ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দিনযাপনে রবীন্দ্রসঙ্গীত

প্রকাশিত: ০৭:০০, ৮ মে ২০১৭

দিনযাপনে রবীন্দ্রসঙ্গীত

পপি দেবী থাপা ॥ বিশ্বসাহিত্যাকাশে এক চির উজ্জ্বল নক্ষত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর গৌরবান্বিত পদচারণা বাংলা সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ। তাঁর সকল সৃষ্টির মাঝে গান অনবদ্য। যা মূলত গীতিকাব্য। যেখানে কাব্যরস গীতরসের আচ্ছাদনে তার মহিমা প্রকাশিছে। এক গান জীবনের ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়ে ভিন্ন রকম অর্থ বহন করে। আবার ভিন্ন পরিস্থিতিতে তার প্রকাশ হয় ভিন্নতর। পূজা প্রেম প্রকৃতি সবকিছুর এক অফুরন্ত ভা-ার তাঁর গীতিকাব্য। যা সুরলহরিতে এক একটি জীবন্ত ছবি। কিছু ক্ষেত্রে তাঁর গানকে মনে হয় প্রেমের প্রকাশ। আবার এ প্রেম প্রার্থনায় হয় বিলীন। সমন্বয় ঘটে প্রেম ও পূজার। তাঁর লেখনীর প্রতিটি শব্দের ভাঁজে ভাঁজে যেন জীবনের প্রতিটি ঘটনা আটকে রয়েছে। মনে হয় উনি যেন জানতেন এমন হতে পারে, এ কারণে হয়ত তাঁর এ রচনা, আমারি জন্য তাঁর এ সৃষ্টি। সকলের অনুভূতির সঙ্গে বহু যুগের পরিচয় তাঁর। তাই তো তিনি বিশ্বকবি। তাঁর গানের সুধারসের স্রোতধারায় গোটা বিশ্ব ভাসছে। জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর গান শক্তি, প্রেরণা, কল্যাণে উচ্চমাত্রার সহায়ক হিসেবে কাজ করে। নব প্রভাতের আহ্বানে : নতুন দিনের শুভ শুচনা হতে পারে রবি ঠাকুরের গানের হাত ধরে। সকাল বেলার নির্মল আনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে তা সারা দিনের কর্মউদ্দীপনার খোরাক যোগাবে। তাঁর অনেক গানের মধ্যে থেকে আমরা বেছে নিতে পারিÑ নব আনন্দে জাগো আজি নব রবিকিরণে শুভ্র সুন্দর প্রীতি- উজ্জ্বল নির্মল জীবনে। অথবা নূতন প্রাণ দাও, প্রাণসখা, আজি সুপ্রভাতে। প্রার্থনা : কণ্টকাপূর্ণ মানবজীবনে চলার পথে দুঃখ, কষ্ট সঙ্গী হবে। এরি মধ্য দিয়ে জীবনে নতুন শক্তি সঞ্চারের জন্য রবি ঠাকুরের গানের বিকল্প কিছু হতে পারে না। তাঁর গানে প্রেম, পূজা প্রার্থনা একি সঙ্গে বিরাজমান। যেমন- অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ। অন্তর মম বিকশিত কর অন্তরতরহে, নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে। তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি গানের সুরে। আজি মম মন চাহে জীবনবন্ধুরে। প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুরÑ তুমি দেহো মোরে কথা, তুমি দেহো মোরে সুরÑ আরো বেদনা আরো বেদনা, প্রভু দেহো মোরে আরো চেতনা। দ্বার ছুটায়ে বাঁধা টুটায়ে মোরে করো ত্রাণ, মোরে করো ত্রাণ। যদি এই আমার হৃদয় দুয়ার বন্ধ রহে গো প্রভু, দাঁড় ভেঙে তুমি এস মোর প্রাণে ফিরিয়া যেও না প্রভু। চরণ ধরিতে দিয়োগো আমারে নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে। জীবন যখন শুকায়ে যায় করুনা ধারায় এসো। ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা তোমার পানে, প্রভু তোমার পানে। প্রভু আমার, প্রিয় আমার পরম ধন হে। সমর্পণ : আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলায় দোলাও। আমার সকল রসের ধারা তোমাতে আজ তোমাতে হোক না সারা। তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি আমি ডুবতে রাজি আছি আমি ডুবতে রাজি আছি। আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে। সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে। আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে, তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবন মাঝে। আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানিÑ আমার যত বিত্ত, প্রভু, আমার যত বাণী। অন্তরযামী, ক্ষমো সে আমার শূন্য মনের বৃথা উপহারÑ পুষ্পবিহীন পূজা আয়োজন, ভক্তিবিহীন তান। কর্ম উদ্দীপনায় : যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ। সঞ্চার কর সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ। কৃতজ্ঞতায় : আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব। জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ ধন্য হলো ধন্য হলো মানব জনম। এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর! পুণ্য হলো অঙ্গ মম, ধন্য হলো অন্তর সুন্দর হে সুন্দর। অনুশোচনায় : আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি, তোমায় দেখতে আমি পাইনি। প্রেমে অভিমান : তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ ও মোর ভালোবাসার ধন। গানটি পূজা পর্যায়ের হলেও প্রেম রসে পরিপূর্ণ। ওগো তুমি আমার নও আড়ালের তুমি আমার চিরকালের, ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হওযে নিমগ্ন ওমোর ভালোবাসার ধন। প্রেমে আকুতি প্রকাশিতে : শুধু তোমার বাণী নয়গো হে বন্ধু হে প্রিয় মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশ খানি দিও। নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে। হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে। দৃঢ়চিত্তে : নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা। মন রে মোর পাথারে হোস নে দিশেহারা। রাখিয়ো বল জীবনে, রাখিয়ো চির আশা, শোভন এই ভুবনে রাখিয়ো ভালোবাসা। নতুনের আহ্বান : তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে, এসো গন্ধে বরণে এসো গানে। হৃদয়নন্দনবনে নিভৃত এ নিকেতনে। এসো হে আনন্দময়, এসো চিরসুন্দর। শুভদিন শুভরজনী আনো এ জীবনে, ব্যর্থ এ নরজনম সফল করো প্রিয়তম। ব্যাকুলতায় : তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে কেউ তা জানে না, আমার মন যে কাঁদে আপন- মনে কেউ তা মানে না। ফিরি আমি উদাস প্রাণে, তাকাই সবার মুখের পানে, তোমার মতন এমন টানে কেউ তো টানে না। আজ জ্যোৎ¯œারাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে। তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি। শঙ্কা নিরসনে : বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে উর্ধ্বমুখে নরনারী। কেন এ হিংসাদ্বেষ, কেন এ ছদ্মবেশ, কেন এ মান- অভিমান। অনুসন্ধানে : আমি কান পেতে রই ও আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে। জাগরণে : জাগে নাথ জোছনারাতেÑ জাগো, রে অন্তর, জাগো। যে ধ্রুবপদ দিযেছ বাঁধি বিশ্বতানে মিলাব তাই জীবনগানে। এখনো ঘোর ভাঙে না তোর যে, মেলে না তোর আঁখিÑ। মন, জাগ’ মঙ্গললোকে। আকুতি : যদি প্রেম দিলে না প্রাণে কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে? সত্যানুসন্ধানে : কে গো অন্তরতর সে! আমার চেতনা আমার বেদনা তারি সুগভীর পরশে। আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর। মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে আমি মানব একাকী ভ্রমি বিশ্বয়ে। নিবেদন : ওই আসনতলের মাটির পরে লুটিয়ে রব। তোমার চরণ ধুলায় ধুলায় ধূসর হব। সংশয় নিরসনে : সংশয় তিমির মাঝে না হেরি গতি হে। ‘শংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’ গানগুলো সংশয় দূরীকরণে পাথরের মতো আঘাত হানে দৃঢ় হতে শক্তি যোগায়। ভালোবাসা : মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না? কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না? শেষের অন্তরায় আর কারো পানে চাহিব না আর, করিব হে আমি প্রাণপণÑ তুমি যদি বল এখনি করিব বিষয়বাসনা বিসর্জন। পূজা পর্যায়ের এই গানটি ভালোবাসাভিত্তিক এক বিশেষ ভাবাবেগ রয়েছে। যা প্রেমের ব্যাকুলতার বহিঃপ্রকাশ। চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, সহে না যাতনা, আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার। গানগুলো ভালোবাসার দোলায় আপ্লুত করে তোলে। শক্তি সঞ্চয়ে : আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া। শক্তি জাগিয়ে জগত সভায় নিজের প্রকাশ ঘটাতে সহায়ক হয়। অবসাদ দূর করে মুক্তিকে করে আহ্বান : আনন্দধারা বহিছে ভুবনে, চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি, ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে। আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে, আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে। গানগুলো চিন্তা চেতনার মুক্তির দুয়ার খুলে দেয়। বিরহে/অভিমানে : হার-মানা হার পরাব তোমার গলেÑ ভালোবেসে যদি সুখ নাহি, তবে কেন, তবে কেন মিছে ভালোবাসা, মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে। এই জাতীয় গানগুলো বিরহ অভিমানে হতে পারে আপনার সাথী। মৃত্যু, শোক মুক্তি : আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। নিস্তব্ধতায় : ও চাঁদ চোখের জলে লাগলো জোয়ার। স্বদেশ প্রেমে : দেশ প্রেমে তাঁর গান সঞ্জীবনী শক্তি। কি স্বাধীনতা চেতনায়, কি মুক্তির সংগ্রামে তাঁর গান জাগ্রত চেতনার শক্তির সম্ভার। দেশমাতৃবন্দনায় তা গভীর অনুভূতির রেখা টানে। এ কারণে তাঁর রচিত দুটি গান দু দেশের জাতীয় সঙ্গীত। ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেঁকাই মাথা। নিশিদিন ভরসা রাখিস হবে হবে। মা কি তুই পরের দ্বারে পাঠাবি তোর ঘরের ছেলে। যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক। প্রকৃতি প্রেমে তার গান : আকাশ আমায় ভরলো আলোয় আকাশ আমি ভরব গানে। আজ কিছুতে যায় না মনের ভার। তিমির অবগুণ্ঠনে, আমার দিন ফুরালো, মেঘের পরে মেঘ জমেছে গানগুলো প্রকৃতি প্রেমের ভিতর দিয়ে হৃদয়ে এক গভীর ভাবাবেগের সৃষ্টি করে। কবিগুরু বেঁচে রইবেন অনন্তকাল তাঁর গানে- বাঙালীর জীবনযাপনে।
×