ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ধর্ষকদের ধরতে সিলেটে পুলিশ অভিযান ॥ ছায়া তদন্তে র‌্যাব

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১১ মে ২০১৭

 ধর্ষকদের ধরতে সিলেটে পুলিশ অভিযান ॥ ছায়া তদন্তে র‌্যাব

আজাদ সুলায়মান ॥ বনানীতে দুই ছাত্রী ধর্ষণের আসামিদের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছে পুলিশ। গত রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের অবস্থান সন্দেহে সিলেটের একটি এলাকা ঘিরে রেখেছে পুলিশ। গুলশান জোনের এডিসি আবদুল আহাদ রাতে জনকণ্ঠকে জানান, তারা যে কোন সময় ধরা পড়তে পারে। পালানোর সুযোগ কম। এদিকে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার ছায়া তদন্তে নেমে মাঠে নেমেছে র‌্যাব। র‌্যাবের একটি টিম প্রযুক্তির মাধ্যমে আসামিদের অবস্থান শনাক্তে নিয়োজিত রয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই র‌্যাব ছায়া তদন্ত করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে, র‌্যাব পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, আসামিদের ধরার জন্য র‌্যাব নিজস্ব স্টাইলে কাজ করছে। বলতে পারেন ছায়া তদন্ত। জানা যায়, চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার ঘটনাস্থল বনানীর রেইন ট্রি হোটেলে সেই রাতে একজনের নামে রুম ভাড়া নিয়ে আরেকজন অবস্থান করা ও অবৈধভাবে সেখানে তরুণীদের সঙ্গে মেলামেশার করার অপরাধের দায়ে হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্বেও আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। গুলশান জোনের এক কর্মকতা জানান, কেউ রেহাই পাবে না। আসামি সাফাত আহমেদের বাবাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। রেইন ট্রি হোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুধবার হোটেলের একটি সূত্র জানায়, ঘটনার রাত ২৮ এপ্রিল নাঈম আশরাফের নামে ৭০১ ভাড়া নেয়া হয়। কিন্তু তা হোটেলের রেজিস্ট্রার বুকে রেকর্ড করা হয়নি। এ ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর পুলিশ ওই রেজিস্ট্রার বুক খতিয়ে ওই রাতে শুধু নাঈমের নামই দেখতে পায়। বাকিদের কোন নাম নেই। অথচ ওই রাতে রেইন ট্রি হোটেলে সাফাত আহমেদের জন্মদিনের উৎসব পালনের কথা বলা হয় রিসিপশনে। একজনের নামে রুম ভাড়া নিয়ে আরেক অবস্থান করা তাও আবার তরুণীদের সঙ্গে নিয়ে সেটা কতটা অবৈধ জানতে চাইলে বনানী থানার ওসি আবদুল মতিন বলেন, এ সবই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদি দেখা যায় এখানে অনিয়ম হয়েছে তাহলে হোটেলের কর্মকর্তাদেরও আইনের আওতায় আনার বিধান রয়েছে। ওই হোটেলে দীর্ঘদিন ধরে সাফায়েত আহমেদের মতো সোনার ছেলেরা দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ করে আসছে সেটা কি পুলিশের জানা ছিল না এমন প্রশ্নের জবাবে মতিন বলেন, আমি কদিন আগে এ থানায় জয়েন করেছি। সব তো জানার কথা নয়। এদিকে তোলপাড় করা এ ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর বনানী থানার ওসি ফরমান আলী কেন ৫ দিনের ছুটিতে গেলেন সেটা নিয়ে পুলিশের উর্ধতন মহলেও বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। যদি গুলশান জোনের পুলিশ বলছে, উনি ওনার পাওনা ছুটি ভোগ করতে গেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ওসি ফরমান আলী নিজের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জেও যাননি। তার অবস্থান নিয়েও চলছে সৃষ্টি হয়েছে ধ্রুমজাল। জানা যায়, রাতেই সিলেটের একাধিক স্থানে পুলিশসহ একাধিক সংস্থা অভিযান চালিয়েছে। বিশেষ করে পাহাড়ী এলাকার একটি নির্জন রিসোর্ট ও সিলেটের একটি অভিজাত প্রাসাদের ওপর চলছে নজরদারি। তারা এখনও সিলেটেই অবস্থান করছে বলে পুলিশ নিশ্চিত। তারা যাতে সীমান্ত পার হতে না পারে সে জন্যও নেয়া হয়েছে কড়া সতর্ক প্রহরা। উল্লেখ্য, আসামি সাফাত আহমেদসহ পাঁচজন সোমবার সিলামের ঠাকুরবাড়ি টিলাপাড়ার ‘রিজেন্ট পার্ক রিসোর্টে’ তারা রুম ভাড়া নিতে গিয়েছিল। কিন্তু রুম ভাড়া দেয়ার আগে হোটেলের কর্মচারীরা তাদের কাছে ভোটার আইডি কার্ড চাইতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সাফাত। এরপর সাফাত ও তার সহযোগীরা তড়িঘড়ি করে হোটেল ছেড়ে চলে যায়। তারা পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাদের সঙ্গে থাকা প্রাইভেটকার নিয়ে চলে যান। সাফাত ও তার সঙ্গীরা যে রুমে উঠতে চেয়েছিল তার ভাড়া প্রায় ১২ হাজার টাকা। হোটেলের, ম্যানেজার হেলাল উদ্দিন বলেন, ওরা চলে যাওয়ার পর ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি দেখে নিশ্চিত হতে পারি রিসোর্টে আসা যুবকদের একজন সাফাত আহমেদ। পুলিশসহ অনেকেই ভিডিও ফুটেজ চেয়েছিলেন। কিন্তু রিসোর্টে কোন সিসি ক্যামেরা না থাকায় আমরা কাউকে ভিডিও ফুটেজ দিতে পারিনি। এদিকে গতকাল বুধবার ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে আসামিদের একজনের নাম মিলে যাওয়ায় একজন দুবাইগামী যাত্রীকে দীর্ঘক্ষণ জেরা করা হয়। এক ঘণ্টা পর ওই যাত্রীকে যেতে দেয়া হয়। পুলিশ সূত্র জানায়, সাফাতসহ তার সহযোগীদের সঙ্গে বাংলাদেশী পাসপোর্ট রয়েছে। তারা যাতে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য সিলেটের তামাবিল, জকিগঞ্জের করিমগঞ্জ, বিয়ানীবাজারের সুতারকান্দি ইমিগ্রেশন পুলিশকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পুলিশের ধারণা রিসোর্টে যে পাঁচজন গিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রধান অভিযুক্ত সাফাত ছাড়াও মামলার অন্যান্য আসামি নাঈম, সাদমান ও গাড়িচালক বিলাল্লও রয়েছে। তাদের ব্যবহৃত গাড়ির সন্ধান করছে পুলিশ। সিলেটের গোলাপগঞ্জের উত্তর নগর গ্রামে সাফাতদের বাড়ি উল্লেখ্য, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ এনে গত ৬ মে বনানী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ মার্চ পূর্বপরিচিত সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ ওই শিক্ষার্থীদের জন্মদিনের দাওয়াত দেয়। ওইদিনই তারা ওই ছাত্রীদের বনানীর কে-ব্লকের ২৭ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বরে দ্য রেইন ট্রি হোটেলে নিয়ে যায়। মামলার এজাহারে আরও অভিযোগ করা হয়, সেখানে জন্মদিনের অনুষ্ঠান চলাকালীন দুই তরুণীকে হোটেলের একটি কক্ষে আটকে রেখে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে মামলার সাফাত ও নাঈম। মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদ আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে। এদিকে পুলিশ এ ঘটনায গাফিলতির পরিচয় দিয়েছে মানবাধিকার চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, অপরাধ করে কেউ পার পাবেন। অনেক ঘৃণ্য অপরাধীদের গ্রেফতার করেছি। এমনকি অনেক জঙ্গীকেও আমরা গ্রেফতার করেছি। একইভাবে এই ধর্ষণের মামলার আসামিরাও গ্রেফতার হবে। এই মামলাকে প্রভাবিত করতে কোন মহল কাজ করছে কি না, সে প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের দুই সংসদ সদস্যের কারাগারে থাকার কথা উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘কোন বাহ্যিক শক্তি এখানে কাজ করছে না। এ ধরনের ঘটনাকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা কারও নেই। পুলিশ কারও নির্দেশে প্রভাবিত হবে না। এই দেশে ক্ষমতা ও প্রভাব দেখানোর মতো কেবল একজনই রয়েছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে মামলার বর্তমান তদন্ত সংস্থা সাপোর্ট সেন্টারের লোকজন বুধবার দুই তরুণীর বক্তব্য আবারও যাচাই-বাছাই করেছে। তাদের মন খুলে নির্ভয়ে সেই রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনা বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘মামলা দায়ের থেকে তদন্তের শুরু থেকে নানা ধরনের অনিয়ম ওঠায় বিরক্ত উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা। এছাড়া মামলার ভিকটিম ও বাদী সবাই নারী। পুরুষ তদন্ত কর্মকর্তার কাছে তারা সব কথা খুলে বলতে পারেন না। নারীরাও সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দ্বিধাবোধ করেন, লজ্জা পান। পুরুষ কর্মকর্তাও ঠিকমতো প্রশ্ন করতে পারেন নাই। তাই নারী ভিকটিমদের গোপনীয়তা ও আইনগত স্বার্থ সঠিকভাবে সংরক্ষণের জন্যই বনানী থানার পুরুষ তদন্ত কর্মকর্তাকে মামলার তদন্তভার থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তার জায়গায় মামলার আরও সুষ্ঠু ও নিবিড় তদন্তের জন্য ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের নারী পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’ বুধবার বিকেলে গিয়ে ‘রেইন ট্রি’ হোটেল পরিদর্শনের সময় দেখা যায়, সেখানকার কর্তারা সবাই মুখে তালা মারার কৌশল নিয়েছে। তবে কর্মকর্তারা জানান, এই হোটেলের মালিকের নাম বজলুল হক হার। তিনি ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর উপজেলার সরকারদলীয় সংসদ সদস্য। এ সময় হোটেলে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নষ্ট করার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা চুপ থাকেন। তবে বনানী থানার ওসি আবদুল মতিন বলেছেন, ফুটেজ একমাসের বেশি না থাকলেও আইটি বিশেষজ্ঞ দিয়ে তার উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে। সেখানে দেখা যায়, হোটেলের সিসিটিভির বাইরেও হোটেলে যাতায়াতকারীদের ফুটেজ রাস্তার একাধিক সিসিটিভির ক্যামেরায় ধারণ করা আছে। হোটেলে প্রবেশ গেটের ডান পাশের সড়কে অবস্থিত সড়ক বাতির স্ট্যান্ডে দুটি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো দেখা গেছে। এর একটি ক্যামেরা হোটেলে প্রবেশকারীদের দিকে তাক করা আছে। ধর্ষণের আগে ওই হোটেলে দুই তরুণীর সঙ্গে কারা প্রবেশ করেছিলেন, তার সবই ধারণ করা ছিল ওই ক্যামেরায়। র‌্যাবও এই ক্যামেরাগুলোর ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা করছে বলে জানা যায়।
×