ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নানা কৌশলে চলছে অবৈধ ব্যবসা

কমছেই না হার্টের রোগীদের রিং পরানোর ব্যয়

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১১ মে ২০১৭

কমছেই না হার্টের রোগীদের রিং পরানোর ব্যয়

নিখিল মানখিন ॥ কমছে না রোগীর রিং পরানোর মোট চিকিৎসা ব্যয়। দাম নির্ধারণ করলেও সরকারী নিয়ন্ত্রণে আসেনি হার্টের রিং বাণিজ্য। নানা কৌশলে চলছে রিং বসানোর নামে অবৈধ ব্যবসা। আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে রিং লাগাতে প্রয়োজনীয় এক্সেসরিজ বিশেষ করে ওয়্যার, বেলুন এবং রক্তনালী প্রসারণকারী ওষুধ। সরকারী নির্ধারিত মূল্যেই রিং সরবরাহ করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল ডিভাইসেস ইম্পোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর নির্ধারিত বর্তমান মূল্য তালিকায় দেখা যায়, এখানে সর্বনিম্ন দাম ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৯৪৬ টাকা ২৪ পয়সা এবং সর্বোচ্চ এক লাখ ৪৯ হাজার ৪৮৮ টাকা ৭০ পয়সা। মূল্য নির্ধারণের আগের তালিকা ও পরের তালিকা থেকে দেখা যায়, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স এশিয়া প্যাসিফিক মেডিক্যালস লি. মূল্য নির্ধারণের আগে কোরোফ্লিক্স রিং বিক্রি করত ৮০ হাজার টাকা। মূল্য নির্ধারণের পর এর দাম ধরা হয়েছে ৭৩ হাজার ১২৫ টাকা ৬৫ পয়সা। একইভাবে মেসার্স ইউনিমেড লি. আল্টিমাস্টার (ডিইএস) রিং বিক্রি করত ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। মূল্য নির্ধারণের পর দাম হয়েছে ৬১ হাজার ৯০০ টাকা। লাইফলাইন ইন্টারন্যাশনাল তাদের কম্বো বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার্ড সিরোলিমাস ইলুটিং রিং বিক্রি করত ৮০ হাজার টাকা, বর্তমান মূল্য ৬১ হাজার ২৮৪ টাকা ৮৮ পয়সা। গ্লোবাল কর্পোরেশন তাদের আমদানিকৃত এফডিএ স্বীকৃত বেশ কয়েকটি রিং বিক্রি করত যথাক্রমে দেড় লাখ টাকা, এক লাখ ২৫ হাজার টাকা, এক লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ৮০ হাজার টাকা। বর্তমানে এগুলোর দাম নির্ধারণ হয়েছে যথাক্রমে এক লাখ ৪১ হাজার ৩৪৫ টাকা ৯৮ পয়সা, এক লাখ ৮ হাজার ১৬০ টাকা ৪০ পয়সা ও ৯২ হাজার ১৮২ টাকা ১৬ পয়সা। ওরিয়েন্ট এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট কো. লি. আগে বিক্রি করত দেড় লাখ, এক লাখ ২৫ হাজার, এক লাখ ২০ হাজার এবং ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে তাদের দুটি রিংয়ের দাম ধরা হয়েছে যথাক্রমে এক লাখ ৪৩ হাজার ৪৯ টাকা ৫৭ পয়সা ও এক লাখ ৭ হাজার ৮৬১ টাকা ৩৯ পয়সা। কার্ডিয়াক কেয়ার লি. আগে তাদের আমদানিকৃত বিভিন্ন রিং বিক্রি করত যথাক্রমে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা, দেড় লাখ টাকা, এক লাখ ২৫ হাজার টাকা ও এক লাখ ২০ হাজার টাকা। বর্তমানে তাদের দুটি রিংয়ের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৪৯ হাজার ৮৯১ টাকা ৭ পয়সা ও ১ লাখ ১৪ হাজার ১৯০ টাকা ৮৮ পয়সা। মেডি গ্রাফিক ট্রেডিংয়ের চারটি রিং বিক্রি হতো এক লাখ ৮০ হাজার টাকা, দেড় লাখ টাকা, এক লাখ ২৫ হাজার টাকা ও এক লাখ ২০ হাজার টাকা। বর্তমানে তাদের চারটি রিংয়ের দাম নির্ধারণ হয়েছে যথাক্রমে এক লাখ ৪৯ হাজার ৪৮৮ টাকা ৭৪ পয়সা, ৯৪ হাজার ১৭৯ টাকা ৪৪ পয়সা, ৬৯ হাজার ৫৯৭ টাকা ৫৩ পয়সা এবং ২৫ হাজার টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারী উদ্যোগে রিংয়ের দাম কমানো হলেও এখন পর্যন্ত আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে রিং লাগাতে প্রয়োজনীয় এক্সেসরিজ। বিশেষ করে ওয়্যার, বেলুন এবং রক্তনালী প্রসারণকারী ওষুধ। চিকিৎসকরা জানান, একজন রোগীর হার্টে রিং পরাতে হলে কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার এক্সেসরিজ প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে একটি বেলুনের দাম পড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, ওয়্যারের দাম ৭ হাজার টাকা এবং ওষুধের দাম পাড়ে ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। চিকিৎসকরা মনে করেন রিংয়ের মতো এসবের দামও কমানো সম্ভব। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, রিংয়ের দাম নির্ধারণের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি টিম গঠন করা হয়েছে। টিম দুটি রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখছে নতুন মূল্য তালিকা টাঙ্গানো হয়েছে কিনা, নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে কিনা। তিনি বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে পোস্টার সাইজের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এটা সম্পন্ন হলে সব হাসপাতালের দর্শনীয় স্থানে টাঙ্গিয়ে দেয়া হবে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আফজাল হোসেন বলেন, চিকিৎসকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সরকার নির্ধারিত মূল্যে রোগীদের হার্টের রিং পরাতে। অন্যথায় অভিযুক্তদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা গেছে, দেশে হার্টের রিং বিক্রিতে মার্কআপ মূল্য (পণ্যে করসহ অন্যান্য খরচ ও ধার্যকৃত সর্বোচ্চ মূল্যহারের ব্যবধান) নির্ধারণ করা হয় ২০১২-১৩ অর্থবছরে। কিন্তু রোগীদের কাছে রিং বিক্রিতে এ মার্কআপ মূল্য অনুসরণ করেননি বিক্রেতারা। একশ্রেণীর চিকিৎসকের সঙ্গে যোগসাজশে এতদিন ধরে রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে করোনারি স্টান্ট আমদানি শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত। এতে কোন ধরনের অগ্রিম আয়করও পরিশোধ করতে হয় না। এর বাইরে ৪ শতাংশ অগ্রিম শুল্ক-ভ্যাট পরিশোধ করে নির্ধারিত মার্কআপসহ সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১ দশমিক ৫৫১৫১৬। অর্থাৎ পণ্যের প্রতি ১ টাকা আমদানি মূল্যের বিপরীতে এর সর্বোচ্চ মূল্য ধরা যাবে ১ টাকা ৫৫ পয়সা। কিন্তু তা অনুসরণ না করে ইচ্ছামতো মূল্যে রিং বিক্রি করেছে আমদানিকারকরা। এদিকে বাংলাদেশ মেডিক্যাল ডিভাইসেস ইম্পোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গাজী শাহীন জনকণ্ঠকে জানান, রিংয়ের মূল্য নির্ধারণের জন্য ১৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির সদস্যরা তাদের প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেবেন। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা। তিনি আরও জানান, হার্টের রিংয়ের বিষয়টি মানুষের জীবন মরনের সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি নিয়ে আমরা কখনও অনৈতিক ব্যবসা করতে পারি না। রংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। রিং আমদানি স্বল্প সময়ে শুরু হয়নি। এটা বাংলাদেশে আনার জন্য নিরাপদ ক্ষেত্র তৈরি করতে হয়েছে। অনেক রিং মেয়াদোত্তীর্ণ ও নষ্ট হয়ে যায়। ক্যাথল্যাবে রিং বসানোর আগে একটি রিংয়ের কথা উল্লেখ থাকলেও রোগীর জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে অতিরিক্ত রিং বসিয়ে দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু ওই অতিরিক্ত রিংয়ের টাকা অধিকাংশ রোগীর স্বজনরা দিতে চায় না। ক্যাথল্যাবের ভেতরে বিভিন্ন সাইজের ৩০ থেকে ৫০ রিং প্রস্তুত রাখতে হয়, যেগুলো নষ্ট হওয়া বা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহৃত হওয়া রিংগুলোর ঝুঁকি আমাদের বহন করতে হয়। এছাড়া রয়েছে আমদানি করার প্রসেসিং ও রিংগুলোর গুণ ঠিক রাখার জন্য বিবিধ ব্যয়। আমদানি রিংয়ের শতকরা ৭ ভাগ নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে শুধু বিদেশের মূল্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মূল্য নির্ধারণ করা হলে চলবে না। এসব কিছুর পর ব্যবসায়ীদের কিছু লাভের বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে। চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারিত হওয়ার পর বিষয়সমূহ আমরা পর্যালোচনা করে দেখব। একটি আমদানিকারক কোম্পানি আপাতত দেশের সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ‘এমআরপি’ মূল্যে রিং সরবরাহ করবে। অর্থাৎ একটি ইউনিফর্ম তৈরি করা হয়েছে। একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের একই পণ্য দেশের যে কোন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে অভিন্ন দামে সরবরাহ করা হবে। এর আগে একটি প্রতিষ্ঠানের একই পণ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানভেদে বিভিন্ন দামে সরবরাহ করা হতো। এই শর্তেই রিং সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়েছে বলে জানান গাজী শাহীন।
×