ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ তিনদিনেও ধরতে পারেনি দুই ছাত্রী ধর্ষণ মামলার আসামিদের

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১০ মে ২০১৭

পুলিশ তিনদিনেও ধরতে পারেনি দুই ছাত্রী ধর্ষণ মামলার আসামিদের

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে নিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণ মামলার আসামিদের অবস্থান পুলিশ তিনদিনেও নিশ্চিত হতে পারেনি। মঙ্গলবার সকালে এ মামলা অন্যতম আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদকে (২৬) গুলশানের বাড়িতে খুঁজে পায়নি। এমনকি তার পাসপোর্টটি যাওয়া যায়নি। তবে পুলিশ অভিযোগ করেন, সাফাত বাসায় আছেন বলে তার বাবা দিলদার আহমেদ দাবি করে এলেও তিনি সঠিক তথ্য দিচ্ছেন না। তিনি পুলিশ অসহযোগিতা করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ধর্ষণ মামলার করার পর থেকে আসামিদের অজানা কাহিনী বেরিয়ে আসছে। এদিকে ঘটনার দিনে হোটেলে ধর্ষণের ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামরার ফুটেজ পায়নি পুলিশ। মঙ্গলবার বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে গুলশান-২ এর ৬২ নম্বর রোডের আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাতকে খুঁজতে তার গুলশানের ‘আপন ঘর’ নামের ডুপ্লেক্স আলিশান বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায়। বনানী থানার এসআই রিপন কুমার ও এসআই মিল্টন দত্তের নেতৃত্বে ছয় জন পুলিশ ওই বাড়িতে ঢুকে টানা দেড় ঘণ্টা তল্লাশি চালায়। বাড়িটির হোল্ডিং নম্বর এন ডব্লিউ (সি)। অভিযান শেষে দুপুর একটায় তারা বাসা থেকে বের হয়ে আসে। দুপুর ১২টা ৫৮ মিনিটে বের হয়ে এসে এসআই রিপন কুমার সাংবাদিকদের জানান বাসায় সাফাতকে পাওয়া যায়নি। সেখানে সাফাতের বিভিন্ন জিনিসপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। পাসপোর্ট খোঁজা হলেও তা পাওয়া যায়নি। তারা জানান, সোমবারও পুলিশ সাফাতের বাড়িতে রেইড দিয়েছিল। তবে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সাফাতসহ মামলার অন্য আসামিদের ধরার জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযান শেষে দুপুর দেড়টার দিকে সাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে তিনি জানান, বেলা ১১টার পর থেকে পুলিশ আমার গুলশানে বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। এমনকি সাফাতের নানা বাড়ি সিলেটেও ডিবি পুলিশ মঙ্গলবার অভিযান চালিয়েছে। তিনি জানান, সে বাসায় নেই। সোমবার সকালে থেকে ছেলে সাফাত বেরিয়ে গেলে আর ফিরে আসেনি। এখন সে কোথায় আছে আমি জানি না। এ সময় তিনি শুধু বলেন, আমার ছেলে ব্ল্যাকমেইলের শিকার। এরপর সাংবাদিকদের আর কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যান। এ সময় তার গাড়ির ধাক্কায় দুজন সংবাদ কর্মী আহত হন। এদিকে ঘটনাস্থল গুলশান হওয়ায় মার্কিন দূতাবাস থেকেও এক কর্মকর্তা এসে ঘটনার খোঁজখবর নেন। বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল মতিন জানান, সাফাতের বাসায় পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। তার বাবা মিথ্যা বলেছেন। উনি হয়ত ভেবেছেন, পুলিশ তদন্তে কোন প্রমাণ পায়নি বলে তাকে এখনও গ্রেফতার করেনি। সে বাসায় আছে বললে হয়ত তাকে সবাই নির্দোষ ভাববে বলে ভেবেছেন। পরিদর্শক আব্দুল মতিন বলেন, আমি পাঁচ থেকে ছয়বার সাফাতের বাসায় গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। সাফাত বাসায় নেই। সে কোথাও পালিয়ে আছে। তাকে খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। এদিকে গুলশানে আপন জুয়েলার্সের মালিকের বাসা ‘আপন ঘর’র কেয়ারটেকারের মেহেদী হাসান জানান, রবিবার দুপুরে সর্বশেষ নিজের বিএমডব্লিউ গাড়িতে চড়ে সাফাত স্যার বাসায় আসেন। রাতে ওই গাড়িতে তিনি বাসা থেকে বের হন। এরপর স্যার আর বাসায় ফেরেননি। মামলা দায়েরের পর একবারই তিনি বাসায় আসেন। কেয়ারটেকার মেহেদী হাসান জানান, পুলিশ নিজেদের মতো করে বাড়ি তল্লাশি করেছে। সাফাত স্যার সর্বশেষ কবে বাসায় এসেছেন, তার সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছে- এসব বিষয়ে পুলিশ আমার কাছে জানতে চান। আমি যা জানি পুলিশকে তাই জানিয়েছি। ভাইবারে আসামি সাদমান সাকিফের সঙ্গে বাদীর কথোপকথনের স্কিনশট ঘটনার পর থেকেই ওরা নানাভাবে আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে ওদের সঙ্গে আপস করে ফেলতে। নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, আমরা মেয়ে, আমাদের ভবিষ্যত রয়েছে। পরিবারে মুখ দেখাতে পারবে না। বাদী জানান, ঘটনার পর তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য পিকাসো রেস্টুরেন্টেও নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে তাদের বিষয়টি নিয়ে মুখ না খোলার নির্দেশ দেয়া হয়। এ ঘটনার পর গত ৩১ মার্চ অনলাইন যোগাযোগ এ্যাপ্লিকেশন ভাইবারে মামলার তিন নম্বর আসামি সাদমান সাকিফের সঙ্গে বাদীর কথোপকথনের স্কিনশট দেখা যায়, সাকিফ বাদীকে বলে এসব কথা বলে কী লাভ? কারও কিছু হবে না। তখন বাদী তাকে বলেন, আমি বের হতে চাচ্ছিলাম। তোমার সামনেই আমাদের বন্ধুর গাড়ির চাবি আটকে রেখেছে। সাকিফ তখন তাকে বিষয়টি চেপে যাওয়ার জন্য বলে, সবার আরও সমস্যা হবে। বাদী তখন সাকিফকে বলেন, ‘তুমি এসব নিজের চোখে দেখেছ। সবার সমস্যা হয় হোক। কিন্তু ওর শাস্তি পেতেই হবে। আমি ওদের কাউকে ব্ল্যাকমেইল করছি না। সাকিফ তখন তাকে বলে, তুমি একটা মেয়ে, তোমার সামনে লাইফ আছে। বাদী তখন তার কাছে জানতে চান, ওরা কেন মিথ্যা বলতেছে? সাকিফ তখন ধর্ষকদের পক্ষে সাফাই গেয়ে তাকে বলে, যা হইছে নিজেদের মধ্যে রাখো, তোমার ফিউচারে বিয়ে করতে হবে, হবে আমাদের সবার। এই কথোপকথনের অন্য আরেকটি স্কিনশটে দেখা যায়, আমাদের সঙ্গে ওরা যা করেছে সেটা আরও অনেক মেয়ের সঙ্গেই করতে পারে। ওরা আমাকে বের হতে দেয়নি। ধর্ষণ মামলার এই বাদী বলেন, নানাভাবে আমাকে বলা হয়েছে ২৮ মার্চের ঘটনা নিয়ে কাউকে কিছু জানালে আমাদের আরও খারাপ হবে। তিনি বলেন, সাকিফের মাধ্যমেই সাফাত এবং নাঈমের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। সাকিফকে দিয়েই ওরা আমাদের সঙ্গে আপসের চেষ্টা করেছে। সাদমান সাকিফ তখন লেখেন, তোমার কী মনে হয় না, উনি আরও খারাপ কিছু করবে, এসব বলে তাকে ক্ষেপালে? বাদী তখন লেখেন, সাকিফ, খারাপ কিছু আর কী করবে আমার? যা করার করছে, মাইরা ফেলুক, কিন্তু আমি আর থামব না। বাদী বলেন, আমাদের নানাভাবে ওরা হুমকি দিয়ে আসছিল। সেদিনের ঘটনা যদি সবাইকে জানাতাম তাহলে পরিবার বিব্রত হতো, ভেবেছিলাম আমাদের যা হওয়ার হয়েছে কিন্তু যখন তারা ভিডিও ছেড়ে দেয়ার কথা জানায় তখনই আমরা আইনের আশ্রয় নেই। ৮ মে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন গিয়েছিলেন। বাদী বলেন, তাকে নিয়ে প্রথমে আমি ছাদে গিয়েছি। যেখানে যেখানে যা যা হয়েছে সব দেখিয়েছি। যেখান থেকে দাঁড়িয়ে ড্রাইভার বিল্লাল ভিডিও করিয়েছে সেটাও দেখিয়েছি। বাদী জানান, আমি আমাকে বাঁচাতে পারিনি। পারিনি বন্ধুকে বাঁচাতে। সারাজীবনের জন্য বন্ধুর কাছে অপরাধী হয়ে রইলাম আমি,’ বলেন তিনি। হোটেলে সিসি ক্যামেরায় ফুটেজ রাখেনি জন্মদিনের পার্টিতে বন্ধুদের যোগসাজশে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনার দিনের ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামরার ফুটেজ রাখেনি বনানীর হোটেল কর্তৃপক্ষ। বনানী থানা পুলিশ জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক হোটেল টুরিজম আইনের দোহাই দিয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষ সেই দিনের কোন ফুটেজ রাখেনি। যে কারণে ফুটেজ সংগ্রহ করতে গিয়ে খালি হাতে ফিরেছে পুলিশ। অন্যদিকে হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৩০ দিনের বেশি সময়ের ফুটেজ তারা রাখেন না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক হোটেল টুরিজম আইনেও ৩০ দিনের বেশি সময়ের কোন ফুটেজ রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে কেউ যদি কোন ঘটনায় সুনির্দিষ্ট সময় ও তারিখ উল্লেখ করে অভিযোগ করে তবে তা আলাদা করে রাখা হয় বলে জানিয়েছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। উল্লেখ্য, এই বাদী তার বান্ধবীসহ গত ৬ মে বনানী থানায় ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২৮ মার্চ পূর্ব পরিচিত সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ ওই দুই তরুণীকে জন্মদিনের দাওয়াত দেয়। এরপর তারা তরুণী ছাত্রীদের বনানীর কে-ব্লকের ২৭ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বরে হোটেলে নিয়ে যায়। এজাহারে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, সেখানে জন্মদিনের অনুষ্ঠান চলাকালীন দুই তরুণীকে হোটেলের একটি কক্ষে আটকে রেখে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ধর্ষণ করে সাফাত ও নাঈম। আর সাফাত ও নাঈমের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়েছিল পূর্ব পরিচিত বন্ধু সাদমান সাকিফ। সেদিন সাকিফের সঙ্গে পরিকল্পনা করেই অভিযুক্তরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে এবং সাকিফ তাদের সেখানে ফেলে চলে আসেন বলেও জানান এই তরুণী।
×