রহিম শেখ ॥ ব্যাংকে আমানতের সুদহার কম থাকায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সঞ্চয়পত্র থেকে নিট বিনিয়োগ এসেছে ৩৭ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত মার্চে সঞ্চয়পত্রে ৬ হাজার ৫৫৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ আসে। ওই মাসে মূল ও মুনাফা পরিশোধ করা হয় ২ হাজার ১৯০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। সেই হিসাবে নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৩৬৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকায়।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল ও মুনাফা পরিশোধের পর যে পরিমাণ অর্থ অবশিষ্ট থাকে তাকে বলা হয় নিট বিনিয়োগ। তাই বিনিয়োগের ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেটে নির্ধারিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মসূচী বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতিমাসে মুনাফা দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে উল্লম্ফন দেখা যায়। চলতি অর্থবছরে এই উল্লম্ফন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে একের পর এক নতুন রেকর্ড গড়ে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসেই ৩৭ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকার নিট বিনিয়োগ নতুন এক রেকর্ড। সঞ্চয়পত্রে এর আগে এক অর্থবছরের পুরো সময় এই পরিমাণ নিট বিনিয়োগ আসেনি। এর আগে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ নিট বিনিয়োগ এসেছিল ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা (২০১৫-১৬ অর্থবছরে)। চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ের জন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের নিট ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। অর্থবছরের ৫ মাস পার না হতেই ওই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত একক মাস হিসেবে সবচেয়ে বেশি নিট বিনিয়োগ এসেছিল গত জানুয়ারিতে। ওই মাসে নিট বিনিয়োগ এসেছিল ৫ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। তুলনামূলক বেশি মুনাফা পাওয়াই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের এই উল্লম্ফনের প্রধান কারণ মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। তা ছাড়া নিরাপদ বিনিয়োগের সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়াটাও একটি বড় কারণ বলে তারা মনে করছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, মূলত ব্যাংকের আমানতের সুদহার কমে যাওয়ার কারণেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে। পুঁজিবাজার যদি স্থিতিশীল হয় তবে হয়ত সেখানে কিছু বিনিয়োগ যাবে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ায় সামাজিক কিছু সুবিধা থাকলেও সরকারের সুদ পরিশোধজনিত ব্যয় চাপ বাড়ে বলেও উল্লেখ করেন অর্থনীতির এই গবেষক। তা ছাড়া ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ কমে যাওয়ায় বাজারে মুদ্রার সরবরাহ কমে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
দেশে কার্যরত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্থায়ী আমানত রাখলে ব্যাংক ভেদে ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে সুদ পাওয়া যাচ্ছে, যা সঞ্চয়পত্রের সুদের তুলনায় অনেক কম। ২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ বা মুনাফা গড়ে ২ শতাংশ হারে কমানোর পরও এর প্রতিটি স্কিমের মুনাফার হার প্রায় ১১ শতাংশের ওপরে রয়েছে। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ ১১.৭৬ শতাংশ এবং ৩ মাস অন্তর মুনাফা সঞ্চয়পত্রে সর্বনিম্ন ১১.০৪ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আসছে পরিবার সঞ্চয়পত্র থেকে। এই খাত থেকে চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১৫ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে নিট ৩ হাজার ১১৪ কোটি টাকা এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রে নিট ২ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ এসেছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বেশি থাকায় স্বল্প আয়ের লোকজন ও অবসরে যাওয়া বৃদ্ধরা এক ধরনের সামাজিক সুরক্ষা পাচ্ছে। সেদিক থেকে সুদব্যয় বাড়লেও এটা অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখানে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের সীমা সঠিকভাবে পরিপালন হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দেশী-বিদেশী উভয় উৎস থেকেই ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটায় সরকার। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে আগে বেশি ঋণ আসত ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। এখন বেশি ঋণ আসছে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে। ব্যাংকবহির্ভূত উৎসের মধ্যে রয়েছে এই সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য কিছু বন্ড। ২০১২-১৩ অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র থেকে মাত্র ৭৭৩ কোটি টাকা নিট বিনিয়োগ আসায় পরবর্তী অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু পরের অর্থবছর থেকেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের উল্লম্ফন দেখা দেয়।