ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘কওমী সনদ যৌক্তিক নাকি রাজনীতি শীর্ষক’ বৈঠকে অভিমত

কওমী সনদের মাস্টার্স সমমান পাওয়া কি পেশী শক্তির পুরস্কার

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১০ মে ২০১৭

কওমী সনদের মাস্টার্স সমমান পাওয়া কি পেশী শক্তির পুরস্কার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কওমী সনদের সরকারী স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত দেশ ও শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য হুমকি। সাধারণ ও সরকার নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসায় ১৭ থেকে ২০ বছর পড়ালেখার পর মাস্টার্স সনদপ্রাপ্ত হলেও কওমী ধারায় মাত্র ৫ বছরে সনদ পেয়ে যাবে। এ স্বীকৃতি শাপলা চত্বরে উগ্রবাদী হেফাজতের পেশিশক্তি প্রদর্শনের পুরস্কার। যে শিক্ষায় মাতৃভাষা বাংলার প্রবেশ নেই, যেখানে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা রীতিমতো নিষিদ্ধ তার সনদের সরকারী স্বীকৃতি মানে উগ্র জঙ্গীবাদকে স্বীকৃতি দেয়া। এ সিদ্ধান্ত সরকার স্বীকৃত সাধারণ ছাত্রদেরও আলিয়া ছেড়ে উগ্রপন্থী কওমী নেসাবে উৎসাহী করবে। জাতীয় প্রেসক্লাবে মঙ্গলবার ‘কওমী সনদ যৌক্তিক নাকি রাজনীতি’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকে নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার ছাড়া কওমী সনদের স্বীকৃতির বিরুদ্ধে এভাবেই ঘোরতর আপত্তি তুললেন দেশের ইসলামী চিন্তাবিদ পীর মাশায়েকরা। সুফিবাদী সুন্নি সম্প্রদায়ের সংগঠন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত ঢাকা মহানগর আয়োজিত এ বৈঠকে তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। তারা জঙ্গীবাদবিরোধী অবস্থানে সরকারের সঙ্গে সহমত পোষণ করলেও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ভোটের রাজনীতির অংশ হিসেবে উগ্রবাদী চিহ্নিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হেফাজতের সঙ্গে আপোস করেছে সরকার, যা দেশের জঙ্গীবাদকে উৎসাহিত করবে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় জঙ্গী হামলায় কওমীদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অথচ তাদের শাস্তি না দিয়ে আলিয়া ধারাকে ধ্বংসের উদ্যোগের অংশ হিসাবে কওমী সনদের স্বীকৃতি দিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার সঙ্কট ছাড়াও দেশে ধর্মীয় সংঘাত সৃষ্ট্রিও আশঙ্কা করেছেন বক্তারা। সংগঠনের ঢাকা জেলা সমন্বয়ক পীরে তরিক্বত আল্লামা শাহ আহছানুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার। বক্তব্য রাখেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত ঢাকা জেলার সদস্য সচিব আল্লামা আনম মাসউদ হোসাইন আল-কাদেরী, সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি, পীরে তরিক্বত মাওলানা জামাল উদ্দীন মোমেন, আজকের সূর্যোদয়ের প্রধান সম্পাদক খোন্দকার মোজাম্মেল হক, অধ্যক্ষ আবু জাফর মুহাম্মদ হেলাল উদ্দীন, কাজী মুহাম্মদ সোলায়মান চৌধুরী, উপাধ্যক্ষ আবুল কাসেম ফজলুল হক, অধ্যাপক এম এ মোমেন, সৈয়দ মুজাফ্ফর আহমাদ, মুহাম্মদ আবদুল মতিন, মুহাম্মদ আবদুল হাকিম, উপাধ্যক্ষ মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ আবু হানিফ, এ্যাডভোকেট আলী আজম, এ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দীন, এ্যাডভোকেট নুরুল হুদা আনছারী, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার সভাপতি ছাদেকুর রহমান খান, মুহাম্মদ মাসুদ হুসাইন, অধ্যক্ষ মাওলানা সাইফুল ইসলাম বাগদাদী, কামরুল ইসলাম আখন্দ, মোবারক হুসাইন, ইমরান হুসাইন তুষার প্রমুখ। সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, হঠাৎ কওমী মাদ্রাসার ‘দাওরায়ে হাদিস’ নামক একটি স্তরকে কোন ধরনের যাচাই, একাডেমিক পর্যালোচনা এবং সরকারী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ছাড়া যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই সাধারণ শিক্ষার সমমান ঘোষণা করা হয়েছে। সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি কমিটিন প্রধান হলেন হেফাজতের আমির মাওলানা আহমদ শফি। এছাড়া অন্যান্যেরও অধিকাংশই হেফাজত নেতা আর কওমী প্রতিনিধি। সরকারের কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে না এ কমিটি। তারা তাদের মতো করে পাঠ্যক্রম ও প্রশ্ন প্রণয়নসহ যাবতীয় প্রাসঙ্গিক কাজ করার চূড়ান্ত ক্ষমতা লাভ করেছেন। উনারাই উনাদের সনদ নেবেন। সেখানে সরকারের কোন মাথাব্যথা থাকবে না। তিনি আরও বলেন, একই মানের মাস্টার্স সনদ পাওয়ার জন্য সাধারণ ও মাদ্রাসার অপরাপর শিক্ষার্থীর পঞ্চম, অষ্টম, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, অনার্স প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ বর্ষ তার পর মাস্টার্স অর্থাৎ মোট নয়বার সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন পাবলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক। অথচ কওমীতে তার দরকার নেই। আবার নয়বারের কঠিন পরীক্ষায় পাস করার পরও সরকারের আনুগত্যাধীন মাস্টার্স সনদধারীরা চাইলেই সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা চাকরি করতে পারেন না। এ জন্য দরকার আরও একটি প্রতিযোগিতামূলক পাবলিক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করে নিবন্ধিত হওয়া। তারপর দিতে হবে সরকারী প্রতিনিধিদের সামনে আরও একটি নিয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষা। আর সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিসিএসসহ কঠিন পরীক্ষা তো আছেই। অথচ এসব পরীক্ষা থেকে হেফাজত নিয়ন্ত্রিত কওমীরা থাকবে মুক্ত এবং স্বাধীন। আল্লামা আনম মাসউদ হোসাইন আল-কাদেরী বলেন, মাস্টার্স সনদ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়, আর এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। কিন্তু কওমীরা কারও নিয়ন্ত্রণে নয়, স্বাধীন থেকে নিজেদের সনদ নিজেরা নেবে, এটা কেমন আইন? কোন ধরনের যাচাই-বাছাই না করে তাদের সৃষ্ট বোর্ড কর্তৃক মাস্টার্সের মান দেয়া সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অশনি সঙ্কেত ও হুমকিস্বরূপ। উপাধ্যক্ষ আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী সনদ দেয়ার অধিকার পান উচ্চ শিক্ষার সনদধারীরা সেখানে কওমী সনদ দেবেন এমন ব্যক্তিরা যাদের নিজেদের না আছে স্বীকৃত কোন সনদ, না আছে কোন প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা, যাদের আনুগত্যের কোন ইতিহাস নেই তাদের ভি আই পি মর্যাদার সনদ দেয়া হচ্ছে। এটা ২০১৩ সালের ৫মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের পেশিশক্তি প্রদর্শনীর পুরস্কার ছাড়া কিছুৃই নয়। আজকের সূর্যোদয়ের প্রধান সম্পাদক খোন্দকার মোজাম্মেল হক কোন নিয়ন্ত্রক ছাড়া, সংস্কার ছাড়া কওমীর স্বীকৃতির বিরোধিতা করে বলেন, যে শিক্ষায় মাতৃভাষা বাংলা নেই, যেখানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না, জাতীয় পতাকা টানানো হয় না! তার সনদের সরকারী স্বীকৃতি কেন? কি কারণে তড়িঘড়ি ৪৮ ঘণ্টায় গেজেট প্রকাশ করতে হলো তার ব্যাখ্যা দিতে হবে সরকারকে। তিনি বলেন, শিক্ষা হতে হবে এককেন্দ্রিক। সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি বলেন, বর্তমানে অন্যান্য শিক্ষাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে। যথাযথ জ্ঞানার্জন ছাড়া তাদের মার্স্টাস সার্টিফিকেট দেয়া হবে। তিনি সৌদি আরবের শীর্ষমানের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস ও কারিকুলাম অনুরণের আহ্বান জানান। সুপ্রীমকোর্টের এ্যাডভোকেট আবু আজাদ বলেন, কওমী সনদের স্বীকৃতি দেয়ার আগে সরকার শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা না করেই স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এ বিষয়ে আদালতে একটি রিট করা হবে বলেও তিনি জানান। কোন নিয়ন্ত্রক ও সংস্কার ছাড়া এভাবে সনদের স্বীকৃতি দিয়ে অন্যান্য শিক্ষা ধারাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। এভাবে কারও সরকারী স্বীকৃতি কল্পনা করা যায় না। অন্যান্য ইসলামী নেতা, পীর মাশায়েখরা একই অবস্থার কথা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গী হামলায় হেফাজত নিয়ন্ত্রিত কওমীদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ সরকারের কাছে ছিল বলে বিভিন্ন সময় দাবি করা হয়। অথচ তাদের শাস্তি না দিয়ে শান্তিবাদী আলিয়া ধারাকে ধ্বংস করতে কওমী সনদের স্বীকৃতির মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়েছে। বক্তারা কওমীদের সঙ্গে এই আপোসের ফলে সরকারের জঙ্গীবিরোধী কার্যক্রম নিয়ে জনগণের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন এবং এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার অনুরোধ জানান। অন্যথায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন সুন্নি নেতারা।
×