ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাফিজ বিন রহমান

জঙ্গীবাদ ॥ উৎস ও প্রতিকার

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৯ মে ২০১৭

জঙ্গীবাদ ॥ উৎস ও প্রতিকার

জঙ্গীবাদ অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত। জঙ্গীবাদ ও ঊীঃৎবসরংঃ দুটি পাশাপাশি শব্দ। যদিও দুই জাতির পার্থক্য ভৌগোলিক সীমারেখায়। শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্যে। অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতিতে। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতায়। ইংরেজের ইতিহাস শাসনে, শোষণে। সাম্রাজ্য বিস্তারে। যুদ্ধবিগ্রহে। আর বাঙালীর ইতিহাস নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত হওয়ার। সম্পদ হারিয়ে ভুখা নাঙ্গা থাকা। আর গৃহ হারিয়ে যাযাবর হওয়া। নিজ ঘরে পরবাসী হওয়ার ইতিহাস। তাই বাঙালী আর ইংরেজ পাশাপাশি জাতি নয়। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজীর সঙ্গে তাল মেলাতে হয়। সেক্ষেত্রে অক্সফোর্ড ডিকশনারির দেয়া ঊীঃৎবসরংঃ-এর সংজ্ঞার সঙ্গে জঙ্গীবাদের ধারণা মিলিয়ে নেয়া যায়Ñ ‘যে ব্যক্তি রাজনীতি বা ধর্মীয় দিক দিয়ে চরমপন্থা গ্রহণ করে। বিশেষত অবৈধ, সন্ত্রাস বা অন্য কোন চরমপন্থাকে উস্কে দেয়।’ আবার এক্সট্রিমিস্টের কিছু প্রতিশব্দ রয়েছে। যেমনÑ রিবেল, রিভুলিউশনারি, ইমমডারেইট, রিয়্যাক্শনিজম, ফান্ডামেন্টালিজম, টেররিজম, ফ্যানাটিজম ইত্যাদি। যাদের অর্থ করা যায় বিদ্রোহী, বিপ্লবী, অসংযমী বা সীমালঙ্ঘনকারী, প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী, সন্ত্রাসবাদ এবং গোঁড়ামি। এর সঙ্গে আরও কিছু শব্দ যোগ হতে পারে। যেমন- অসহিষ্ণু, অসীম অজ্ঞতা, অন্য ধর্ম বিশ্বাসের (সেটি ব্যক্তিগত হোক বা রাজনৈতিক হোক) প্রতি তীব্র ঘৃণা, প-িতমন্য স্বভাব। তাই অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জন্ম নেয়া প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকা-কে জঙ্গীবাদ বলা যায়। জঙ্গীবাদের ইতিহাস কবে কোন্ সমাজে প্রথম জঙ্গীবাদের সূত্রপাত হয়েছিল, তা সাল- তারিখ দিয়ে হয়ত কেউ লেখেনি। তবে মানব ইতিহাসের প্রথম খুনোখুনিÑ আদি মানুষ আদম (আ)-এর পুত্র কাবিল তার ভাই হাবিলকে হত্যা করে। এটিও নিঃসন্দেহে চরমপন্থা ছিল। কারণ প্রতিপক্ষকে সর্বোচ্চ শাস্তির মাধ্যমে প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্য। সুতরাং এটি স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক চিন্তা ছিল না। এটি ব্যক্তিগত সহিংসতা হলেও চরমপন্থা। যেহেতু একসঙ্গে সর্বোচ্চ ক’জনকে হত্যা করলে জঙ্গীবাদ হয় তা জানা নেই, সুতরাং একজনকে মারলেও যে এক প্রকার একরৈখিক চরমপন্থা বা জঙ্গীবাদের সৃষ্টি হয় সে কথা বলা বাহুল্য। যা হোক, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জঙ্গীবাদী কার্যক্রমকে সহিংসতা নাম দিয়ে আপাতত সামনে তাকানো যাক। মধ্যযুগ। মানব ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত ও কুখ্যাত যুগ। সে যুগের বর্বরতা মানবতাকে লাঞ্ছিত ও লজ্জিত করেছে। তাই এটি বর্বর যুগ নামেও আখ্যায়িত। ব্যক্তিতান্ত্রিক ও পরিবারতান্ত্রিক সহিংসতা ও আগ্রাসনকে সমাজতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রিক পর্যায়ে নেয়ার ফলেই মধ্যযুগ ছিল জঙ্গীযুগ। মানুষের ঘরে ঘরে অনাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন, হত্যা, লুণ্ঠন, রাহাজানি, ধর্ষণ, শোষণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এ সবই ঘটেছিল শাসক শ্রেণীর অপশাসন ও নিদারুণ শোষণের কারণে। এ সবই জঙ্গীবাদী চেতনার ফল। নিজেকে সমাজে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত করার ফলাফল। ঊনবিংশ শতকের পরে রাষ্ট্রীয় জঙ্গীবাদ প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। তখন জার্মানির নাৎসি বাহিনী ইউরোপজুড়ে ধ্বংসাত্মক তা-ব চালায়। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তথাকথিত মিত্রবাহিনী ৬ ও ৯ আগস্ট হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ হত্যা করে, যেটি জঙ্গীবাদের নিকৃষ্টতম উদাহরণ। সাম্প্রতিক জঙ্গীবাদের ইতিহাস কম নয়, যেমন মধ্যপ্রাচ্যে তেল সম্পদ দখল করার জন্য উপসাগরীয় যুদ্ধে একতরফাভাবে আমেরিকা কর্তৃক ইরাক আক্রমণ। কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, শরণার্থী হয়। লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মানব ইতিহাসে যোগ হলো আরো একটি কালো অধ্যায়। এদিন আমেরিকার টুইন টাওয়ারে সিনেমা স্টাইলে বিমান হামলা চালানো হয়। যারাই ঘটাক এটি ছিল চরম ধিক্কৃত, নিন্দিত ও নিকৃষ্ট কাজ। দুই কালেই তাদের চরমতম শাস্তির মুখোমুখি হওয়া উচিত। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বড় করুণ। বড় বেশি হৃদয়বিদারক। যুদ্ধ শুরুর আগেই ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানী জঙ্গী বাহিনী ঘুমন্ত মানব জাতির ওপর আক্রমণ করে হাজার হাজার নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে শহীদ করে দেয়। তারপর নয় মাস লাখ লাখ বাঙালীকে তারা হত্যা করেছে। তাদের এই জঙ্গীবাদের বিচার কে করবে, কোথায় করবে? আইসিসিতে গিয়েও কি লাভ হবে? কারণ তারাই তো জঙ্গীবাদের সূতিকাগার। তারাই তো অহরহ চালাচ্ছে আধিপত্যের নামে যুদ্ধ। সাম্র্রাজ্যের নামে যুদ্ধ। তথাকথিত শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে যুদ্ধ। আর যুদ্ধের নামে কোটি মানুষকে হত্যা। যুদ্ধ তো জঙ্গীবাদেরই নামান্তর! বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ বাঙালী জাতির ইতিহাসে বেদনাময় ও কুখ্যাত কাল পঁচিশের রাত। এটি হলো জঙ্গীবাদের রাত। এই আগ্রাসনকে রুখে দিয়ে বাঙালী জাতি মহান স্বাধীনতা অর্জন করে। অমর স্বাধীনতার সঙ্গে বাংলার আকাশে পত্ পত্ করে ওড়ে লাল-সবুজের পতাকা। সুতরাং আমরা জঙ্গীবাদকে রুখে দিয়ে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পেয়েছি স্বাধীনতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আবারও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী জঙ্গী পাকিস্তানীর সহযোগিতায় প্রিয় বাংলাদেশের স্বপ্নপুরুষের পরিবারকে সমূলে নির্মূল করার জন্য জঙ্গী হামলা করে। ইতিহাসের এই পৈশাচিক হত্যাকা-ের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো অধ্যায় শুরু হয়। স্বৈরাচার আমলে নূর হোসেন হত্যাকা-, ডাঃ মিলন হত্যাকা-সহ ইতিহাসের কালো চাদরে ঢেকে গেছে অনেক হত্যাকা-। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিবাদী ছাত্রদের ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রীকে হত্যার নীলনক্সা বাস্তবায়নের নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র সত্যিই ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় জেএমবির (জামায়াতুল মুজাহেদিন) সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ। রাজশাহীতে বাংলা ভাইয়ের উদ্ভব। বিভিন্ন আদালত চত্ব¡র ও পুলিশ ফাঁড়িতে বোমা হামলা। ইদানীংকালে গুলশানে হলি আর্টিজানে ও শোলাকিয়াতে জঙ্গী হামলা। যদিও হলি আর্টিজানের হামলা ও পৈশাচিক হত্যাকা-ের পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র দায়ী অনেকাংশে। দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা বিশ্বকে গুরুত্ব না দেয়ায় বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার হীন চক্রান্ত হিসেবে ইহুদী-নাসারা সংগঠন আইএস-এর এ দেশীয় এজেন্ট কর্তৃক বিছিন্ন এই ঘটনা ঘটায়, যা সরকার সহজে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। জঙ্গীবাদ ও ইসলাম ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি। তাই শেষ নবী মোহাম্মদ (সা) এর আবির্ভাবের পর অন্ধকার যুগ ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হত্যা- লুণ্ঠন, অবিচার- অনাচার , শোষণ- অপশাসন থেকে মানুষ সত্য ও ন্যায়ের পথে অগ্রসর হয়। সোনালী সমাজ বিনির্মাণে তরুণ ও যুবসমাজই আগে এগিয়ে আসে। কোরানের একটি বর্ণতেও কেউ দেখাতে পারবে না যে, নিরপরাধ মানুষকে হত্যার নির্দেশ আছে। হাজার হাজার হাদিসের একটিও নেই যেখানে অন্যায় জুলুম অনৈতিক কর্মকা- ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যার কথা বলা হয়েছে। বরং শেষ নবী (সা) আক্রান্ত হওয়ার পর জবাব দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো মুসলমান যুদ্ধক্ষেত্রেও প্রতিপক্ষকে আগে আক্রমণের কোনো ধর্মগত নির্দেশ পায়নি। যেখানে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই আগে আক্রমণের নজির নেই সেখানে নিরপরাধ, নিরীহ মানুষকে হত্যা করে জিহাদ নাম দেয়া পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছু না। ইসলাম সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকার ফলে এ ধরনের জঙ্গীবাদী কর্মকা- ঘটছে। অথচ মোহাম্মদ (সা) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘শেষ জামানায় এমন একটি গোষ্ঠীর আবির্ভাব হবে যারা বয়সে নবীন, বুদ্ধিতে অপরিপক্ব ও নির্বোধ। তারা পবিত্র কোরান পাঠ করবে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীও অতিক্রম করবে না। তারা সৃষ্টির সেরা মানুষের কথাই বলবে। কিন্তু দ্বীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়।’ জঙ্গীবাদী কাজকর্মের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে মুসলিম বিশ্ব বেশি আক্রান্ত। এমনকি গত ৪ জুলাই ২০১৬ মদিনা শরিফের মসজিদে নববীতে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ প্রমাণ করে জঙ্গীরা ইসলাম ধ্বংস করতে চায়। ইসলামের সঙ্গে, কোরানের সঙ্গে, হাদিসের সঙ্গে এদের ন্যূনতম সম্পর্কও নেই। এ ধরনের আত্মঘাতী বোমা হামলা মূলত আত্মহত্যার শামিল। আর আত্মহত্যার পরকালীন ফলাফল কী? সে সম্পর্কে এই সমস্ত গোমরা আত্মদানকারীকে কে বোঝাবে? জঙ্গীবাদ থেকে বাঁচার উপায় ইসলাম ধর্ম নিয়ে বাংলাদেশের মসজিদ মাদ্রাসায় কোথায় কী আলোচনা হয় সরকারের কাছে সে বিষয়ে সব সংবাদ থাকে না। আমরা আমাদের রোগ নিরাময়ের জন্য এফসিপিএস ডাক্তারের কাছে যাই। কিন্তু ধর্মীয় বিষয়ে সমস্যার সৃষ্টি হলে, হাতের কাছে যাকে পাই তার পরামর্শ নিয়ে ফেলি। এতে সঠিক বিষয় যেমন অনেক সময় জানা যায় না, তেমনি বিভ্রান্তিকর ও অযৌক্তিক কথায় ইসলামের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়। সুতরাং সত্যিকার আলেমদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করে সকল ফতোয়া ও বক্তব্য টেস্টিফাই করা উচিত। পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইসলামের সঠিক শিক্ষা জনগণের সামনে তুলে ধরা আবশ্যক। ইলেকট্রনিক, প্রিন্টমিডিয়াসহ সামাজিক সকল যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিদিন সত্যিকার বিজ্ঞ আলেম দ্বারা ইসলামের মূল ও শান্তিবাদী শিক্ষা প্রচারের ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়। সকল শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানে সকল শ্রেণীতে জঙ্গীবাদবিরোধী পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্তি। সভা, সেমিনার, গণসঙ্গীত, নাট্য আন্দোলন, ব্যানার, ফেস্টুন ও দেয়াল লিখনের মাধ্যমে জঙ্গীবাদবিরোধী প্রচারণাকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়া। প্রয়োজন জঙ্গীবাদবিরোধী দিবস পালনের মাধ্যমে ইসলামের সুমহান শান্তির বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। সামান্য জেনেই বা একেবার না জেনেই ফতোয়াবাজি ইত্যাদি কারণে জঙ্গীবাদ সমগ্র বিশ্বে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। অর্থনৈতিকভাবে ও জ্ঞান বিজ্ঞানে দুর্বল মানুষকে টার্গেট করে একশ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী ও সাম্রাজ্যবাদী গডফাদার তাদের ফায়দা লুটছে। সহস্র বছরের শান্তির প্রতীক অসাম্প্রদায়িক বাঙালী সংস্কৃতিকে জাগিয়ে তুলে জঙ্গীবাদকে ঝেঁটিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলার মাধ্যমে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হোকÑ এটাই জাতি হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা। লেখক : বাংলাদেশ বেতারের গীতিকার hafi“[email protected]
×