ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মিল্টন বিশ্বাস

রবীন্দ্র ভাবনায় বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৯ মে ২০১৭

রবীন্দ্র ভাবনায় বিশ্ববিদ্যালয়

(গতকালের পর) বোলপুরের বিদ্যালয় প্রাদেশিক থাকিবে না- সাম্প্রদায়িক হইবে না।’-(প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, ২য় খ-, পৃঃ-৬১৯)। তারও আগে ১৯১৬ সালে শিকাগো থেকে পুত্রকে লেখেন, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে- ওইখানে সর্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে- স্বজাতিক সঙ্কীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসছে- ভবিষ্যতের জন্য যে বিশ্বজাতিক মহামিলন যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম আয়োজন ওই বোলপুরের প্রান্তরেই হবে।’ (তদেব) অর্থাৎ সর্বজাতি, সর্বধর্মের, সর্বভাষীদের জ্ঞানালোচনার কেন্দ্র হবে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯১৮ সালে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ নিজ গৃহে গুজরাটি ব্যবয়াসীদের একটি প্রতিনিধি দলের কাছে বিশ্বভারতীর পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে ১৯১৯ সালে কলকাতায় তিনি ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে বক্তৃতায় বলেছিলেন, ভারতবর্ষ একসময় নিজের মানসশক্তি দিয়ে বিশ্বসমস্যা গভীরভাবে চিন্তা করেছে এবং নিজের বুদ্ধিতে তার সমাধানের চেষ্টা পেয়েছে। সেই সময় থেকে ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থার যা কিছু নিজস্ব তাকে অবলম্বন করার কথা বার বার বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘শিক্ষা হলো বাইরের প্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন।’ এক কথায় পরিপূর্ণ মানবসত্তাকে লালন করে দেহ, মন ও আত্মার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নিজেকে জাতির উপযোগী, যোগ্য, দক্ষ, সার্থক ও কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার নামই শিক্ষা। শিক্ষা মানব জীবনের এক মূল্যবান সম্পদ। এ সম্পদ কখনই খোয়া যায় না বা বিলুপ্ত হয় না। বেঁচে থাকার জন্য নিজেকে অভিযোজিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার জগতটা অনেক বড়। এ জন্য এখানে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তাঁর ভাবনার কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো। ॥ চার ॥ রবীন্দ্রনাথের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যার উদ্ভাবনা চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য কাজ বিদ্যার উৎপাদন, তার গৌণ কাজ সেই বিদ্যাকে দান করা। বিদ্যার ক্ষেত্রে সেসব মনীষীকে আহ্বান করতে হবে যাঁরা নিজের শক্তি ও সাধনা দিয়ে অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও সৃষ্টির কাজে নিবিষ্ট আছেন। মনীষীদের একক কিংবা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জ্ঞানের উৎস উৎসারিত হবে। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার সঙ্গে দেশের সর্বাঙ্গীণ জীবনযাত্রার যোগ চেয়েছেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্যই অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, সমস্ত ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে নিজের প্রতিষ্ঠাস্থানের চারদিকের পল্লীর মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে; কাপড় বুনবে এবং নিজের আর্থিক সম্বল লাভের জন্য সমবায় প্রণালী অবলম্বন করে ছাত্র-শিক্ষক ও চারদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে জীবিকার যোগে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হবে। আর এ রকম আদর্শ বিদ্যানিকেতনকে তিনি ১৯১৯ সালে ‘বিশ্বভারতী’ নাম দেয়ার প্রস্তাব করেন। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক ‘বিশ্বভারতী’র মহৎ আদর্শ প্রচারিত হওয়ার পর দেশ-বিদেশের প-িত ও নানা শ্রেণীর লোক শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হতে থাকেন। কবির স্বপ্ন সফল করার জন্য নিজেদের শ্রম ও মেধা দিতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ‘বিশ্বভারতী’র হৃদস্পন্দন কম্পিত হতে থাকে ইংরেজ যুবক কৃষিবিশেষজ্ঞ লেনার্ড এলমহার্স্ট, এনড্রুজ, পিয়ার্সন এবং ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে সস্ত্রীক যোগদান করেন সিলভা লেভি। তিনি প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে আধুনিক মানুষের কাছে তুলে ধরেন এবং চীনা ও তিব্বতী ভাষা শিক্ষাদানের ক্লাস খোলেন। মাদাম লেভি ফরাসী ভাষা শিক্ষা দিতে শুরু করেন। প্রাচ্যজ্ঞান জগতে সুপরিচিতদের আগমন বিশ্বভারতীকে আন্তর্জাতিক চারিত্র্য প্রদান করে। রবীন্দ্র জীবনীকার লিখেছেন, ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের বিশ বছর এইবার পূর্ণ হইল। এই দীর্ঘকাল বিদ্যাতনের ব্যয়ের মূল অংশ কবি একাই বহন করিয়া আসিতেছিলেন, কিন্তু বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পর হইতে তাঁহার একার পক্ষে এ ভার বহন করা আর সম্ভব নহে। বিশ্বভারতীতে নানা বিষয় অধ্যয়ন-অধ্যাপনার পরিকল্পনা রহিয়াছে, বিদেশ হইতে গুণী-জ্ঞানীদের আসিবার সম্ভাবনা। কবির মনে তাঁহার ‘মিশন’ সম্বন্ধে কোন দ্বিধা নাই; তাঁহার অন্তরের বিশ্বাস আন্তর্জাতিকতার মনোশিক্ষা না পাইলে ভাবীকালের সভ্যতা টিকিবে না।’-(প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী ৩য় খ-) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় আরও জানিয়েছেন, ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শান্তিনিকেতনের নতুন যুগের সূচনা হয়। নতুন যুগের সেই অতিথিশালায় মানুষের সঙ্গে মানুষের হার্দিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে অধ্যাপক বিধুশেখর ভট্টাচার্য সংস্কৃত শিক্ষার প্রসারের জন্য গ্রামে ফিরে গিয়ে টোল প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলে রবীন্দ্রনাথ পুনরায় তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। দেশ-বিদেশের প-িতদের সম্মিলন কেন্দ্র হয়ে ওঠে ‘বিশ্বভারতী’। এক পর্যায়ে এই বিশ্বভারতী ভারতবর্ষের জিনিস হলেও সমস্ত মানবের তপস্যার ক্ষেত্র করে তোলা হয়। শিক্ষা এবং জীবনের সমবায়ে সার্বিক শিক্ষা তথা জীবনদর্শনের সূত্র রচনা করে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯২২-২৩ সালেই ‘বিশ্বভারতী’ নানাভাবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। বিদেশী অধ্যাপকদের বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে এটি। সিলভা লেভির পর সেখানে আসেন জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও প্রাচ্য সংস্কৃতির অধ্যাপক হিনটারনিটস এবং তার ছাত্র অধ্যাপক লেসনি। ইংরেজ তরুণী ও আর্ট বিশেষজ্ঞ স্টেলা ক্রামরিশ, বহুভাষাবিদ ইহুদী নারী শ্লোমিও ফ্লাউম আশ্রম বিদ্যালয়ের শিশুবিভাগের কাজে যোগদান করেন। এ ছাড়া ছিলেন সুইস-ফরাসী বেনোয়া, ফারসী ও ইসলামের ইতিহাসের রুশ দেশীয় প-িত বগদানফ, ভাষাতত্ত্ববিদ মার্ক কলিন্স ও রেভারেন্ড স্ট্যানলি জোনস। বিদেশী অধ্যাপক এবং গুণীদের সমাবেশ বিশ্বভারতীকে প্রথম থেকেই কর্মমুখর করে তোলে। বিবিধ ভাষা, বিচিত্র বিষয় অধ্যাপনার আয়োজনে বিকশিত হয় প্রতিষ্ঠানটি। ফ্রান্স, জার্মান, চীন থেকে অসংখ্য গ্রন্থ, পত্রিকা আসে; বিশ্বভারতী গ্রন্থাগার পূর্ণ হয়। বিচিত্র প্রায়োগিক কাজের মধ্য দিয়ে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বভারতীর কাজ শুরু করেন তার আগে স্থাপিত হয় মৈসুর (১৯১৬), বারাণসী হিন্দু (১৯১৬), পাটনা (১৯১৭) এবং ওসমানিয়া (১৯১৮) বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। মৈসুর বিশ্ববিদ্যালয় দেখে এসে কবির মনে হয়েছিল ঘুরে-ফিরে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার বেলাতেও প্রণালী বদল করার কথা মনে আসে না, নতুনের ঢালায় করা হচ্ছে পুরনোর ছাঁচে। বিশ্ববিদ্যালয় হবে বিদ্যা সমবায়ের একটি বড় ক্ষেত্র, যেখানে বিদ্যার আদান প্রদান ও তুলনা হবে, যেখানে ভারতীয় বিদ্যাকে মানবের সকল বিদ্যার ক্রমবিকাশের মধ্যে রেখে বিচার করতে হবে। আবার রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, সমস্ত পৃথিবীকে বাদ দিয়ে যারা ভারতকে একান্ত করে দেখে তারা ভারতকে সত্য করে দেখে না। এ জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈদিক, পৌরাণিক, বৌদ্ধ, জৈন, মুসলমান ও ফারসী বিদ্যার সমবেত চর্চার সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিকভাবে ইউরোপীয় বিদ্যাকে স্থান দিয়েছেন। তিনি শান্তিনিকেতনে জ্ঞানের সঙ্গে রসের চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। বিশ্বভারতীতে জ্ঞানানুশীলনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কলাবিদ্যাচর্চার ব্যবস্থা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিশ্বভারতী যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে ভারতীয় সঙ্গীত ও চিত্রকলা শিক্ষা তার প্রধান অঙ্গ হবে, এই আমাদের সঙ্কল্প হোক।’ শুরু থেকেই সেখানে ছাপাখানা স্থাপিত হয়। সঙ্গীত, নৃত্যকলা ও চিত্রকলার বৃহৎ আসর বসে। কেবল রসের আঙিনা নয়, জীবিকার প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়ায় গড়ে ওঠে কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন সম্পৃক্ত নানা গবেষণা কেন্দ্র। ‘বিশ্বভারতী’র মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনা বাস্তব হয়ে উঠেছিল। সেখান থেকে শতবর্ষের কাছে দাঁড়িয়ে আজ আমরা বিশ্বকবির নামে বাংলাদেশে ‘রবীন্দ্র-বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন করতে যাচ্ছি। এ জন্য আমাদের দায়-দায়িত্ব অনেক; বিদ্যায় বুদ্ধিতে জ্ঞানে দেশের যাঁরা সুধীশ্রেষ্ঠ তাঁদের দিকনির্দেশনাও গুরুত্ববহ। চলবে... লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×