ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী

দেশে আইনের শাসন আছে বলে বেগম জিয়া ১৪০ বার সময় পেয়েছেন

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৯ মে ২০১৭

দেশে আইনের শাসন আছে বলে বেগম জিয়া ১৪০ বার সময় পেয়েছেন

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা দেশে আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা না থাকার অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, জানি না, প্রধান বিচারপতি কীভাবে বললেন দেশে আইনের শাসন নেই? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আছে বলেই একজন নেত্রীকে (খালেদা জিয়া) আদালত ১৪০ বার সময় দিয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আছে বলেই এই সময় দিতে পেরেছে, নইলে তো দিতে পারত না। আমাদের ওই ধরনের মানসিকতা থাকলে তো নিশ্চয় দিতে পারত না। একটি মামলায় একজনকে ১৪০ বার সময় প্রদান আর তার ৪০/৫০ রিটের নিষ্পত্তিই তার বড় প্রমাণ। আর যারা এসবের সুযোগ নিচ্ছেন তারাও সুর মেলাচ্ছেন দেশে আইনের শাসন নেই! তবে আমি দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারি, দেশে পূর্ণাঙ্গ গণমাধ্যম, বিচার বিভাগ ও বাক স্বাধীনতা বিদ্যমান। দেশের গণমাধ্যম সম্পূর্ণ স্বাধীন। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সোমবার রাতে জাতীয় সংসদ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের দেশে কিছু লোক আছে, এই লোকগুলো একসময় মনে করত একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এলেই তাদের মূল্য পাবেন, তারা একটা পতাকা পেতে পারেন, তারা একটা কিছু হতে পারেন কিংবা তাদের একটু তোষামোদি- খোসামদি করবে। আর তাদের মূল্যটাও একটু বেশি থাকে অস্বাভাবিক কিছু থাকলে। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকলে তাদের সুযোগটা কম থাকে। আসলে এসব লোকের ক্ষমতায় যাওয়ার সাধ আছে, কিন্তু জনগণের কাছে ভোট চাওয়ার সাধ্য নেই। অনেকে চেষ্টা করেছে দল গঠনের জন্য, কিন্তু জনগণের কাছ থেকে কোন সাড়া পায়নি। এ দোষ কার? কথায় কথায় আদালতে রিট, একটি মামলায় যদি ৪০/৫০ বার রিট হয়, রিট নিষ্পত্তি হয়, তবে স্বাধীনতা নেই কীভাবে? এই একটি দৃষ্টান্তই তো যথেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার সমাপনী বক্তব্য শেষে স্পীকার চলতি দশম জাতীয় সংসদের ১৫তম অধিবেশন সমাপ্তি সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ পাঠ করে শোনান। রেওয়াজ অনুযায়ী ডাকা সংক্ষিপ্ত অধিবেশনের স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র ৫ কার্যদিবস। এ মাসের শেষেই রাষ্ট্রপতি ১৬তম বাজেট অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন বলে সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে। বক্তব্যের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে কবিগুরুর প্রতি তার শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে কবিগুরুর অসীম অবদানের কথাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সুযোগসন্ধানী কিছু লোকই নানা কথা বলে বেড়াচ্ছেন। আন্তর্জাতিকভাবে দেশের বদনাম করাই হচ্ছে এদের চরিত্র। মনে হচ্ছে দেশের বদনাম করতে পারলেই নাগরদোলার মতো তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। সেই আশাই যদি তারা করে থাকে সেই আশায় গুড়েবালি। এদেশে সেটি আর হবে না। দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সম্পূর্ণ বাক স্বাধীনতা রয়েছে দাবি করে সংসদ নেতা বলেন, দেশে ৭৫০ পত্রিকা ও ৩৪ বেসরকারী টিভি চ্যানেল রয়েছে। এর পরও এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে এই দেশে নাকি বাক স্বাধীনতা নেই! যারা রিপোর্টটা করেছে তাদের বলবÑ এই টিভিগুলোতে বসে বসে টকশো করে দিনরাত সরকারের বিরুদ্ধে সমানে কথা বলা হচ্ছে। স্বাধীনতা না থাকলে এমনভাবে বলা যেত? একেবারে সরাসরি কেউ কি তাদের গিয়ে গলা টিপে ধরে বলছে এভাবে কথা বলা যাবে না? তিনি বলেন, সংবাদপত্র লিখেই যাচ্ছে। তবে যদি কেউ হলুদ সাংবাদিকতা করে মিথ্যা ও অসত্য তথ্য দেয়, কারও যদি চরিত্র হনন করে; নিশ্চয় তাদেরও অধিকার রয়েছে যে এখান থেকে নিজের ওপর মিথ্যা দোষারোপ থেকে রক্ষা পাবে। সেটা নেবার অধিকার সকলেরই রয়েছে। তিনি বলেন, হলুদ সাংবাদিকতা ও চরিত্র হননের কারণে কোন সংসদ সদস্য বা ব্যক্তি যদি মানহানির মামলা করে তবে এটা দোষ কীভাবে? নিজে অপরাধী না হলে মামলা মোকাবেলা করবে। তিনি বলেন, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। কিন্তু এই স্বাধীনতা ভোগ করতে হলে তাদেরও দায়িত্ব পালন করতে হয়। কারও অধিকার ক্ষুণœ করা মানে স্বাধীনতা নয়। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, অন্যের বদনাম করে তারা কি পায় জানি না। এদের কাছে জরুরী অবস্থা থাকলেই এদের (সমালোচনাকারী) বাক স্বাধীনতা থাকে। তখন কী বাক বাকুম তাদের। তিনি বলেন, দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আছে তা বিএনপি নেত্রীর মামলায় একটা বড় প্রমাণ। আর দেশে আইনের শাসনও আছে। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের দমন করছে। আমার প্রশ্ন- কোন জঙ্গী নিহত হলেই বিএনপি নেত্রীসহ অন্যদের মনে এতে ব্যথা লাগে কেন? তাদের সঙ্গে বিএনপি নেত্রীদের যোগসূত্রটা কী। জঙ্গীদের হামলা ও আত্মঘাতী ঘটনার সময় কেউ কেউ মারা যাচ্ছে, এটা মানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়। কারণ, এরা সুযোগ পেলেই অনেক মানুষের ও দেশের সম্পদ ধ্বংস করত। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও কেন এত কথা? জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গী-সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। যারা ইসলামের নামে মানুষ হত্যা করছে তারা কখনই বেহেস্তে যাবে না, যাবে সরাসরি দোজখে। ইসলাম ধর্ম কখনই সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ ও মানুষ হত্যাকে সমর্থন করে না। এদের বিরুদ্ধে পুরো দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আর ইয়াবার উৎস্য কোথায়, কারা কারা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের খুঁজে বের করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি। মামলা মোকাবেলা করতে খালেদা জিয়ার ভয় কীসের? এতিমের টাকা আত্মসাতসহ বিভিন্ন মামলায় খালেদা জিয়া ১৪০ দিন সময় নিয়েছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতায় থাকতে হত্যা, লুণ্ঠন, বিদেশে অর্থ পাচার ছাড়া দেশকে আর কিছুই দিতে পারেননি। এমনকি এতিমের টাকা পর্যন্ত মেরে খেয়েছেন। এখন অর্থ আত্মসাত মামলা মোকাবেলা করতে উনি ভয় পান। বুকে যদি সততার সাহস থাকত তবে মামলায় তার এত ভয় কেন? তিনি বলেন, মামলা থেকে পালিয়ে বাঁচতে আদালতে যেতেই উনি ভয় পান। এ পর্যন্ত ১৪০ দিন সময় নিয়েছেন। হাইকোর্টে প্রায় ৪০টি রিট করে সময়ক্ষেপণ করছেন। এতিমের টাকা যদি প্রথমেই ফেরত দিতেন, তবে তো তাকে মামলা মোকাবেলা করতে হতো না। মেরে দেয়া টাকাও ফেরত দেবেন না, আবার মামলা মোকাবেলা করতে আদালত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? যারা এতিমের টাকা পর্যন্ত মেরে খান, তারা ক্ষমতায় এলে দেশের মানুষকে কী দেবে? ক্ষমতায় থাকতে কী তারা কোন উন্নয়ন করেছে? সরকার উৎখাত ও নির্বাচন বানচালের নামে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াবহ অগ্নিসন্ত্রাস, নাশকতা ও শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার কড়া সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এদের রাজনীতিই হলো মানুষ হত্যা, অত্যাচার ও নির্যাতন করে ক্ষমতায় যাওয়া। তাদের অগ্নিসন্ত্রাসের হাত থেকে কেউই রেহাই পায়নি। সরকার উৎখাত ও নির্বাচন বানচালের নামে তারা নির্বিচারে মানুষকে হত্যা করেছে, দেশের সম্পদ ধ্বংস করেছে। তিন বছর ধরেই তারা দেশে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ৯২ দিন ধরে ৬০ নেতাকর্মীকে নিয়ে অফিসের এয়ারকন্ডিশনে বসে থেকে বিএনপি নেত্রী হুকুম দিয়ে মানুষকে হত্যা করিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা ৫৮২ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, ২ হাজার ৩৫২ জনকে আগুনে দগ্ধ করেছে, ২৯টি রেল পুড়িয়েছে, ৮টি লঞ্চে আগুন দিয়েছে, ৭০টি সরকারী অফিস পুড়িয়েছে, বিদ্যুত কেন্দ্রে আগুন দিয়েছে, ২৬ পুলিশ-বিডিআর ও সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার লোককে হত্যা করেছে। বায়তুল মোকাররম মসজিদে আগুন দিয়ে শত শত কোরান শরীফ পুড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতায় থাকতেও তারা মানুষ হত্যা, দুর্নীতি, লুণ্ঠন, বিদেশে অর্থপাচার ছাড়া দেশকে আর কিছু দিয়ে যেতে পারেনি। মার্কিন ফেডারেল কোর্ট এবং সিঙ্গাপুরের আদালতেও খালেদা জিয়ার পুত্রের অর্থ পাচারের ঘটনা প্রমাণ হয়েছে, পাচারকৃত কিছু টাকা আমরা ফেরতও এনেছি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবেই এই হামলা চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। যারা এভাবে মানুষকে হত্যা করে, দুর্নীতি-লুটপাট করে তাদের মুখে আইনের শাসনের কথা শোভা পায় না। দেশে আইনের শাসন আছে বলেই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের দমন করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী সংসদে বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকা পালনের প্রশংসা করে বলেন, বর্তমান বিরোধী দল কিন্তু সরকারের সমালোচনা করতে এতটুকু ছাড় দিচ্ছে না। কিন্তু বিএনপির আমলের মতো বর্তমান সংসদে কোন খিস্তিখেউর, অশ্লীল কথাবার্তা, বিটিভির ক্যামেরা ভাংচুর কিংবা স্পীকারকে আক্রমণের মতো কোন ঘটনা নেই। দেশের গণতন্ত্রের ভিত আজ অত্যন্ত মজবুত বলেই দেশের আজ এমন অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সারাবিশ্বের কাছে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোলমডেল।
×