ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সন্তান প্রসবে সিজার!

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১১ মে ২০১৭

সন্তান প্রসবে সিজার!

বাংলাদেশে সার্বিকভাবে চিকিৎসাসেবার মানসহ মানুষের গড় আয়ু বাড়লেও কিছু ক্ষেত্রে এখনও সমস্যা ও জটিলতা লক্ষ্য করা যায়। এরই অন্যতম একটি হলো প্রসূতিদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসবে একশ্রেণীর চিকিৎসকের অহেতুক ও অযৌক্তিক অনীহা। কেননা স্বাভাবিক প্রসবে জটিলতা ও খরচ অনেক কম। অন্যদিকে সিজার করা হলে রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে বেশি অর্থ আদায় করা যায়। কেননা তাতে গুচ্ছের খরচসহ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে বেশি সময় ধরে রাখা যায় মা ও শিশুকে। বলা যায়, এটিও একশ্রেণীর বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিকের ব্যবসায়িক মনোভাব। তাই বলে যে, সরকারী হাসপাতালেও একশ্রেণীর চিকিৎসকের মধ্যে এ জাতীয় মনোভাব লক্ষ্য করা যায় না, তা নয়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, দেশে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি এবং তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসাসহ পুরস্কৃত হলেও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে ‘সিজারিয়ান ডেলিভারি’র সংখ্যা। বাংলাদেশ মাতৃ মৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবার সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, মাতৃ মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৯৪ জন। ২০০১ সালে তা ছিল ৩২২ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুর জন্ম স্বাভাবিক অথচ বর্তমানে দেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসবের হার সরকারীভাবে ২৩ এবং বেসরকারী হিসাবে ৫৫ ভাগ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২০১৫ সালের তথ্য বলছে, হাসপাতালে জন্ম নেয়া প্রতি ১০০ শিশুর ৬০ জন প্রসবিত হয় সিজারের মাধ্যমে। এর মধ্যে ৩৬ জন বেসরকারী হাসপাতাল এবং ২৪ জন সরকারী হাসপাতালে জন্ম নেয়। অতঃপর অপ্রয়োজনীয় সিজার প্রসব বন্ধে জাতীয় সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সংসদ সদস্যরা। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে যে বয়সে নারীর বিয়েসহ গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের ঘটনা ঘটে, তাতে অন্তত অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরাপদ সন্তান প্রসব না হওয়ার কোন কারণ নেই। কিছু ক্ষেত্রে বাল্যবিয়েসহ মায়ের অপুষ্টিজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলেও তা তেমন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেই। তদুপরি বর্তমানে প্রায় প্রত্যেক উপজেলায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং প্রত্যন্ত এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এসব স্থানে মা ও শিশুসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও সেবা পাওয়া সম্ভব। প্রশিক্ষিত নার্স ও ধাত্রীরও তেমন সঙ্কট থাকার কথা নয়। বর্তমান সরকারের অনেক সমুজ্জ্বল সাফল্যের অন্যতম একটি দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিক। সম্প্রতি এটি পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংকের মতো সুবৃহৎ বহুজাতিক দাতা সংস্থার। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সার্বিক স্বাস্থ্য খাতের উন্নতিতে ‘অসাধারণ ভূমিকা’ রাখছে কমিউনিটি ক্লিনিক। স্বাস্থ্য খাতে অভাবনীয় উন্নতির উল্লেখ করে সংস্থাটি বলেছে, এটি সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেছে। এর ফলে নবজাতক ও শিশু মৃত্যু, মাতৃ মৃত্যু, প্রজনন হার নিয়ন্ত্রণসহ ১০টি সূচকে সন্তোষজনক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা এবং পুুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচীর সুবাদে সম্ভব হয়েছে এই অগ্রগতি। এর আওতায় ২০১৪ সাল থেকে দেশে ১৩ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। এর ফলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা নেয়ার হার ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) আওতায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার কমানোর জন্য সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ ২০১০ সালে জাতিসংঘের এমডিজি এ্যাওয়ার্ড অর্জনে সক্ষম হয়, যা বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল করে তুলেছে। বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে অবশ্য কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দারিদ্র্য, চিকিৎসা উপকরণের অভাব, বিভিন্ন রোগের প্রকৃতির পরিবর্তন ইত্যাদিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। নারী ও শিশুর অপুষ্টির কথাও বলা হয়েছে। তদুপরি নগরায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা তো আছেই। সে অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় প্রশিক্ষিত ধাত্রীসহ সেবার মান বাড়ানো গেলে নারীর প্রসবজনিত জটিলতা আরও কমে আসবে। অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান প্রসবের আর দরকার হবে না।
×