ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত

প্রতিদিন তিনি আমাদের, তাঁকে নিয়েই ছিল কাল সারাদিন

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৯ মে ২০১৭

প্রতিদিন তিনি আমাদের, তাঁকে নিয়েই ছিল কাল সারাদিন

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ সংস্কৃতিবান বাঙালীর জীবনে প্রতিদিনই যেন তিনি বিরাজমান। আকাশভরা সূর্যতারা কিংবা বিশ্বভরা প্রাণের মতোই আপন সৃষ্টির আলোয় দীপ্তিময় এই বিশ্বকবি। গানের সুরে, কবিতার পঙ্ক্তিমালায়, মানবিক ভাবনায়, স্বদেশ চেতনায় হয়ে আছেন যাপিত জীবনের নিত্যসহচর। সেই সুবাদে চেতনে বা অবচেতনে মানবিক দর্শনের আলোকরেখায় ঠাঁই করে নিয়েছেন বাঙালীর মননে। শরীরী অস্তিত্ব না থাকলেও মননের বিভায় প্রতি মুহূর্তে ঋদ্ধ করে চলেছেন জীবনের পথচলাকে। অনুপ্রেরণার সঙ্গী হয়েছেন বাঙালীর সঙ্কটে, সংগ্রামে, আনন্দ ও ভালবাসায়। সেই কৃতজ্ঞতার বন্ধনে সোমবার সোমবার পঁচিশে বৈশাখ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৬তম জন্মজয়ন্তী উদ্যাপিত হলো প্রাণের প্রগাঢ় উচ্ছ্বাসে। ধর্মান্ধতা ও উগ্রপন্থার আস্ফালনে ভূলুণ্ঠিত মানবতার সঙ্কটে বিশ্ব যখন প্রকম্পিত সেই সময়ে জন্মদিনে যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে সামনে এলেন বিশ্বকবি। ভালবাসার বন্ধনে সহজাতভাবেই রবীন্দ্র অনুরাগীদের মনে গুঞ্জরিত হয়েছেÑ আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান ...। সেই প্রেরণায় অমানবিকতার বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়েছে তাঁরই বাণীÑ অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে...। মানবতা ও সম্প্রীতির মর্মবাণী ধারণ করে সারা দেশে উদ্্যাপিত হলো রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী। হৃদয়ের গহিন থেকে উৎসারিত শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করা হয় কবিগুরুকে। দেশব্যাপী দিনভর নানা আনুষ্ঠানিকতায় বাঙালীর চিন্তা-মননের সঙ্গী এবং শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রদূত কবিকে জানানো হলো বন্দনা। জন্মদিনে কবি বন্দনার পাশাপাশি ছিল তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে হিংসা-বিদ্বেষ দূরে ঠেলে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে চলার প্রত্যয় গ্রহণ। নাগরিক কবি রবীন্দ্রনাথের মননকে গ্রামীণ জীবনের প্রতি আলোড়িত করেছিল বাংলার প্রকৃতি। প্রান্তিক মানুষের জীবনচিত্র উপলব্ধির পাশাপাশি নিসর্গের রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন এ দেশের শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসর কাটিয়ে দেয়া জীবন থেকে। কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত নওগাঁর সেই পতিসরে এবার জাতীয়ভাবে উদ্যাপিত হয়েছে তাঁর জন্মদিন। পতিসরের রবীন্দ্র কাছারি বাড়ির দেবেন্দ্র মঞ্চে আয়োজিত রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এ আয়োজনে ‘মানুষের ধর্ম : রবীন্দ্রনাথ ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা’ বিষয়ে উদ্বোধনী স্মারক বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ড. হায়াৎ মামুদ। ছিল নৃত্য-গীতে সাজানো সাংস্কৃতিক পর্ব। এছাড়া কবিগুরুর স্মৃতিধন্য কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর এবং খুলনার দক্ষিণডিহিতে কবির জন্মদিনে ছিল নানা আনুষ্ঠানিকতা। রবীন্দ্রমেলা, রবীন্দ্রবিষয়ক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে স্থানীয় প্রশাসন। পঁচিশে বৈশাখ কবির জন্মদিনে সকাল থেকেই সরব ছিল রাজধানীর সংস্কৃতি ভুবন। সরকারী পর্যায় ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপন করেছে বৈচিত্র্যময় নানা আয়োজনে। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে রকমারি আয়োজনে বর্ণিল রূপ ধারণ করেছিল রাজধানীর সংস্কৃতি ভুবন। নৃত্য, গীত, পাঠ, কবিতা আবৃত্তি, মেলাসহ বহুমাত্রিক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে একই সঙ্গে কবি বন্দনা ও স্মরণের আয়োজন করা হয়। আর এসব আয়োজনে গানের সুরে, কবিতার ছন্দে কিংবা নৃত্যের মুদ্রায় কিংবা বক্তার কথায় নির্মল আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি প্রাণের কবির প্রতি হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানিয়েছেন উপস্থিত ররীন্দ্র অনুরাগী দর্শক-শ্রোতারা। কয়েকদিন আগে থেকে শুরু করে পঁচিশে বৈশাখে কবির জন্মদিন উদ্্যাপনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ছায়ানট, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এছাড়া কবির জন্মদিনে দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। সরকারী-বেসরকারী চ্যানেলগুলো প্রচার করেছে রবীন্দ্র সৃষ্টিস্নাত গান-কবিতা ও নাটকে সজ্জিত অনুষ্ঠানমালা। রবীন্দ্রজয়ন্তীর সকাল থেকেই সচল হয়েছিল শিল্পীর রং-তুলির আঁচড়। রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনালয়ে দিনভর ছবি এঁকেছে নবী-প্রবীণ ও বরেণ্য চিত্রশিল্পীরা। কবিগুরুর ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। প্রশস্ত প্রদর্শনালয়ের চারপাশে ক্যানভাস সাজিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ভাবধারায় চিত্রকর্ম সৃজন করেছেন চিত্রকররা। নিজেও রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি আকার পাশাপাশি এ আর্ট ক্যাম্প উদ্বোধন করেন বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান। তাঁর সঙ্গে চিত্রকর্ম সৃষ্টির প্রয়াসে অংশ নেন আরও ২২ জন চিত্রশিল্পী। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রোকেয়া সুলতানা, অলকেশ ঘোষ, শামীম সুব্রানা, সামিনা নাফিজ, সোহাগ পারভেজ, আনিসুজ্জামান, দুলাল চন্দ্রগাইন, শামসুদ্দোহা, রেজাউন নবী, শাজাহান আহমেদ বিকাশ, সোহানা শাহরীন, দিলরুবা লতিফ প্রমুখ। আর্ট ক্যাম্পে ছবি আঁকার ফাঁকে কথা হয় হাশেম খানের সঙ্গে। বাঙালীর যাপিত জীবনে কবিগুরুর সৃষ্টি ও দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে এই শিল্পী জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের আজীবনের পথের সঙ্গী রবীন্দ্রনাথ। গান গেয়ে, কবিতা পড়ে কিংবা তাঁর গদ্যসম্ভার আমাদের পৌঁছে দেয় মানবিক উপলব্ধির জগতে। প্রসারিত করে আমাদের মনোলোক। তার স্বদেশ, মানবিক ভাবনা, পল্লী উন্নয়ন ভাবনায় আজও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে বাঙালীর জীবনে। পঁচিশে বৈশাখের সন্ধ্যায় মুখরিত হয়ে ওঠে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত গান, কবিতা, নৃত্য পরিবেশনা ও কথনে স্নিগ্ধ রূপ পায় ও ধানম-ির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তন। অনুষ্ঠানের সূচনা ছায়ানটের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের সুরের ছোঁয়ায়। তাঁরা গেয়ে শোনায় ‘ভুবনজোড়া আসনখানি’। এরপর স্বাগত বক্তব্য রাখেন ছায়ানটের কার্যনির্বাহী সভাপতি ডাঃ সারওয়ার আলী। রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত কথনে অংশ নেন কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত। কথন শেষে ‘ওগো পথের সাথে’ গানের সুরে পরিবেশিত হয় বিশেষ গীতিনৃত্য ‘নকশা’। ‘আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ’ শীর্ষক সঙ্গীত পরিবেশন করেন সৈকত মুখার্জী। এছাড়া একক কণ্ঠে গান শোনান মাকসুরা আখতার, সুদীপ সরকার, শামীমা নাজনীন, তানিয়া মান্নান প্রমুখ। দুইদিনব্যাপী এ অনুষ্ঠান শেষ হবে আজ মঙ্গলবার। এদিনও সন্ধ্যায় থাকবে নৃত্য-গীতসহ নানা রকম পরিবেশনা। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে সোমবার সন্ধ্যায় আলোচনা এবং নৃত্য-গীত ও আবৃত্তিতে সজ্জিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন লেখক, গবেষক ও ছায়ানটের সভাপতি ড. সন্জীদা খাতুন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর। আলোাচনা শেষে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। বেলায়েত হোসেনের পরিচালনায় ‘ধ্বনিল আহবান’ ও ‘নীল অঞ্জন ঘন’ গানের সুরে পরিবেশিত হয় সমবেত নৃত্য । ‘মম চিত্তে’ ও ‘আমার বেলা যে যায় সাঝ বেলাতে’ গানের সুরে এম আর ওয়াসেকের পরিচালনায় পরিবেশিত হয় আরও দুটি বৃন্দ নৃত্য। ‘আনন্দ ধ্বনি জাগাও প্রাণে’ গানে সুরে একক নৃত্য পরিবেশন করেন র‌্যাচেল প্রিয়াংকা প্যারিস। একক কণ্ঠে গান শোনান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, মিতা হক, শামা রহমান, রোকাইয়া হাসিনা, স্বাতী সরকার, ছায়া কর্মকার ও মহীউজ্জমান চৌধুরী ময়না। রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ও ডালিয়া আহমেদ। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও জানিয়েছে শ্রুদ্ধা ও ভালবাসা। শিশুদের নাচ ও গানে মুগ্ধ হয়েছে দর্শক-শ্রোতা। এদিন বিকেলে দিবসটি পালনের মাধ্যমে বাঙালীর ভাষা ও সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে রবীন্দ্রনাথের অবদানকে উদ্যাপন করে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। বিকেলে একাডেমির মিলনায়তনে আলোচনা সভার পাশাপাশি ছিল খ্যাতিমান রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী পাপিয়া সরোয়ারের সঙ্গীত পরিবেশনা। শিশু একাডেমির শিশুদের পরিবেশিত নৃত্য-গীতে অনুষ্ঠানে যুক্ত হয় ভিন্ন মাত্রা। এ অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম এনডিসি এবং কবি আসাদ চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন একাডেমির পরিচালক আনজীর লিটন। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির চেয়ারম্যান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। প্রতিবছরের মতো এবারও রবীন্দ্রজয়ন্তীতে তেজগাঁওয়ের চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘রবি-চ্যানেল আই রবীন্দ্রমেলা। এ মেলায় রবীন্দ্রসঙ্গীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মিতা হক এবং রবীন্দ্র-গবেষণায় রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সনৎ কুমার সাহাকে আজীবন সম্মাননা দেয়া হয়। বিকেলে সূচনা হওয়া মেলাটি চলে রাত অবধি। উদ্বোধনী পর্বে অংশ নেন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, বরেণ্য শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিকসহ চ্যানেল আইয়ের পরিচালকবৃন্দ প্রমুখ। মেলার স্থানের খোলা প্রাঙ্গণে গড়া মঞ্চ থেকে উপস্থাপিত হয়েছে নবীন-প্রবীন শিল্পীদের পরিবেশনায় রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য, শিশু নৃত্য, রবীন্দ্র কবিতা থেকে আবৃত্তি ও রবীন্দ্র রচনাবলী থেকে পাঠ। সেই সঙ্গে ছিল রবীন্দ্রবিষয়ক ছবি আঁকাআঁকি। এ মেলায় গান শুনিয়েছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সাদি মহম্মদ, লিলি ইসলাম, শামা রহমান, অনিমা রায় প্রমুখ। মেলার স্টলগুলোতে ঠাঁই পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখিত গ্রন্থ, রবীন্দ্র চিত্রকলা, রবীন্দ্র সঙ্গীতের অডিও-ভিডিও গানের স্টল ও রেকর্ড কাভার প্রদশর্নী, রবীন্দ্র গল্পগ্রন্থ থেকে নির্মিত চলচ্চিত্রের স্টল ইত্যাদি। এছাড়াও ছিল বাংলার ঐতিহ্যসমৃদ্ধ রকমারি পণ্যসামগ্রীর স্টল। মূলত রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী চিন্তার প্রকাশ ঘটানো হয় এই মেলায়।
×