ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর বিজয় নানা কারণে তাৎপর্যবাহী এবং গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এটি এ কারণে নয় যে, তিনি সে দেশের কনিষ্ঠতম প্রেসিডেন্ট অথবা প্রতিষ্ঠিত কোন রাজনৈতিক দলের ব্যানার ছাড়াই মেরি লি পেনকে সুস্পষ্ট ব্যবধানে হারিয়ে কাক্সিক্ষত অবস্থানে পৌঁছে গেছেন। বরং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটনা সত্ত্বেও, ইইউর সপক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ম্যাক্রোঁ যে ইউরোপীয় চিন্তা-চেতনা এবং আদর্শিক মূল্যবোধ সমুন্নত রেখেছেন- যা লি পেনের উগ্র স্বদেশ প্রেমের সস্তা সেøাগানকে ম্লান করে দেয়। এ বিষয়টি গভীর পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে।
ফ্রান্স তার নির্বাচনের আগে ব্রিটেনকে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ত্যাগ করতে দেখেছে। তারা যে সব যুক্তিতে ইইউ জোট ত্যাগ করেছে তার সবই ফরাসীরা জানত। কিন্তু তাদের মনে খটকা ছিল রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমীর পুতিন সমর্থিত লি পেন কে নিয়ে। কেননা, অনেকের বিশ্বাস মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়লাভের পিছনে পুতিনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল। ফ্রান্সেও যদি লি পেন ক্ষমতায় আসতে পারে তবে ফ্রেক্সিট ও ব্রেক্সিটে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্যে বিশাল ফাটলের সৃষ্টি হবে। এবং এর ফলে ন্যাটোসহ ইউরোপ দেশগুলোর প্রতিরক্ষা জোটগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোন সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পর ছিল ভøাদিমির পুতিনের আরেকটি নীল নক্শা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধভাবে সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে গেছে। কিন্তু অভিবাসী সঙ্কট ও অন্যান্য নানাবিধ সমস্যা সামনে এনে যুক্তরাজ্য গত বছর ব্রেক্সিটের পক্ষে গণভোট করে, ইইউ জোট থেকে আলাদা হয়ে যায়।
ফ্রান্সে ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী হামলা, অভিবাসী সঙ্কট, বেকারত্ব প্রভৃতি ইন্স্যুকে তুলে ধরে লি পেন যখন প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাত্র আড়াই শতাংশ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন তখন অনেকে এই ভেবে শঙ্কিত ছিলেন হয়ত ম্যাক্রোঁ দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে খুব একটা ভাল করতে পারবেন না।
কিন্তু ম্যাক্রোঁ সুস্পষ্টভাবে ফরাসীদের এই মর্মে আশ্বস্ত করলেন, একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের সঙ্গে আমরাও জোটবদ্ধ থাকব- তবে বর্তমান জোটে সংস্কার সাধন করতে হবে এবং ফ্রান্সের স্বার্থ সংরক্ষিত না হলে আমরা ই.ইউ জোট ত্যাগ করব।
ম্যাক্রোঁর এই ঘোষণা ফরাসীদের আশ্বস্ত করে। ইতোপূর্বে যারা তার পক্ষে ছিল নাÑ এমন দ্বিধাগ্রস্ত ভোটাররাও তাকে ভোট দেয়।
কিন্তু তার এই বিজয়ে উল্লসিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ফ্রান্সের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো চরম ডান পন্থী দল এক তৃতীয়াংশের বেশি ভোট পেয়েছে-যার নেতৃত্বে আছেন লি পেন। তার সমর্থক গোষ্ঠীর বেশিরভাগই দেশের বেকারত্ব, অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, সন্ত্রাসী হামলা ও মুসলিম অভিবাসী সমস্যার কারণে বর্তমান প্রশাসনের ওপর দারুণ ক্ষুব্ধ।
এখন ম্যাক্রোঁ যদি এসব সমস্যার আশু সমাধান না করতে পারেন, তবে অচিরেই তাকে লিপেন ছাড়াও অন্যান্য বিরোধী নেতাদের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে।
কিন্তু এক্ষেত্রে ম্যাক্রোঁর পথে প্রধান বাধা হবে পার্লামেন্ট। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত কোন রাজনৈতিক দল না থাকায় আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট নির্বাচনে তিনি তার দলের (এন মার্চে) সদস্যদের জয়ী করে আনতে পারবেন কী না তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
যদি পার্লামেন্টে লি পেন বা অন্য কোন প্রতিদ্বন্দ্বীদলের সংখ্যাধিক্য ঘটে তবে ম্যাক্রোঁর যে কোন উন্নয়নমূলক কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হবে। তখন বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় যারা তাকে ভোট দিয়েছিল তাদের মধ্যে হতাশা নেমে আসবে ম্যাক্রোঁর ‘এন মার্চে’ তখন ‘ব্যাক মার্চে’ পর্যবসিত বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন।
-নিউইয়র্ক টাইমস