ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যৌনপল্লী থেকে জয়িতা- এক মর্জিনার প্রতিবাদের কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১০ মে ২০১৭

যৌনপল্লী থেকে জয়িতা- এক মর্জিনার প্রতিবাদের কাহিনী

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ অন্ধকার গলির শিশুদের আলোর পথ দেখাতে সাহায্য করছে ‘মুক্তি মহিলা সমিতি’। দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে এগিয়ে এসেছেন যে নারী তার নাম মর্জিনা বেগম। তিনি গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায় অবস্থিত যৌনকর্মীদের সংগঠন মুক্তি মহিলা সমিতির নির্বাহী পরিচালক। বর্তমানে ১৮০ শিশু তার এই সমিতির মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। ২ থেকে ৫ বছরের শিশুদের হাতেকলমে শিক্ষা দেয়া হয় এখানে। এরপর শিশুদের স্কুলগামী করতে সাহায্য করে এই সমিতি। ২০০৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যৌনপল্লীর ৫০০ শিশুকে শিক্ষামুখী করে স্কুলগামী করেছে মর্জিনার ‘মুক্তি মহিলা সমিতি’ । নিজেও একজন যৌনকর্মী ছিলেন মর্জিনা। কিন্তু নিজের পায়ের শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন অন্ধকার গলি থেকে। নিজ উদ্যোগে যৌনপল্লীর মিশুদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে গড়ে তুলেছিলেন ‘মুক্তি মহিলা সমিতি’। পঞ্চম শ্রেণী পাস এই নারী নিজে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হলেও সমাজের অসহায় শিশুদের শিক্ষার জন্য কাজ করে চলছেন। তার এই অসামান্য অবদানের জন্য সম্প্রতি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক জয়িতা সম্মাননা পেয়েছেন মর্জিনা। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মর্জিনা তার স্বপ্ন পূরণে আজ সফল। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তার এই অবদান শিক্ষিত সমাজ গড়তে অনেকটাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু কিভাবে তিনি জয়িতা হয়ে উঠলেন? মর্জিনা জনকণ্ঠকে বললেন, ‘১৩ বছর বয়সে ফরিদপুরের টেকেরহাট এলাকার আসবাবপত্রের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবদুর রবের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন তিন সন্তানের বাবা। আমি ছিলাম তার দ্বিতীয় স্ত্রী। স্বামীর বাড়ির নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নানাবাড়ি চলে যাই। একদিন স্বামী রব তাকে ফেলে চলে যান। কয়েক মাস পর ১৯৮০ সালে নানাও মারা যান। বাধ্য হয়ে পিঠা বিক্রি করে জীবন শুরু করি। কিছুদিন পর দালালের খপ্পরে পড়ে বিক্রি হয়ে যাই সিরাজগঞ্জ যৌনপল্লীতে। ১৯৮৮ সালে আমি ফিরে আসি দৌলতদিয়া ঘাটে। এখানকার যৌনপল্লীতে আসার পর স্থানীয় দালালসহ সমাজের নানাস্তরের মানুষের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের মুখোমুখি হতে থাকি। শুধু আমি নই, সেখানকার যৌনকর্মীরা হরহামেশাই নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। কিন্তু আমি কখনও মুখ বুজে থাকিনি। সমস্যার সমাধানে আমি অন্যান্য যৌনকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবেলা করতে শুরু করি। যৌনকর্মীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আমি রুখে দাঁড়িয়েছি। ১৯৯৫ সালে আমি স্থানীয় বেসরকারী সংস্থা কেকেএসে যোগ দিই। ২১ যৌনকর্মী নিয়ে সেভ দ্য চিলড্রেন অস্ট্রেলিয়া এবং কেকেএস যৌথভাবে তাদের নিয়ে নেতৃত্ববিষয়ক দল গঠন, অধিকার আদায়সহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। সেখান থেকে আমি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এর পর ১৯৯৮ সালে যৌনপল্লীর সমস্যা সমাধানে ১১ জন মিলে একটি সমিতি গঠন করি। এর নাম দেয়া হয় মুক্তি মহিলা সমিতি (এমএমএস)। ১৯৯৯ সালে সমাজসেবা অধিদফতর থেকে সমিতির নিবন্ধন পাওয়ার পর যৌনকর্মীর সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা, স্বাস্থ্যসেবা, ভোটাধিকার প্রয়োগসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করি। এ জন্য অবশ্য একাধিকবার জেলহাজতেও থাকতে হয়েছে আমাকে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সেক্স ওয়ার্কার নেটওয়ার্ক অব বাংলাদেশ সদস্যপদ এবং ২০০৯ সালে এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন পায় সংগঠনটি। এরপর থেকে এগিয়ে যাচ্ছে এই সমিতি। শুধু যৌনপল্লীর শিশুদের শিক্ষাই নয় বরং সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে ‘মুক্তি মহিলা সমিতি’। সচেতনতামূলক নাটক থেকে শুরু করে যৌনকর্মীদের অধিকার আদায়, ব্যক্তিগত সঞ্চয়, এইডসের ভয়াবহতা তুলে ধরা, মাদকের বিরুদ্ধে সেমিনার, শিশু শিক্ষায় সবাইকে জাগিয়ে তোলা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন করে থাকে মুক্তি মহিলা সমিতি। ২০১১ সালে দৌলতদিয়া শিশু সুরক্ষা প্রকল্প (ডিসিপিপি) নামে পাইলট প্রকল্পসহ ২০১২ সালে সক্ষমতার উন্নয়ন, সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেটওয়ার্কিং সভা, শিশু সুরক্ষা কমিটিকে সহায়তা প্রদান, চাইল্ড ক্লাব প্রতিষ্ঠা, উদ্ধার, এ্যাডভোকেসি, নিউট্রিশন সাপোর্টসহ অপরাজিত নামের আরেকটি প্রকল্প চালু করে এই সমিতি। বর্তমানে মোট তিনটি প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এই সমিতি। ২০১০ সালে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় ৩৫০ শিশুকে নিয়ে শিক্ষা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচীতে যুক্ত থাকে সংগঠনটি। শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে সম্মাননা পাওয়ার পর থেকে সমাজের প্রতি আরও দায়িত্ব বেড়ে গেছে বলে জানালেন মর্জিনা বেগম। তিনি বলেন, শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা পাওয়ায় দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। নারীরা যদি সচেতন হয়, তাহলে সোনার বাংলা গড়া সম্ভব। ২০০৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যৌনপল্লীর ৫০০ শিশুকে শিক্ষামুখী করতে পেরেছি। আমাদের এখান থেকে শিশুদের হাতেকলমে পড়ালেখা শেখানো হয় খেলার ছলে। এরপর তাদের স্কুলগামী করাও আমাদেরই দায়িত্ব। এজন্য আমরা তাদের মায়েদের আগে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোঝাই। তারপর তাদের মায়েদের ইচ্ছাতেই তারা আমার এখানে আসে। বর্তমানে যৌনকর্মীরাও তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে স্কুলে পাঠাচ্ছে। কারণ, তারা এখন একটু হলেও বুঝতে চেষ্টা করছে অন্ধকারের মাঝেই তো আলোর রেখা ফুটে ওঠে। চেষ্টা করলে এসব শিশুও একদিন মানুষের মতো মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে। ভবিষ্যতে অবহেলিত এসব শিশুকে নিয়ে আরও কাজ করতে চাই। তাদের মধ্যে আলো ছড়িয়ে দিতে চাই। মানুষ, রাষ্ট্র, বিশ্ববাসী যেন জানতে পারে, এ রকম শিশুরা এখানে বসবাস করে। বর্তমানে মর্জিনা বেগম রাজবাড়ি উপজেলার গোয়ালন্দ বাজারের পাশে একটি বাড়িতে তার মেয়েকে নিয়ে থাকেন। অন্ধকার পল্লীর শিশু হিসেবে গড়ে ওঠা তার মেয়েটিও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু মায়ের সহযোগী হিসেবে অবদান রাখছে সে। মা-মেয়ের সংসারে তারা একে অন্যকে উৎসাহ প্রদান করেন। জয়িতা হওয়ার পর মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় থেকে কোন বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে মর্জিনা বললেন, শ্রেষ্ঠ জয়িতার স্বীকৃতি পাওয়ার পর সনদপত্র, ক্রেস্ট ও নগদ ৪৫ হাজার টাকা পেয়েছি। কিন্তু এরপর এখনও সেখান থেকে আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ করা হয়নি। তবে তারা আমাকে যে সম্মাননা দিয়েছেন তাতেই আমি খুশি। মুক্তি মহিলা সমিতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমার মূল লক্ষ্য।
×