ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষ্ণা চক্রবর্তী যাত্রার একটি প্রদীপ নিভে গেল ॥ মিলন কান্তি দে ॥

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১১ মে ২০১৭

কৃষ্ণা চক্রবর্তী যাত্রার একটি প্রদীপ নিভে গেল  ॥ মিলন কান্তি দে ॥

জীবন যুদ্ধে হার না-মানা এক সাহসী নারী কৃষ্ণা চক্রবর্তী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন মরণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে। যাত্রাজগতের শেষ নিভু নিভু প্রদীপগুলোর মধ্যে একটি ছিলেন তিনি। সেই প্রদীপটিও হঠাৎ নিভে গেল। গত সোমবার বিকেল ৪-২৫ মিনিটে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে গেলেন বাংলাদেশের যাত্রার স্বনামধন্যা অভিনেত্রী, সংগঠক, দল মানিক কৃষ্ণা চক্রবর্তী। তাকে হারিয়ে গভীর শোকাহত যাত্রাশিল্পের মানুষরা। শোক প্রকাশ করেছেন রামেন্দু মজুমদার, মানুনুর রশীদ প্রমুখ নাট্যজন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী, যাত্রাব্যক্তিত্ব জ্যোৎস্না বিশ্বাস এবং বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সকল নেতাকর্মী। একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জের শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমির নাট্যব্যক্তিত্ব মানুনুর রশীদ ও যাত্রাভিনেত্রী কৃষ্ণা চক্রবতীকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। উদোক্তারা সেদিন যে দৃষ্টান্তমূলক কাজটি করেছিল সেটি হচ্ছে, কৃষ্ণা চক্রবর্তীর হাত দিয়ে মামুনুর রশীদের হাতে সংবর্ধনার ক্রেস্ট তুলে দেয়া। মামুন ভাই আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, ‘জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। আজ একজন যাত্রাশিল্পীর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করে নিজেকে ধন্য মনে করছি’। ওই অনুষ্ঠানে রামেন্দু মজুমদারও বক্তব্য রেখেছিলেন। কৃষ্ণা চক্রবর্তী ছিলেনÑ যাত্রামঞ্চের এক অদম্য নারী চরিত্র। ‘একানী’ অর্থাৎ শিশুশিল্পী থেকে নৃত্যশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী সহনায়িকা এবং সব শেষে ৮০ দশকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে একজন সফল নায়িকা। বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট থানার টাউন নওয়াপাড়ায় তার জন্ম ১৯৬৬ সালে, বাবা নিতাই চক্রবর্তীও ছিলেন যাত্রাশিল্পী। ছয় বছর বয়সে বাবার হাতে তার যাত্রার হাতে খড়ি। সেই থেকে বিরতিহীনভাবে ৪৫ বছর বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন গ্রাম বাংলার যাত্রামঞ্চে। কৃষ্ণা যেসব দলে অভিনয় করেছেন, সেগুলো হচ্ছে তুষার অপেরা, নিউ প্রভাস অপেরা, দিপালী অপেরা, প্রগতি নাট্য সংস্থা, নবরঞ্জন অপেরা। ১৯৯১ সালে স্বামী রতন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে তিনি গঠন করেন রামকৃষ্ণ যাত্রা ইউনিট। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে নিবন্ধন নিয়ে নিজের নামানুসারে গড়ে তোলেন কৃষ্ণা যাত্রা ইউনিট। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য পালার মধ্যে রয়েছেÑ ‘ডাইনী বধূ’, ‘কে ঠাকুর ডাকাত’, ‘দোষী কে’, ‘কোহিনূর’, ‘চরিত্রহীন’, ‘মা হলো বন্দি’ ও ‘দস্যু রানী ফুলন দেবী’। ফুলন দেবী চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। মুকুন্দ ঘোষ, অশোক ঘোষ এবং স্বপন কুমারের মতো দাপুটে নায়কদের পাশে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন কৃষ্ণা চক্রবর্তী। নারী শিল্পী হয়েও তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, যা ছিল তার সহজাত শিল্পনৈপুণ্যের প্রকাশ। সাংগঠনিক কর্মকা-েও তাকে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। যাত্রাশিল্পী যখন নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে বন্দি, সেই দুঃসময়ে তিনি গ্রামগঞ্জ থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছেন, যোগ দিয়েছে যাত্রার মিছিলে। সেøাগান দিয়েছেন- ‘যাত্রাকে ধ্বংস করা চলবে না’। ২০১৫ সালে তিনি বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। জীবনের শেষ দিনগুলো তার কেটেছে খুবই অর্থ সঙ্কটে। বাগেরহাট থেকে নেত্রকোনায় এসে স্থায়ী কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। স্বামী আগেই প্রয়াত হয়েছেন। একমাত্র অন্ধের যষ্টি ছিল পুত্র রাহুল চক্রবর্তী। দুর্ভাগ্য, স্কুলের শেষ পরীক্ষাও দিতে পারল না ছেলেটি। মা চলে গেলেন। বাংলাদেশ শিল্প একাডেমি সম্মান দিয়েছে কৃষ্ণা চক্রবর্তীকে। দল নিবন্ধনের জন্য আয়োজিত কয়েকটি যাত্রাউৎসবে তাকে জুরি বোর্ডের সদস্য করা হয়েছিল। সর্বশেষ গত বছরের নবেম্বরে অনুষ্ঠিত যাত্রা কর্মশালায় একটি যাত্রাপালা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তাকে। সাম্প্রতিক সময়ে শিল্পকলা একাডেমিসহ রাজধানীর সংস্কৃতির অঙ্গনে পরিচিত হয়ে উঠছিলেন তিনি। কৃষ্ণা চক্রবর্তীর দাবি ছিল যাত্রার নামে অশ্লীলতা বন্ধ করা এবং দুস্থ যাত্রাশিল্পীদের জন্যে স্থায়ী কল্যাণ তহবিল গঠন করা। জীবদ্দশায় এই দাবি পূরণ তিনি দেখে যেতে পারেননি। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করে শুধু এটুকু বলব- কৃষ্ণাদিদি, আমরা তোমার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাব। যে যাত্রায় তুমি সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলে, সেই শিল্পকে আমরা ধ্বংস হতে দেব না। কখনও না। তোমাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
×