শ্রম দিচ্ছে, যারা খেটে খাচ্ছে, তাদের ভাগ্য পরিবর্তন, কর্মস্থলের নিরাপত্তা, তাদের পরিবার যাতে অন্তত সহায়তা পায়, সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমরা সব সময় শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। জাতির পিতার ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশকে আমরা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলব। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে শ্রমিকদের ৩৭ জন মেধাবী সন্তান এবং দুর্ঘটনায় নিহত ২৭ জন শ্রমজীবীর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আর্থিক সহায়তার চেক বিতরণ করেন। অন্যান্যের মধ্যে অনুষ্ঠানে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু, শ্রম মন্ত্রণালয় সস্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। স্পীকারের সঙ্গে ড. আল শেখের সাক্ষাত জাতীয় সংসদের স্পীকার ও সিপিএ নির্বাহী কমিটি’র চেয়ারপার্সন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপির সঙ্গে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সফররত সৌদি আরবের মজলিশ আশ শূরার স্পীকার ড. আব্দুল্লাহ বিন মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম আলী আল শেখের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাত করেছেন। প্রতিনিধি দলে অন্যান্যের মধ্যে সৌদি শূরা কাউন্সিলের সদস্য ড. সালেহ এ. এস আলসিহাইব, ড. ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ আব্দুল আজিজ আল দারাব ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ এইচ এম আল মুতাইরি এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সাক্ষাতকালে তারা বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি, সৌদি আরবের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা, বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের চর্চা, বাংলাদেশ বিনির্মাণে সৌদি সরকারের অবদান, সৌদিতে বাংলাদেশী কর্মীদের অবদান, হজ ব্যবস্থাপনা, দু’দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করেন। স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সারাদেশের জেলা-উপজেলায় ইসলাম চর্চা ও ইসলাম প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলামি সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করার জন্য ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামিক ইতিহাসসহ বিভিন্ন কারিকুলাম উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের ভ্রাতৃত্ববোধ ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক অত্যন্ত সুউচ্চ মাত্রায় অবস্থান করছে, যা নিকট ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের মাধ্যমে আরও সুদৃঢ় হবে। মজলিশে আশ শূরার স্পীকার ড. আবদুল্লাহ বিন মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম আলী আল শেখ বলেন, সৌদি আরব ও বাংলাদেশ বন্ধুপ্রতীম দেশ। এ সময় তিনি মজলিশ আশ শূরা সফরের জন্য স্পীকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ জানান। এ সময় মোঃ বজলুল হক হারুন এমপি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সিনিয়র সচিব ড. মোঃ আবদুর রব হাওলাদারসহ সংসদ সচিবালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
×