ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩০ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাওড়বাসীর সুখ-দুঃখ

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১০ মে ২০১৭

হাওড়বাসীর সুখ-দুঃখ

(পূর্বপ্রকাশের পর) বন্যায় সিলেটের ১৩টি উপজেলার সব ক’টি হাওড়ের নিম্ন ও মধ্য এলাকার সকল বোরো ধান তলিয়ে গেছে। সিলেট জেলায় এবার বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৮৩ হাজার ৬৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ২৬ হাজার ৭১৫ হেক্টর জমির বোরো ধান সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়েছে। এর বাইরেও আংশিক কিছু ক্ষতি হয়েছে। আর অকাল বন্যার আগে সিলেটের তিনটি উপজেলায় শিলাবৃষ্টিতে প্রায় ৩৫৫ হেক্টর জমির বোরো ধান নষ্ট হয়ে গেছে। শিলাবৃষ্টিতে আক্রান্ত তিনটি উপজেলার মধ্যে রয়েছে বিয়ানীবাজার, সদর ও কোম্পানীগঞ্জ। সিলেটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে হাকালুকি হাওড়। প্রাণী অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাকালুকিতে মারা গেছে মাত্র ৩৬৭টি হাঁস। প্রতিটি হাঁসের গড় মূল্য ধরা হয়েছে ২৫০ টাকা। বন্যায় আক্রান্ত ৩ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত ১৫টি ইউনিয়নে ৬৭ হাজার ২২টি গরু, ১৫ হাজার ৭২টি মহিষ, ২১ হাজার ৮৬৫টি ছাগল, ২ হাজার ৭১৯টি ভেড়া, ২ লাখ ৬৬ হাজার ৮৯০টি মুরগি ও ৮৯ হাজার ৭৫৬টি হাঁস এবং ১৮ হাজার ৫শ হেক্টর চারণ ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া ১২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা মূল্যের পশু পাখির দানাদার খাদ্য ১২ হাজার ৯৩ মেট্রিক টন, ১২ কোটি ১৬ লাখ টাকা মূল্যের ৪৮ হাজার ৬৫২ মেট্রিক টন খড় এবং ১৮ কোটি ৭৯ লাখ ২ হাজার ৮০ টাকা মূল্যের ৯ হাজার ৩৯৩ মেট্রিক টন ঘাস নষ্ট হয়েছে। ৫৩ হাজার ৪০০ টাকার পশু-পাখি মারা গেছে। মৌলভীবাজারে বিভিন্ন হাওড়ের বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ফলে জেলায় বোরো ধানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে জেলার হাকালুকি হাওড়, হাইল হাওড়, সোনাদীঘি, কাওয়াদীঘির হাওড় ও কইরকোনা বিলসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০ হাজার ২৭৬ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গেছে। মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার কাঞ্জার হাওড়, মানিক হাওড়, হাইল হাওড় ও কাউয়াদীঘি হাওড় পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে আবাদকৃত ১০৪২৫ হেক্টর জমির মধ্যে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গেছে ৩৪৮ হেক্টর, শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওড় পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে আবাদকৃত ৯ হাজার ৫৬৬ হেক্টর জমির মধ্যে ২৫০ হেক্টর, রাজনগর উপজেলার সোনাদীঘি, কাইয়াদীঘি ও সিঙ্গাহুরা হাওড় পানির নিছে তলিয়ে গিয়ে আবাদকৃত ১৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমির মধ্যে ৯৮৭ হেক্টর, কমলগঞ্জ উপজেলার কেওলার হাওড় পানির নিছে তলিয়ে গিয়ে আবাদকৃত ৩ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমির মধ্যে ১০৯ হেক্টর, কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি হাওড়, ডলডল হাওড়, রফিনগর হাওড়, খাদিমপাড়া হাওড়, আলিয়ার হাওড়, বহিষমারা বলি, মেঘাবিল, হাওড় বিল, কালাপানির বিল, পালের বিল, হাগুয়া বিল ও লাউয়র বিলসহ অন্যান্য বিল পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে আবাদকৃত ৬ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমির মধ্যে ৩ হাজার ৩৯৬ হেক্টর, বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওড়, মালাম বিল ও হুয়ালা বলি পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে আবাদকৃত ৪ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমির মধ্যে ১ হাজার ৯৭০ হেক্টর, জুড়ি উপজেলা হাকালুকি হাওড় ও কইরকোনা বিল পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে আবাদকৃত ৫ হাজার ৪৭০ হেক্টের জমির মধ্যে ৩ হাজার ২১৬ হেক্টর। ॥ চার ॥ ধান মাছ জীববৈচিত্র্যকে বুকে আগলে রেখে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দ্বার উন্মুক্ত করে রেখেছে টাঙ্গুয়ার হাওড়। যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে সেখানে। দিগন্ত বিস্তৃত হাওড়, বিশাল জলরাশি, কিন্তু তা নদী বা সমুদ্রের মতো নয়, ধারণ করে আছে অন্য রকমের এক সৌন্দর্য। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির বিচরণ, আকাশে ওড়াউড়ি, কিচির-মিচির শব্দ, টলটলে স্বচ্ছ পানিতে মাছের দৌড়ঝাঁপ, সাজানো শ্যাওলা যেন সাগর তলার বাগান। নীল জল আর পাহাড়ের চোখ জুড়ানো অপরূপ দৃশ্য দেখা যাবে দৃষ্টি মেলে তাকালে হাওড়ে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলাস্থিত জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মিঠা পানির এ হাওড় বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা, প্রথমটি সুন্দরবন। ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। বর্তমানে মোট জলমহাল সংখ্যা ৫১টি এবং মোট আয়তন ৬৯১২.২০ একর। তবে নলখাগড়া বন, হিজল করচ বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওড়টির আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০০০০ একর। বর্ষায় এর পুরোটাই পানিতে ডুবে থাকলেও শীতে পানি কমতে থাকে। এর বড় একটা অংশ তখন শুকিয়ে যায় যায়। টাঙ্গুয়ার হাওড় প্রকৃতির অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ। এ হাওড় শুধু একটি জলমহাল বা মাছ প্রতিপালন, সংরক্ষণ ও আহরণেরই স্থান নয়। এটি একটি মাদার ফিশারী। হিজল করচের দৃষ্টিনন্দন সারি এ হাওড়কে করেছে মোহনীয়। এছাড়া নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলঞ্চা, শতমূলি, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদিসহ ২শ’ প্রজাতিরও বেশি গাছ-গাছালি রয়েছে এখানে। বর্তমানে এ হাওড়ে রয়েছে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৪১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ। নলখাগড়া বন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। শীত মৌসুমে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ব্যাপক পাখির আগমন ও অবস্থানে মুখরিত হয় টাঙ্গুয়ার হাওড়। স্থানীয় জাতের পাখি পানকৌড়ি, কালেম, বৈদর, ডাহুক নানা প্রকার বালিহাঁস, গাংচিল, বক, সারস প্রভৃতির সমাহারও বিস্ময়কর। সাধারণ হিসেবে বিগত শীত মৌসুমের প্রতিটিতে ২০/২৫ লাখ পাখি টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ছিল বলে অনুমান করা হয়। কোন কোন স্থানে কিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে শুধু পাখিদের ভেসে থাকতে দেখা যায়। টাঙ্গুয়ার হাওড় মাছ-পাখি এবং উদ্ভিদের পরস্পর নির্ভরশীল এক অনন্য ইকোসিস্টেম। মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের প্রধান দুটি পাখির অভয়ারণ্য হল লেউচ্ছামারা ও বেরবেড়িয়ার বিল। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের ঠিক মাঝখানটায় সুন্দর বিল হাতিরগাতা। এর চারপাশে রয়েছে বিলগুলো। শীতে হাতিরগাতার বেশিরভাগ এলাকাই শুকিয়ে যায়। কথিত আছে ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজরা শীতে শুকিয়ে যাওয়া মাঠে হাতি চড়াতে আসতেন বলেই এই নাম পেয়েছে জায়গাটি। কিভাবে যাবেন : দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে প্রথমে যেতে হবে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে। ঢাকা থেকে সড়ক পথে সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সায়েদাবাদ থেকে সড়ক পথে সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে সাহেববাজার ঘাট পর্যন্ত রিকশায়। বর্ষাকালে শহরের সাহেব বাড়ি নৌকা ঘাট থেকে ইঞ্জিন বোট বা স্পীড বোট যোগে সরাসরি টাঙ্গুয়া যাওয়া যায়। ইঞ্জিন বোটে ৫ ঘণ্টায় এবং স্পীড বোটে ২ ঘণ্টা সময় লাগে। দু-তিন দিনের জন্য নৌকা ভাড়া করে ভ্রমণ করা যায়। এছাড়া সুনামগঞ্জ শহরে প্রবেশের মুখে সুরমা সেতু থেকে লেগুনা কিংবা মোটরবাইকে যাওয়া যায় তাহিরপুর কিংবা সোলেমানপুর। কোথায় থাকবেন : বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় টাঙ্গুয়ার হাওড়ে রাত যাপনের কোন ব্যবস্থা নেই, তবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় ৩ কিঃ মিঃ উত্তর-পূর্বে টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পের রেস্ট হাউজে অবস্থান করা যায়। গ্রীষ্মকালে শহরের সাহেব বাড়ি খেয়া ঘাট পার হয়ে অপর পার থেকে প্রথমে মোটরসাইকেল যোগে দু’ঘণ্টায় শ্রীপুর বাজার/ডাম্পের বাজার যাওয়া যায়। চলবে... লেখক : সাংবাদিক
×