ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১১ মে ২০১৭

ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে

মশিউর রহমান খান ॥ দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ব্যবহারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বিধিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সারাদেশে পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যকর তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার করতে সরকার ‘ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য হতে সৃষ্ট বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৭’ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। এজন্য পরিবেশ অধিদফতর এ সম্পর্কিত একটি খসড়া বিধিমালাও তৈরি করেছে। এটি প্রণয়নের মাধ্যমে ভোক্তাগণ নিরাপদে তাদের প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করতে পারবেন। বিধিমালায় প্রযুক্তিপণ্য ক্রয় থেকে শুরু করে অস্বাস্থ্যকর হওয়ার আগেই তা বিক্রেতার কাছে ফেরত দেয়া পর্যন্ত সবই নির্ধারণ করা দেয়া হচ্ছে। বিধিমালায় ই-বর্জ্য হিসেবে ব্যবহৃত বাল্ব, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট, এটিএম বুথের টাকা উত্তোলন যন্ত্র, কোমল পানীয় বিক্রির স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, তাপ নিয়ন্ত্রক (এসি), ধোঁয়া নির্বাপক, এমনকি ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স বাদ্যযন্ত্রও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিধিমালাটি চূড়ান্ত করার কার্যক্রমও এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। বর্তমানে তা আইন মন্ত্রণালয়ের বেশকিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন শেষে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, বিধিমালাটি সম্পর্কে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মতামত পাওয়ার পর পুনরায় পরিবেশ অধিদফতরে পাঠানো হবে। এরপর খসড়া বিধিমালাটি চূড়ান্ত করতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তা ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে পাঠানো হবে। এরপরই কেবল বিধিমালাটি চূড়ান্তভাবে কার্যকর করা সম্ভব হবে। সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করায় সমাজে অতিদ্রুত ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিনিয়তই ইলেক্ট্রনিক্সের পণ্য ব্যবহার ই-বর্জ্য নতুন বিষয় হওয়ায় এ বিষয়ে সচেতনতাও কম, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। ই-বর্জ্যে উদ্বেগজনক মাত্রায় বিষাক্ত উপাদান যেমন সীসা, মার্কারি, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক বেরেলিয়াম ইত্যাদি থাকে। এসব বিষাক্ত বস্তু মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি, মস্তিস্ক, হৃদযন্ত্র ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। ই-পণ্যসামগ্রী ব্যবহারের ক্রম উর্ধমুখিতায় ই-বর্জ্যরে পরিমাণ ও ক্ষতিকর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে সরকার বিধিমালার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী শুধু ভোক্তা নয়, প্রস্তুতকারী ও সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোসহ মজুদকারী, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরও বিধিমালার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, বিক্রির সময়ই ভোক্তার কাছ থেকে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য (ই-বর্জ্য) ফেরত নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেবেন প্রস্তুত ও সংযোজনকারক। রি-সাইকেলের জন্য এসব ই-বর্জ্য সংগ্রহের দায়িত্বে থাকবেন মজুদকারী, ব্যবসায়ী বা স্থানীয় দোকানদার। এদের পরিচালনাধীন সংগ্রহ কেন্দ্র পর্যন্ত ই-বর্জ্য জমা দেয়ার দায়িত্ব থাকবে ভোক্তাদের। বিধিমালার ২৩(৩) ধারা অনুযায়ী, নিবন্ধিত ব্যবসায়ী বা সংগ্রহ কেন্দ্রে ই-বর্জ্য জমা দেয়ার জন্য ভোক্তারাই দায়ী থাকবেন। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বিধি লঙ্ঘনের জন্য আইনানুযায়ী নির্ধারিত জরিমানা প্রদানে বাধ্য থাকবেন ভোক্তারা। ভোক্তাকে নিবন্ধিত ব্যবসায়ী বা সংগ্রহ কেন্দ্রে ই-বর্জ্য জমা দিতে হবে। ভোক্তারা এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আইনে নির্ধারিত জরিমানা দিতে বাধ্য থাকবে। বিধিমালার কোন শর্ত কেউ লঙ্ঘন করলে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০)’-এর ১৫(২) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদ- বা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ- পেতে হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের ক্ষেত্রে দুই থেকে চার বছরের কারাদ- বা দুই থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ- পেতে হবে বলে খসড়া বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারীর সম্প্রসারিত দায়িত্ব অনুমোদনের সময় ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। এ বিধিমালা চূড়ান্তভাবে কার্যকর হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে ই-বর্জ্য সংশ্লিষ্ট ইলেক্ট্রনিক পণ্য প্রস্তুতকারককে পণ্য উৎপাদনে সকল প্রকার বিপজ্জনক পদার্থ ব্যবহার হ্রাসকরণ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। বিভিন্ন স্তরে সংশ্লিষ্টদের দায়-দায়িত্ব খসড়া বিধিমালায় প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারী, ই-বর্জ্য মজুদকারী বা ব্যবসায়ী বা দোকানদার, মেরামতকারী, সংগ্রহ কেন্দ্র, ব্যক্তিগত ভোক্তা বা বড় ব্যবহারকারী/প্রাতিষ্ঠানিক ভোক্তা, চূর্ণকারী ও পুনঃব্যবহারকারীর দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। প্রস্তুতকারক ইলেক্ট্রিক্যাল এবং ইলেক্ট্রনিক পণ্য প্রস্তুতের সময় উৎপাদিত যে কোন ই-বর্জ্য পুনঃব্যবহারোপযোগী বা ধ্বংস করার জন্য সংগ্রহ করবে। ধ্বংসপ্রাপ্ত সব ইলেক্ট্রিক্যাল এবং ইলেক্ট্রনিক পণ্য রাখার জন্য উৎপাদনকারী ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা সমন্বিতভাবে সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ই-বর্জ্য প্রস্তুতকারক, সংগ্রহ কেন্দ্র, পরিবহনকারী, চূর্ণকারী, মেরামতকারী এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকারী দায়িত্ব অনুযায়ী পরিবেশগত বা জনস্বাস্থ্যের যে কোন ক্ষতির জন্য দায়ী হবে। এক্ষেত্রে এদের নিজ অর্থে পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ বা ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিবেশগত উপাদান পুনরুদ্ধার করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। ই-বর্জ্য ১২০ দিনের বেশি মজুদ নয় প্রত্যেক প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, সংগ্রহ কেন্দ্র, চূর্ণকারী, মেরামতকারী এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকারী ই-বর্জ্য ১২০ দিনের বেশি মজুদ রাখতে পারবে না। এদের ই-বর্জ্য সংগ্রহ, বিক্রি, হস্তান্তর, মজুদ এবং বিভাজন সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হবে। বিপজ্জনক পদার্থ ব্যবহারের মানমাত্রা অনুসরণ প্রত্যেক ইলেক্ট্রনিক পণ্য প্রস্তুতকারককে পণ্য উৎপাদনে বিপজ্জনক পদার্থ (এন্টিমনি ট্রাইওয়াক্সাইড, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম মেটাল, ক্যাডমিয়াম সালফাইট ইত্যাদি) ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিমালায় উল্লিখিত মানমাত্রা অনুসরণ করতে হবে। এ বিধিমালা কার্যকর হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে বিপজ্জনক পদার্থ ব্যবহার হ্রাসকরণ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। দাতব্য, অনুদান বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে কোন পুরাতন বা ব্যবহৃত ইলেক্ট্রিক্যাল এবং ইলেক্ট্রনিক পণ্যের আমদানি অনুমোদন করা হবে না। পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিবেদন বর্জ্যরে ধরন অনুযায়ী পরিবেশ অধিদফতরের বিভাগীয় অফিস প্রতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্ধারিত ফরম অনুযায়ী পরিবেশ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয় বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন একত্রিত করে তা পুনঃপরীক্ষা ও দিকনির্দেশনার জন্য প্রতি বছর ৩০ নবেম্বরের মধ্যে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে।
×