ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আরপিওর ধারা বাতিলে এক শ্রেণীর আমলার দৌড়ঝাঁপ শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৮ মে ২০১৭

আরপিওর ধারা বাতিলে এক শ্রেণীর আমলার দৌড়ঝাঁপ শুরু

শাহীন রহমান ॥ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে এক শ্রেণীর আমলার মধ্যে। তারা চান আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে তাদের পথটা যেন সহজ করা হয়। অবসরের পরেই তারা যেন নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। এ জন্য ‘অবসরের তিন বছর পার না হলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না সরকারী কর্মকর্তারা’ আরপিওর এই ধারা বিলোপ চান তারা। তবে নির্বাচন কমিশন থেকে এ বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিধান বাতিল করলে প্রশাসনে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়বে। এছাড়াও চাকরিতে থাকা অবস্থায় তারা নিজের এলাকায় ক্ষমতার অপব্যবহার করতে তৎপর হয়ে পড়বেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক দলের নেতাদের ডিগবাজি ও নির্বাচনের সময় মনোনয়ন বাণিজ্য রোধ করতেও রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের তিন বছরের সদস্যপদ থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু আইনের এই ধারা বিলোপের কারণে ডিগবাজি ও মনোনয়ন বাণিজ্যের পথ এখন উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। এখন যদি সরকারী কর্মকর্তাদের নির্বাচনের সুযোগ দিতে ‘অবসরের তিন বছর পার না হলে নির্বাচন করতে পারবে না’ এই ধারাও বাতিল করা হয় তাহলে প্রশাসনে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু হবে। ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রকিব কমিশনের সময় ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই নির্বাচনে প্রার্থী হতে দলীয় সদস্যপদ থাকার বিধানটি তুলে দেয়া হয়েছে। যা ছিল কমিশনের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত। এ অবস্থায় যদি আবার আইন সংস্কার করে আমলাদের নির্বাচনের পথ সুগম করে দেয়া হয় তাহলে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আমলাদের হাতে চলে যাবে। নির্বাচনের সময় টাকার খেলা শুরু হবে। ফলে মঠের রাজনীতিবিদরা বিমুখ হয়ে পড়বে। তাদের জন্য অবসরের পরে নির্বাচনের বাধা তুলে দেয়া হয় তাহলে প্রশাসনেও বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছে কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। বর্তমান কমিশনের সামনে দেশের ছয়টি সিটি কর্পোরেশন ছাড়া আর কোন নির্বাচন নেই। ফলে তারা এখন থেকেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি রোডম্যাপ তৈরি করছে। রোডম্যাপে নির্বাচনী আইন সংশোধন, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, দল নিবন্ধন ও আগামী জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয় রয়েছে। এসব বিষয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও নাগরিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্তও নিয়েছে তারা। জানা গেছে, আইন সংস্কারের যে উদ্যোগ বর্তমান কমিশন নিয়েছে এরই ধারাবাহিকতায় আমলারা পরামর্শ দিয়েছেন যে আইন সংস্কার করে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথটা যেন তাদের জন্য সহজ করা হয়। তারা চান আইন সংস্কার করে সরকারী কর্মকর্তাদের অবসরের ‘তিন বছর পার না হলে নির্বাচন করতে পারবে না’ এই ধারা আরপিও থেকে তুলে দেয়া হোক। যাতে তারা অবসরের পরেই নির্বাচনে অংশ নিতে কোন বাধা না থাকে। শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন আমলাদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি রোধ করতে অবসরের তিন বছর পার না হলে নির্বাচন করতে পারবে না মর্মে একটি ধারা আরপিওতে যোগ করেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলে অন্তত তিন বছর সদস্য থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। কিন্তু রকিব উদ্দিন কমিশন দায়িত্ব নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের দলের সদস্যপদ থাকার তিন বছরের বাধ্যতামূলক বিধান বাতিল করে দেয়। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তারা আরপিও থেকে এই ধারাটি তুলে দেন। তবে ‘সরকারী কর্মকর্তাদের অবসরের তিন বছর পার না হলে নির্বাচন করতে পারবে না’ বিধানটি বহাল রাখেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যে কয়েকজন সরকারী আমলা এই ধারা বাতিলের জন্য নির্বাচন কমিশনে যোগাযোগ করছেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১২ অনুচ্ছেদে (উপধারা এফ ও এইচ) বলা হয়েছে, সরকারী চাকরি থেকে অবসর বা অপসারণের তিন বছর পার না হলে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে না। সশস্ত্র বাহিনী বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ও সরকারী চাকরিতে চুক্তিভিত্তিক চাকুরেদের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য। এখন এই ধারা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন তারা। ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ সহজ করতে ইতোমধ্যে কয়েক সাবেক আমলা ইতোমধ্যে যোগাযোগ করেছেন। আইন সংস্কার করে তাদের নির্বাচনের বাধা হয়ে দাঁড়ানোর বিধানটি বিলোপ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে জানা গেছে, কয়েক আমলা এ ধরনের প্রস্তাব দিলেও নির্বাচন কমিশন এখনি বিষয়টি নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। কমিশন জানিয়েছে, এখনও কোন লিখিত প্রস্তাব কমিশনের কাছে আসেনি। এ বিষয়ে লিখিত কোন প্রস্তাব এলে সবকিছু বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, সবকিছু বুঝে-শুনে করতে হবে। কমিশনের স্টেকহোল্ডার বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কোন প্রস্তাব এলে তখন এ বিষয়ে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আবদুল আলীম বলেন, আমলাদের প্রস্তাব মেনে তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথ সহজ করতে প্রার্থিতার শর্ত শিথিল করা কোনক্রমেই সমীচীন হবে না। তিন বছরের ওই বাধা না থাকলে অনেকেই চাকরিতে থাকা অবস্থায় নিজের এলাকায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা করতে পারেন। বিধানটি তুলে দিলে প্রশাসনে দলীয় প্রভাব আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে উল্লেখ করেন। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর বা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষযটি মাথায় রেখেই তারা জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি করেছেন। রোডম্যাপে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর বা তারপরে তফসিল ঘোষণার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, নাগরিক প্রতিনিধি, গণমাধ্যম ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে কয়েক দফায় আলোচনা বা সংলাপ করার কথা বলা হয়েছে। এই সঙ্গে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) অস্পষ্ট এবং অপ্রাসঙ্গিক ধারাগুলো বাতিল বা সংশোধন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, আইনের কিছু ধারা আছে যা বর্তমানে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সেগুলো সংশোধন করা দরকার। ভাল নির্বাচনের জন্য আইনে নতুন কোন ধারা যুক্ত করতে হবে কি না, সেটাও দেখতে হবে। একজন কমিশনারও উল্লেখ করেছেন কোন কোন আইনের সংস্কার প্রয়োজন রয়েছে। নতুন ধারাও সংযোজনের দরকার রয়েছে। জানা গেছে, আগামী জুন থেকেই আইন সংশোধনসংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরির মাধ্যমে কাজ শুরু হবে। আইনের একটি খসড়া সংশোধনী তৈরি করে সেটি নিয়ে সংলাপ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। সংলাপে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দল, নাগরিক প্রতিনিধি ও গণমাধ্যমের মতামত নেয়া হবে।
×