ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

৯৬ শতাংশ চাষী কাটলার নামক হরমোন ব্যবহার করছে অপপ্রয়োগ সম্পর্কে চাষীদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ

আম উৎপাদনে নীরব বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১১ মে ২০১৭

আম উৎপাদনে নীরব বিপ্লব

এমদাদুল হক তুহিন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ফিরে ॥ দেশে প্রতিবছরই আমের উৎপাদন বাড়ছে। আম চাষীরা মনে করেন এর পেছনে কালটার নামে এক ধরনের হরমোনের অবদান রয়েছে। মুকুল প্রদানে অনিয়মিত স্বভাবের গাছেও মুকুল আসায় আমের ফলন বাড়ছে বলে মনে করেন তারা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কালটার নামক হরমোনের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। তবে এর অপপ্রয়োগ সম্পর্কে আম চাষীদের আরও সচেতন হতে হবে। বাগান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ৯০ শতাংশ বাগানেই এই হরমোন ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ভারত থেকে চোরাই পথে আসা কালটারের সঙ্গে ভেজাল মিশিয়ে দেয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। বাগান মালিকরা মনে করেন, উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রভাব রাখায় দেশে কালটারের অনুমোদন দেয়া উচিত। তথ্যমতে, আম উৎপাদনে বিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। আর মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে দেশে আমের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। চাঁপাইনবাবগঞ্জেই দেশের সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদিত হয়। তবে একই সঙ্গে রাজশাহী, নওগাঁ ও নাটোরও আমের জন্য বিখ্যাত। মূলত রাজশাহী বিভাগের এই চার জেলা আমের সিংহভাগ যোগান দিয়ে থাকে। তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজশাহীর এই চার জেলায় ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৯১২ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। তবে সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আমের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ৫ বছরে ওই অঞ্চলে আমের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। চলতি বছরেরও আমের ভাল ফলন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) তথ্যমতে, দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ মিলিয়ন টন আম উৎপাদিত হয়। ২০১৬ সালে দেশ থেকে ৩০০ টন আম রফতানি হয়। এসব তথ্য পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আম উৎপাদনে দেশে নীরব বিপ্লব ঘটছে। উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিত্য নতুন প্রযুক্তির প্রভাব রয়েছে বলেও মনে করেন তারা। সম্প্রতি আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্রই ঝিলিক দিচ্ছে আমের হাসি। প্রধান অর্থকরী ফসল আমের এই অঞ্চলটিতে এখন গাছে গাছে বড় হয়ে উঠছে সবুজ আম। আমের ভারে কোথাও কোথাও ঢালগুলো নুয়ে পড়ছে। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। ভ্রমণ পিপাসু হৃদয়ের কেউ কেউ আমের সঙ্গে সেলফি তোলাতেও ব্যস্ত। কয়েকটি বাগানে ঘুরে কথা হয় একাধিক বাগান মালিকের সঙ্গে। মোহাম্মদ কামরান তাদের একজন। কানসাট সোলাইমান ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর পৈত্রিক আম বাগান দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে তার কাঁধে। ২ সন্তানের জনক কামরানের কাছ থেকে বর্তমানে অন্যান্য বাগানীরাও পরামর্শ পেয়ে থাকেন। বাগান দেখাতে দেখাতে কামরান বলেন, আমার বাগানে ফজলি, ল্যাংড়া, হিমসাগর, আশ্বিনা, বোম্বাই, গোপালভোগ ও স্থানীয় গুটি জাতের রয়েছে। প্রতিবারের চেয়ে এবার ভাল ফলন হয়েছে। শিবগঞ্জ উপজেলার এই আম চাষী বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমের বাগান দেখাশোনা করতে হতো। তবে দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করণীয় সম্পর্কে জানতে শুরু করি। বর্তমানে কোন গাছে কি পরিমাণ কীটনাশক প্রয়োজন, সার প্রয়োজন; তা গাছের পাতা দেখেই বলে দিতে পারি। ত্রিশ বিঘা জমিতে তার ছয় শ’ আম গাছ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করছি। একটি গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার শুরু করলে তিন বছর পর আর ওই গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করা যায় না। পরবর্তীতে আরও উচ্চতর গ্রুপে যেতে হয়। নিজের বাগানে ৫ বছর যাবত কালটার ব্যবহার করছেন জানিয়ে কামরান জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে শতকরা ৯৬ ভাগ আম চাষীই কালটার ব্যবহার করেন। পূর্বে কোন একটি গাছে এক বছর আম আসলে পরবর্তী বছর সেই গাছে আর আম ধরত না। কালটার ব্যবহারের ফলে এখন প্রতিবছরই মুকুল আসছে। সেইসঙ্গে আমের উৎপাদন বাড়ছে। একই ধরনের কথা বলেছেন মাদ্রাসা শিক্ষক মাসুদুল মুল্ক। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, কালটার ব্যবহার করে আমি খুব উপকৃত। তবে এটি ব্যবহারের পর গাছে পর্যাপ্ত জৈব সার প্রয়োগ করা উচিত। শিবগঞ্জ উপজেলার দায়নগরের আম চাষী কাজী সেতায়োর রহমান বলেন, কালটার নাম এক ধরনের হরমোন রয়েছে, যা ভারত থেকে অবৈধভাবে আসছে। এটি ব্যবহার করলে প্রতিবছরই মুকুল আসে। এর প্রভাবে কয়েক বছর ধরেই আমের উৎপাদন বাড়ছে। একই উপজেলায় ৪০ বিঘা জমিতে আমের বাগান রয়েছে শ্রী চাঁদ প্রামাণিকের। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, কালটার ব্যবহার করে আমি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান। আর টিকরী গ্রামের মাইনুল ইসলাম বলেন, নিয়মনীতি না মেনে কালটার ব্যবহার করলে বাগান মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই যারা বাগান লিজ দেন তাদের শর্তসাপেক্ষে বাগান লিজ দেয়া উচিত। জানা গেছে, কালটার হরমোন জাতীয় এক ধরনের রাসায়নিক, যা গাছ থেকে আম পাড়ার পর এবং আম গাছে মুকুল আসার দেড়-দুই মাস আগে ব্যবহার করা হয়। আম গাছের ছায়া যত দূর পর্যন্ত ছড়ায়, গোড়া থেকে তত দূর দিয়ে গাছের চারপাশে ছয়-সাত ইঞ্চি গভীর করে চক্রাকার গর্ত করতে হয়। এরপর প্রতি ডায়ামিটারে চার মিলিলিটার কালটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে ঢেলে দিতে হয়, যাতে কালটার মিশ্রিত পানি পুরো গর্তের বৃত্তটি ভিজিয়ে দেয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহের চাষীরা ২০০৫ সাল থেকে কালটার ব্যবহার করছে। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জেও ঘুরে দেখা গেছে একই অবস্থা। অধিকাংশ গাছের গোড়াতেই রয়েছে বৃত্তাকারের গর্ত। এ প্রসঙ্গে কথা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হামিম রেজার সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, দেশে কালটার নিয়ে গবেষণা চলছে। আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত, পাকিস্তানসহ একাধিক দেশে এটি ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের দেশেও কালটারের অনুমোদন দেয়া দরকার। তিনি বলেন, মুকুল প্রদানে যেসব জাতের অনিয়মিত স্বভাব রয়েছে সেইসব গাছে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এটা এমন এক ধরনের হরমোন, যা আম গাছে মুকুল আসতে বাধ্য করে। মুকুল আসলে ফলন হবে। ফলে একই সঙ্গে উৎপাদনও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, দেশে চোরাইপথে কালটার আসছে। তাই এর ব্যবহারবিধি কেউ ঠিকমতো জানছে না। বেশি উৎপাদনের আশায় কেউ কেউ মাত্রাতিরিক্ত কালটার ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর ব্যবহার অবশ্যই সঠিকভাবে হওয়া উচিত। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ শরফ উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ১৫ বছরের নিচে কোন গাছে কালটার না দেয়াই ভাল। এর উপরের বয়সের যেসব গাছের মুকুল প্রদানে অনিয়মিত স্বভাব রয়েছে সেইসব গাছে কালটার প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে কালটার ব্যবহারে ডোজ পরিপূর্ণ করতে হবে। একই সঙ্গে সেচ ব্যবস্থাপনা ও সার ব্যবস্থাপনা মেনে চলতে হবে। এসব বিষয়ে আম চাষীদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে।
×