ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অথচ ওদের শ্রমে ঘামেই সচল অর্থনীতি আর উন্নয়নের চাকা

আবাসন সঙ্কটে নিত্য জর্জরিত নারী পোশাককর্মীরা

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১১ মে ২০১৭

আবাসন সঙ্কটে নিত্য জর্জরিত নারী পোশাককর্মীরা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ বাংলাদেশের পোশাক খাতকে এগিয়ে নিতে এদেশের নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। দেশের রফতানি আয়ের সিংহভাগ যোগান দিচ্ছেন এসব নারী পোশাক শ্রমিক। নারী পোশাককর্মীরা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও আবাসন সঙ্কটে জর্জরিত তাদের জীবন। কারণ নারী পোশাক শ্রমিকদের বেতনের প্রায় অর্ধেকই শেষ হয়ে যায় বাড়ি ভাড়া দিতে। আর যখন তখন ভাড়া বৃদ্ধি তো রয়েছেই। মূলত নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনের পেছনে বেশি বেতন নয়, বরং আবাসন সমস্যাই প্রধান কারণ। রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন তামান্না। কারখানার পাশের একটি টিনশেডের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন তিনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা বিরামহীন পরিশ্রমের পর বাসায় ফিরে একটু বিশ্রামের বদলে সিরিয়াল দিতে হয় বাথরুমে কিংবা রান্নাঘরে। কারণ তার মতো আরও ১১ পরিবারের বাস করে সেখানে। দুই চুলা আর দুই বাথরুম ভাগাভাগি করতে হয় সবার সঙ্গে। তামান্নার মাসিক বেতন সাড়ে ৫ হাজার টাকা। এই খুপড়ি ঘরটির জন্য মাসিক দুই হাজার টাকা সঙ্গে বিদ্যুত বিল গুনতে হয় তাকেই। গ্রামের বাড়িতে তার মা ও ছোট এক ভাই আছে তাদের সংসার খরচ বাবদ আরও দেড় হাজার টাকা চলে যায় তার হাত থেকে। আর বাকি টাকায় পার করতে হয় জীবনের যাবতীয় খরচ। তামান্না জনকণ্ঠকে জানালেন, ‘এই সামান্য বেতন দিয়ে ঢাকা শহরে থাকা-খাওয়া সম্ভব নয়। সরকার যদি আমাদের থাকার একটা ব্যবস্থা করত তাহলে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের উপকার হতো।’ একই সমস্যায় ভুগছেন রাজধানীর পল্লবীর একটি কারখানায় কাজ করা পোশাক শ্রমিক আঁখি। ইসিবি চত্বরের পাশের একটি টিনশেডে থাকেন তিনি। এক রুমে তারা চারজন গাদাগাদি বসবাস করেন। তাদের আলো-বাতাসহীন এই ঘরটির ভাড়া চার হাজার টাকা। আঁখি জানান, ‘যা বেতন পাই, তা ঘর ভাড়া, বিদ্যুত বিল দিতেই ফুরিয়ে যায়। এরপর বাড়িতে পাঠাতে হয়। একটি নির্দিষ্ট বাসস্থান পেলে খুবই ভাল হতো।’ দেশের পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এ তথ্যে সংশ্লিষ্টদের মতপার্থক্য থাকলেও খাতটির মোট শ্রমশক্তির অর্ধেকই নারী, এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। আর এই পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আবাসন সমস্যা। দিন-রাত পরিশ্রম করে নারী পোশাক শ্রমিকরা ঘরে ফিরেও একটু স্বস্তিতে থাকতে পারেন না। আলো-বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর ঝুপড়ির মতো ঘরগুলোয় রাত কাটাতে হয় তাদের। গরমে ঘরগুলো হয়ে ওঠে আরও অসহনীয়। একা থাকা নারী পোশাককর্মীদের অনেকেই একটি কক্ষে পাঁচ-ছয়জন গাদাগাদি করে থাকেন। ঢাকা, আশুলিয়া, গাজীপুরসহ দেশের অধিকাংশ স্থানের গার্মেন্টস শ্রমিকদের আবাসন সঙ্কটের চিত্রও প্রায় একই রকম। ট্যারিফ কমিশন পরিচালিত সাম্প্রতিক এক সমীক্ষার ফল বলছে, নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনের পেছনে বেশি বেতন নয়, বরং আবাসন সমস্যাই প্রধান কারণ। সমীক্ষায় অংশ নেয়া ২৮ শতাংশ নারী শ্রমিক এ কারণকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। নারী পোশাক শ্রমিকদের বেতনের প্রায় অর্ধেকই শেষ হয়ে যায় বাড়ি ভাড়া দিতেই। আর যখন তখন ভাড়া বৃদ্ধি তো রয়েছেই। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ভাল থাকার ওপর কাজের মান অনেকটা নির্ভরশীল। কাজের মান ধরে রাখতে বিদেশী ক্রেতাদেরও চাপ ছিল। এ পরিস্থিতিতে নারী পোশাককর্মীদের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা করেছে সরকার। আর নারী শ্রমিকদের আবাসন সমস্যার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আবাসন সমস্যা নিরসনে এরই মধ্যে কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম আশুলিয়ায় ৮৩৬ আসনবিশিষ্ট ১২ তলা সরকারী হোস্টেল নির্মাণ। চলতি বছরের জুনে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় মহিলাবিষয়ক অধিদফতর। যার মধ্যে অন্যতম সাভারের আশুলিয়ায় ১২ তলাবিশিষ্ট সরকারী হোস্টেল নির্মাণ। হোস্টেল নির্মাণের অগ্রগতি সম্পর্কে মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ কামাল হোসেন জানান, ‘তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরতদের ৮০ শতাংশ নারী। অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও বাংলাদেশের নারী পোশাককর্মীরা নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। যার মধ্যে অন্যতম আবাসন সমস্যা। আশার কথা হচ্ছে, নারী পোশাককর্মীদের আবাসন সঙ্কট নিরসনের উদ্দেশ্যে সাভারের আশুলিয়ায় সরকারীভাবে ১২ তলাবিশিষ্ট হোস্টেল নির্মাণ করা হচ্ছে। বেশ দ্রুততার সঙ্গেই কাজটি এগোচ্ছে। আমরা আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রকল্পটি শেষ হবে। এতে নারী গার্মেন্টস কর্মীদের আবাসন সমস্যা কিছুটা হলেও দূর হবে।’ নারীদের জন্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকটি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল রয়েছে। এসব মহিলা হোস্টেলে কর্মজীবী নারীরা স্বল্পমূল্যে আবাসন সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে নারী পোশাক শ্রমিকদের জন্য সরকারীভাবে কোন হোস্টেল নেই। সে কারণে নারী পোশাক শ্রমিকদের আবাসন সমস্যা সমাধানে এই হোস্টেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী জানান, ‘সরকারী এ হোস্টেলটি নারী গার্মেন্টস কর্মীদের আবাসন সমস্যায় আশার আলো দেখাবে। তবে সারাদেশে হাজার হাজার গার্মেন্টস কর্মীর জন্য এটা খুবই অপ্রতুল। সেই সঙ্গে রাজধানীতেও অনেক গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে। সেখানেও অনেক নারী শ্রমিক রয়েছেন। তাদের পক্ষে তো আর সম্ভব নয় সাভারে গিয়ে থাকা। যেহেতু সাভারের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পথে, আশা করব সাভারের নারী পোশাক শ্রমিকরা এতে উপকৃত হবেন। তবে আশা করছি ভবিষতে সরকারের এ উদ্যোগ আরও বাড়বে।’ পোশাকশিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের জন্যই এ হোস্টেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি এ শিল্পে কর্মরত নারীদের অধিক হারে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নিয়োজিত রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রকল্পটিতে ব্যয় হবে ২৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ৮৩৬ আসনবিশিষ্ট এ হোস্টেলটি নির্মাণের জন্য শূন্য দশমিক ৯৭ একর খাস জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ৪২ একর জমির ওপর ১২ তলা ফাউন্ডেশন বিশিষ্ট ১২ তলা হোস্টেল ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এছাড়া একই ভবনে ৫০ শিশুর জন্য ডে-কেয়ার সেন্টারের সুবিধা রাখা হচ্ছে। বেশ দ্রুতগতিইে এগিয়ে চলছে ভবন নির্মাণের কাজ।
×