ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ

মহাজনের নাও

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১১ মে ২০১৭

মহাজনের নাও

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জীবনী নিয়ে শাকুর লেখা মহাজনের নাও নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান সুদীপ চক্রবর্তী। দেহতত্ত্বের বেশকিছু গান দিয়ে গাঁথা হয়েছে এই নাটকের মালা। গানে গানে-সুরে সুরে দর্শক মাতালেন এই সুবচন নাট্য সংসদের শিল্পীরা। বর্ণনাত্মক এই দেশজ নাট্যরীতি প্রাচীনকাল থেকে আমাদের সংস্কৃতিতে ছিল যা একবিংশ শতাব্দীতে আধুনিকতার সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া ঘটানো হয়েছে। শাহ আব্দুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ইব্রাহিম আলী ও মাতা নাইওরজান। দরিদ্রতা ও প্রান্তিক জীবনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা করিম সঙ্গীত সাধনা শুরু করেন ছেলেবেলা থেকেই। ভাটি বাংলার মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালবাসার পাশাপাশি তার আদর্শের জায়গায় স্থান করে নিয়েছিল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান। দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়ার ফলেই তিনি নিজেকে ছোটবেলা থেকেই কৃষি কাজে নিযুক্ত করেছিলেন কিন্তু গান বাঁধা থেকে তাকে বিরত রাখা যায়নি। বরং ওই প্রান্তিক অবস্থাটাই যেন তাকে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটি দেখলেও নিজেকে জানার তথা মানুষের ভেতরের সত্তাটাকে চেনার পথ সুগম করেছিল। মহান সৃষ্টিকর্তার সেরা সৃষ্টির যে সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে তা তিনি তার গানের মাধ্যমে মানুষের মাঝে তুলে ধরার চেষ্টাই অব্যাহত রেখেছিলেন। স্বশিক্ষিত বাউল আব্দুল করিম তার জীবদ্দশায় দেড় সহস্রাধিক গান লিখেছেন এবং সুর দিয়েছেন। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে তার ১০টি গান ইংরেজীতে অনূদিত হয়েছে। তিনি অনুপ্রেরিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জুশাহ এবং দুদুশাহের দর্শন থেকে এবং আধ্যাত্মিক ও বাউল গানের দীক্ষা লাভ করেছেন কামাল উদ্দীন, বাউল রশিদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহিম মাস্তান বকশের কাছ থেকে। তিনি শরিয়তী, মারফতি, নবুয়ত, বেলায়াসহ সব ধরনের বাউল গানের চর্চা করেছেন। আর মহাজনের নাও নাটকে সেই গানে গানে করিমের জীবন বর্ণনা করা হয়েছে রূপকভাবে। বাউল করিম রাখাল ছেলে গরুর পাল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় প্রান্তরে প্রান্তরে। এরই মাঝে গান বাঁধে আর হাটে। দোতারা হাতে তার গানে থাকে ভাটি বাংলার সামাজিক প্রেক্ষাপট, অনাহারী কৃষকের জীবন সংগ্রাম, করিম কাঁদে মানুষের দুঃখে আবার তৈরি হয় অনুপ্রেরণা যা মানুষ নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। বসন্ত বাতাসে সাইগো, বসন্ত বাতাসে গানটি মানুষের মনে নতুনত্বের ও আনন্দের দোলা দেয়। কিন্তু শ্রেণী বিভেদ পিছু ছাড়ে না। করিম যে গান করে তা আবার মসজিদের ইমাম সাহেবের পছন্দ নয়। তাই সে ঈদের নামাজ পড়তে গেলে নামাজ আদায়ে নিষেধাজ্ঞা আসল। শেষ পর্যন্ত তাকে ছাড়তে হলো নিজ গ্রাম। ছাড়তে হলো মায়ের মমতা। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি বের হয়ে পড়লেন অজানা উদ্দেশ্যে, তখন গানই হয়ে ওঠে তার একমাত্র ধ্যান, জ্ঞান, প্রতিরাতেই ডাক আসে আসরে গান গাওয়ার। কবিগানের আসর জমে। আসরে গান হয় গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান, মিলিয়া বউগান আর মুর্শিদী গাইতাম। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে সবাই বাঙালী সংস্কৃতিকে যেন লালন করেন সেই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। নারী-পুরুষের সমতা নিয়েও তিনি বলেছেন যা আজ একটা মহা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাউলদের গানের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে দেহতত্ত্ব। নিজেকে জানার এবং সৃষ্টিকর্তার এই মহান সৃষ্টির মহিমা খোঁজার চেষ্টায় তার ছিল সাধনা। তার নিজের বাউল হয়ে ওঠা ছিল এই সাধনারই ফসল।
×