ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উপকূলে অতিবর্ষণ তরমুজে ক্ষতি ২শ’ কোটি টাকা, সর্বস্বান্ত ২২ হাজার চাষী

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১১ মে ২০১৭

উপকূলে অতিবর্ষণ তরমুজে ক্ষতি ২শ’ কোটি  টাকা, সর্বস্বান্ত ২২  হাজার চাষী

স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা ॥ দেড় মাসের ব্যবধানে দুদফা অতিবর্ষণ ও মারাত্মক জলাবদ্ধতায় পটুয়াখালীর দক্ষিণ উপকূলের দুই উপজেলায় তরমুজে প্রায় দুইশ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় কৃষি বিভাগের হিসেবে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২ হাজার ১৭৫ পরিবার। ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। জেলার অন্যান্য এলাকাতেও তরমুজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আকস্মিক এ অতিবর্ষণ ও জলাবদ্ধতায় বহু তরমুজচাষী সর্বস্বান্ত হয়েছে। কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা আশা করছেন, আসন্ন রোপা আমন মৌসুমে সরকারী পর্যায়ে কৃষি প্রণোদনার মাধ্যমে এ ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে। গরমের রসালো ফল তরমুজ চাষে গত কয়েক বছরে পটুয়াখালী জেলার দক্ষিণের দুই চরাঞ্চল প্রধান উপজেলা গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এখানকার চাষীদের উৎপাদিত তরমুজ দিয়ে ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেটসহ দেশের বহু এলাকার চাহিদার বড় একটা অংশ মেটানো হয়। অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছর তরমুজচাষীর সংখ্যা ও জমির পরিমাণ বেড়েই চলছে। চলতি মৌসুমে রাঙ্গাবালী উপজেলায় স্থানীয় কৃষি বিভাগ তরমুজ চাষের জন্য ১০ হাজার হেক্টর জমি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও চাষ হয়েছে আরও ২শ’ হেক্টর বেশি জমিতে। গত ২০১৬ সালের মৌসুমেও লক্ষ্যমাত্রা ৮ হাজার হেক্টরের পরিবর্তে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছিল। একইভাবে গলাচিপা উপজেলাতেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে তরমুজের চাষ হয়। স্বাদ ও বর্ণে মানসম্পন্ন হওয়ায় এখানকার তরমুজের চাহিদাও ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় চাষীদের মাঝেও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। বহু ক্ষুদ্র চাষী ধারদেনা করেও তরমুজের চাষে এগিয়ে আসে। গত মার্চ মাসের প্রথম দিকে যখন তরমুজ গাছে ফলন আসতে শুরু করে, তখনই শুরু হয় লাগাতার অতিবর্ষণ। ৮ মার্চ থেকে লাগাতার পাঁচদিন ধরে চলে অতিবর্ষণ। এ বর্ষণে কৃষকের স্বপ্ন ভেঙে যায়। প্রথমদফা বর্ষণের ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই ২১ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয়বার চারদিনের লাগাতার অতিবর্ষণ চলে। মাঠ পর্যায়ের চাষীদের সূত্রে জানা গেছে, লাগাতার অতিবর্ষণে যতটা ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জলাবদ্ধতায়। বৃষ্টির পানি না নামতে পেরে ক্ষেতগুলো হাঁটুপানির নিচে ডুবে যায়। অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে। এখনও বহু ক্ষেত ডুবে আছে পানির নিচে। চাষীরা সেচযন্ত্র বসিয়েও পানি অপসারণ করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। জলাবদ্ধতার কারণে ক্ষেতের তরমুজ ক্ষেতেই পচে যায়। মারাত্মক এ জলাবদ্ধতার জন্য চাষীরা সরকারী খালগুলো বেদখল হয়ে যাওয়াকে দায়ী করেছে। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারাও এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল মান্নান জানান, অতিবর্ষণের চেয়ে জলাবদ্ধতায় কৃষকের বেশি ক্ষতি হয়েছে। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী দুই উপজেলায় অতিবর্ষণ ও জলাবদ্ধতায় হেক্টর প্রতি ১৫ মেট্রিক টন হিসেবে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬শ’ মেট্রিক টন তরমুজের ক্ষতি হয়েছে। আর্থিক হিসাবে ১৯০ কোটি ৮৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বেসরকারী হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ দুই শ’ কোটি টাকারও বেশি। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রাঙ্গাবালী উপজেলায় ৫ হাজার এক শ’ এবং গলাচিপা উপজেলায় ৪ হাজার ২৭০টি পরিবার প্রান্তিক পর্যায়ের চাষী। দুই উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র চাষী পরিবার হচ্ছেÑ ৬ হাজার ৯৮০টি। মাঝারি পর্যায়ের চাষী পরিবার হচ্ছে, ৪ হাজার ৯০০। বাকিরা বড় চাষী পরিবার। অধিকাংশ তরমুজচাষী ধারদেনা করে তরমুজ চাষ করেছিল। অতিবর্ষণ ও জলাবদ্ধতায় তারা সর্বস্বান্ত হয়েছে। তরমুজচাষীদের ক্ষতি প্রসঙ্গে আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন এমপি বলেন, রোপা আমন মৌসুমে প্রণোদনার মাধ্যমে তরমুজচাষীদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া হবে এবং বেদখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে খাল উদ্ধারে পুলিশের সহায়তা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে। এদিকে, মাঠ পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত তরমুজচাষীরা জানিয়েছেন, তাদের সর্বস্বান্ত হওয়ার কথা। হরিদেবপুর গ্রামের শ্যামল দাস জানান, ৮ লাখ টাকা ধারদেনা করে ১১ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। মাত্র ৭৫ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। বাকি তরমুজ বর্ষার পানিতে তলিয়ে পচে গেছে। চরআগস্তি গ্রামের ক্ষুদ্রচাষী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, সুদে টাকা এনে ৭০ হাজার টাকা খরচ করে তরমুজ চাষ করেছেন। এক টাকাও ঘরে তুলতে পারেননি। দেনার টাকা পরিশোধ নিয়ে আছেন দুশ্চিন্তায়। একই গ্রামের হাছান সরদার ১৭ লাখ টাকা খরচ করে ২৫ একর জমিতে তরমুজ চাষ করে লোকসান গুনছেন ১১ লাখ টাকা। আবু কালাম হাওলাদারের ৫ লাখ টাকার তরমুজ ক্ষেতে পচে গেছে। সব জায়গায় শোনা গেছে তরমুজচাষীদের একই ধরনের আহাজারি।
×