ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মৌলবাদীদের উত্থানের প্রতিবাদ জানালেন ৪শ’ ৮ বিশিষ্ট জন

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৯ মে ২০১৭

মৌলবাদীদের উত্থানের প্রতিবাদ জানালেন ৪শ’ ৮ বিশিষ্ট জন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণ, পহেলা বৈশাখের ওপর আক্রমণ, অপপ্রচার, ভাস্কর্য অপসারণ, কওমী মাদ্রাসাকে অন্যায্য মর্যাদাদানসহ উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে সরকারের আত্মসমর্পণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। তারা বলছেন, এসব ঘটনায় ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক মানুষ ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও হতাশ। সোমবার উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কামাল লোহানী স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো ৪০৮ জনের বিবৃতিতে এ উদ্বেগের কথা জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দেশের বেশ কিছু ঘটনা আমাদের উৎকণ্ঠিত করেছে। পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিজাত পরিবর্তন, নববর্ষ ও মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে আক্রমণ, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান সংকুচিত করা, ভাস্কর্য অপসারণের দাবি, কওমী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান দেয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের আপোস ও আত্মসমর্পণের ঘটনায় দেশের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক মানুষ ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও হতাশ। এ বছর প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে যে পরিবর্তনগুলো করা হয়েছে তা স্বাভাবিক নিয়ম মেনে হয়নি একথা উল্লেখ করে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পাঠ্যপুস্তকের ১৩ জন সম্পাদক গণমাধ্যমে দেয়া বিবৃতিতে জানিয়েছেন এই পরিবর্তনগুলো করা হয়েছে তাদের অজান্তে। পাঠ্যপুস্তকের এই সাম্প্রদায়িকীকরণের ঘটনা বছরের প্রথম দিনেই বিনামূল্যে সকল শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য ম্লান করে দিয়েছে। ছাপার ভুল, বানান-তথ্য-ইতিহাসের বিকৃতির ঘটনাগুলোকে প্রাথমিকভাবে দায়িত্বে অবহেলা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হলেও, ধীরে ধীরে বের হয়ে এসেছে এসব বিকৃতির পেছনের অভিসন্ধি। পশ্চাৎপদ ও মৌলবাদের তোষণনীতির কারণেই পাঠ্যপুস্তকে এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে। এর পেছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ভয়ানক বিস্তার রয়েছে, তা গত কয়েক বছর ধরেই স্পষ্ট। এ বছরের পাঠ্যপুস্তকের এই পরিবর্তন সেই সাম্প্রদায়িক অপ-রাজনীতির সঙ্গে সরকারের আপোস রফারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। হেফাজতে ইসলাম শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ছবি আঁকার পাঠ তুলে দিতে চায়। তারা দাবি তুলেছে, পঞ্চম শ্রেণীর পর ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে ক্লাস করা নিষিদ্ধ করতে হবে। হেফাজতের দাবি মেনে নিয়ে পাঠ্যপুস্তকের ব্যাপক পরিবর্তনের পর এরই মধ্যে নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার রচনা সিলেবাস থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এভাবে একের পর এক সমাজে শিক্ষা, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয়করণ করে জঙ্গীবাদের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। তাই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে এই ঘৃণ্য বিকৃতির বিরুদ্ধে আমাদের যেমন কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা আবশ্যক, তেমনি সরকারেরও উচিত রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঘাপটি মেরে থাকা মুখোশধারী মৌলবাদী ও স্বাধীনতা-বিরোধী ভাবাদর্শের ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তি প্রদান করা। উগ্র সাম্প্রদায়িক এই চিহ্নিত গোষ্ঠী ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে এমন দাবি করে নেতৃবৃন্দ বলেন, কেবল বিরোধিতা নয়, তারা বিদেশী কায়েমী স্বার্থ, সা¤্রাজ্যবাদ আর হানাদার বাহিনীর দোসর রূপে এদেশের মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল। সেই চিহ্নিত গোষ্ঠী পঁচাত্তর পরবর্তী সরকারগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আনুকূল্য পেয়ে আজ দানবে পরিণত হয়েছে। জামায়াত-হেফাজত ইত্যাদি পৃথক পরিচয়েও তাদের উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন। আর সেটা হচ্ছে পাকিস্তানী ধারায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নেয়া। আজ একথা স্বীকার করতে হবে যে, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে এই অপশক্তি অনেকটাই সফল হয়েছে। নেতৃবৃন্দ বলেন, সরকার নিজেকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতাবিরোধী বলে প্রচার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চাকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বললেও, পাঠ্যপুস্তকে কেন এই পশ্চাদপসারণের চিত্র? এই পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে যে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তাতে দেশের অসাম্প্রদায়িক বিবেকবান মানুষ ক্ষুব্ধ। আমরা এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি। সম্প্রতি কওমী মাদ্রাসার ‘দাওরায়ে হাদিস’কে স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্সের সমমানের সরকারী স্বীকৃতি এবং সুপ্রীমকোর্টের প্রবেশ মুখে নির্মিত ন্যায় বিচারের প্রতীক ভাস্কর্য অপসারণের দাবি দেশের অসাম্প্রদায়িক মানুষকে গভীর ভাবে উৎকণ্ঠিত ও বিচলিত করেছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। ‘প্রশ্ন হলো, যে কওমী মাদ্রাসার কারিকুলাম ও পাঠ্যসূচীতে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তাহলে কোন্ বিবেচনায় মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দেয়া হলো? এই হেফাজতপ্রীতি কোন্ বাংলাদেশের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যে ব্যক্তি ঘোষণা দিয়েছেন মেয়েদের ততটুকুই পড়ালেখা জানা দরকার যতটা শিখলে স্বামীদের পকেটের টাকার হিসাব রাখতে পারা যাবে। নারীদের ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রাখার কথা বলে তাদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা পর্যন্ত করেছেন বিকৃত রুচির ব্যক্তিটি। দেশের সকল ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন; পহেলা বৈশাখ আর মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় ভয়াবহ নৈরাজ্য আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে যারা সরকার পতনের ডাক দিয়েছিল। হেফাজতে ইসলামের প্রধান কথিত আল্লামা আহম্মদ শফিই হবেন সেই কমিটির প্রধান, তার কর্তৃত্বেই সনদ দেয়া হবে। তার শিষ্যরা, যারা চিন্তায়-মননে পাকিস্তানী ভাবাদর্শে গড়ে উঠছে, তারা ভবিষ্যতে দেশের প্রশাসনিক পদগুলো দখলে নেবে- এমন ভাবনায় আমরা শিউরে উঠছি’। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বলা হচ্ছে সুপ্রীমকোর্টের সামনে নির্মিত ভাস্কর্যটি মানসম্পন্ন হয়নি। একথা স্বীকার করেও প্রশ্ন করা যায়, ঢাকাসহ সারাদেশে নির্মিত ভাস্কর্যগুলোর সবগুলো কি মানসম্পন্ন হয়েছে? যদি মানসম্পন্ন না হয়ে থাকে, শিল্পমানের ঘাটতি থেকে থাকে, তাহলে দেশের প্রতিভাবান শিল্পীদের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে এর মানোন্নয়নের জন্য। কিন্তু হেফাজতের দাবির সঙ্গে সুর মিলানো কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভাস্কর্য হলো সমাজের ভাবনা ও মননশীলতার প্রতীক। হেফাজতে ইসলাম দেশের সকল অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও মুক্তিসংগ্রামের সকল স্মারক ও সৌধসমূহকেই মূর্তি আখ্যা দিয়ে ভেঙ্গে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, অপরাজেয় বাংলা, শিখা চিরন্তন ইত্যাদি। ক্ষমতায় থাকার জন্য অথবা যাওয়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা এবং মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সাথে রাখার যে অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তা দেশকে এক ভয়াল অন্ধকারে নিয়ে যাবে। আমরা সরকারের এই আত্মঘাতী খেলা থেকে বের হয়ে আসার দাবি জানাচ্ছি এবং এই অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সকল দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন, আহমেদ রফিক, কামাল লোহানী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যতীন সরকার, সৈয়দ হাসান ইমাম, হাসান আজিজুল হক, সনৎ কুমার সাহা, ড. অজয় রায়, ড. সফিউদ্দিন আহমদ, সাইদুর রহমান বয়াতী, অধ্যাপক কাজী মদিনা, ড. অনুপম সেন, আবুল মোমেন, শিল্পী আনোয়ার হোসেন, নিখিল সেন, দ্বিজেন শর্মা, লায়লা হাসান, মামুনুর রশিদ, মানবেন্দ্র বটব্যাল, ড. ইনামুল হক, চলচিত্রকার মসিউদ্দিন শাকের, অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম, বেগম মুশতারী শফি, বীরেন্দ্রনাথ রায়, অধ্যাপক আবুল মনসুর, ডাঃ রশিদ ই মাহবুব, ম হামিদ, লাকী ইনাম, এ এন রাশেদা, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ভাস্কর রাশা, রফিউর রাব্বি, ড. আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া, অধ্যক্ষ মোঃ আকমল হোসেন, সঞ্জীব দ্রং, অধ্যাপক আ ক ম মোস্তফা জামান, অধ্যাপক এম এ আজিজ মিয়া, অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, হরেন্দ্রনাথ সিং, কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু, স্থপতি সৌমেন হাজরা, নাট্যজন রোকেয়া রফিক বেবী, নৃত্যশিল্পী তামান্না রহমান, নাট্যকার মান্নান হীরা, অধ্যাপক সায়েম রানা, সুরকার শাহীন সরদার, আবৃত্তি শিল্পী রূপা চক্রবর্তী, সঙ্গীত শিল্পী সায়ান, ডাঃ সারওয়ার আলী, মফিদুল হক, আবৃত্তি শিল্পী আশরাফুল আলম, চিত্রশিল্পী আবুল বারাক আলভী, আবেদ খান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, বুলবুল মহলানবীশ, তিমির নন্দী প্রমুখ।
×