ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই বেসরকারী ভার্সিটি শিক্ষার্থী ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করা হয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৮ মে ২০১৭

দুই বেসরকারী ভার্সিটি শিক্ষার্থী ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করা হয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর বনানীর দ্য রেইন ট্রি হোটেলে গণধর্ষণের শিকার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, ধর্ষণের ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করেছিল ধর্ষকরা। ঘটনার পর এক ধর্ষকের দেহরক্ষীরা তাদের ছায়ার মতো নিয়মিত অনুসরণ করত। তাদের বাসায় গিয়ে খোঁজখবর নিত। এমনকি ধর্ষণের ভিডিও আপলোড কারার হুমকিও দেয়া হতো। কিন্তু ধর্ষকদের সীমা অতিক্রম করায় তারা বনানী থানায় বিষয়টি জানান। তারা অভিযোগ করেন, দুদিন ধরে তারা থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ দিলেও থানা পুলিশ মামলা নিতে টালবাহানা করে। দুদিন পর থানা পুলিশ তাদের মামলা নেয়। অন্যদিকে রবিবার দুপুর ১টার দিকে বনানী থানার দুই নারী পুলিশ সদস্য ধর্ষিত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে তেজগাঁওয়ে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ফরেসনিক বিভাগে নিয়ে আসেন। এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে গঠিত পাঁচ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। এর আগে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঁচ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑ ডাঃ মমতাজ আরা, ডাঃ নিলুফার ইয়াসমিন, ডাঃ কবিতা সাহা ও ডাঃ কবির সোহেল। এ বিষয়ে বোর্ডের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানান, দুই ভিকটিমকে আমরা পেয়েছি। পাঁচ সদস্যদের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে তিনটি করে পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষাগুলো হলোÑ ম্যাক্রোবায়োলজি, রেডিওলজিক্যাল ও ডিএনএ প্রোফাইলিং। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দিতে পারব। তিনি জানান, ঘটনাটি বেশ কিছুদিন আগের হওয়ায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া কঠিন হবে। তাই এখন আমরা তথ্য-প্রমাণের (এভিডেন্স) ওপর নির্ভরশীল। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ফেসবুকে যা লিখলেন সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জন্মদিনের পার্টিতে নিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল ফেসবুক। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলমও এ বিষয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তাতে তিনি লিখেছেন, আপনারা যারা সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, বিল্লাল হোসেন, সাদনান ও সাকিফকে চেনেন, তারা দয়া করে বনানী থানায় বিস্তারিত জানান। ছবি প্রকাশ করুন যেন অন্য কেউ তাদের খোঁজ দিতে পারে। এদের মধ্যে সাফাত ও নাঈম দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা ওই দুই ছাত্রীর বন্ধু বলে পরিদর্শক মতিন জানান। এরাই অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের ধর্ষণ করে বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন দুই ছাত্রী। মামলার এজাহারে যা ছিল মামলার এজাহারে ধর্ষিতা শিক্ষার্থী উল্লেখ করেন, ধর্ষণের ঘটনাটি ভিডিও করেছিল ধর্ষকরা। এরপর ভিডিও প্রকাশ করে দেয়ার হুমকি দিয়ে আসছিল তারা। এতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এজাহারে বলা হয়, সাদমান সফিক তাদের পূর্বপরিচিত। প্রায় দুই বছর থেকে তার সঙ্গে পরিচয় রয়েছে। ঘটনার ১০-১৫ দিন আগে গুলশান-২ নম্বরের ৬২ নম্বর রোডের ২ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদের সঙ্গে পরিচয় হয় তাদের। এরপর জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে গত ২৮ মার্চ সাফাত আহমেদ তার গাড়ি পাঠিয়ে ড্রাইভার ও বডিগার্ডের মাধ্যমে তাদের (তরুণীদের) বাসা থেকে বনানীর রেইন ট্রি হোটেলের ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়। এজাহারে আরও বলা হয়, সেখানে অনেক লোক থাকবে। অনুষ্ঠানটি হবে হোটেলের ছাদে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর কোন ভদ্রলোককে আমরা দেখতে পাইনি। সাফাত, নাঈম ও সফিক ছাড়াও সেখানে আরও দুটি মেয়ে ছিল। তাদের ওই হোটেলে নিয়ে যাওয়ার পর আগে থেকে সেখানে থাকা অন্য দুটি মেয়েকে সাফাত ও নাঈম বারবার নিচে নিয়ে যাচ্ছিল। সেখানকার পরিবেশ ভাল না লাগায় আমরা চলে যেতে চাচ্ছিলাম। এজাহারে আরও বলা হয়, একপর্যায়ে তাদের দুজনকে একটি কক্ষে নিয়ে জোরপূর্বক মদ্যপান করিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয়। এ সময় সাফাত তার ড্রাইভার বিল্লালকে ধর্ষণের ভিডিও করতে নির্দেশ দেয়। তখন ড্রাইভার বিল্লাল ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে। পরবর্তীতে সাফাত তার দেহরক্ষীকে তাদের (তরুণীদের) বাসায় পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ও ভয়ভীতি দেখায়। হুমকি ও লোকলজ্জার ভয়ে একপর্যায়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তারা, যে কারণে মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। থানায় দুদিন ঘোরাঘুরির পর শনিবার বিকেলে তরুণীরা বনানী থানায় ধর্ষকদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামিরা হলোÑ সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, সাদমান সফিক, ড্রাইভার বিল্লাল ও সাফাত আহমেদের বডিগার্ড (অজ্ঞাত)। ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান জোনের এডিসি আব্দুল আহাদ জানান, ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের ধরতে পুলিশের একাধিক টিম বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। তবে এখনও কোন আসামি ধরা পড়েনি। তিনি জানান, হোটেল কর্তৃপক্ষ সর্বশেষ এক মাসের ফুটেজ সংরক্ষণ করে থাকে। তাই ধর্ষণের ঘটনার কোন ফুটেজ পাওয়া যায়নি। রেইন ট্রি হোটেলের এক কর্মকর্তা নাম-পরিচয় প্রকাশ না করে বলেন, তাদের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছিল ধর্ষকদের ওই গ্রুপটি। এর বাইরে আর কোন কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি জানান, যা বলার পুলিশকেই বলব। ধর্ষণের শিকার এক শিক্ষার্থী জানান, লোকলজ্জার ভয়ে তারা বিষয়টি চেপে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আসামির তরফ থেকে অব্যহত প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হচ্ছিল। আসামির দেহরক্ষী তাকে নিয়মিত অনুসরণ করতে থাকে। দুজনের বাসায় গিয়ে খোঁজখবর নেয়। এমনকি ধর্ষণের ভিডিও আপলোড কারার হুমকিও দেয়া হয়। দুই মাস দুই তরুণী চরম অসহায়ত্বের মধ্যে পড়েন। লোকলজ্জার ভয়ে তারা বিষয়টি চেপে গিয়েছিলেন। ভুক্তভোগীরা জানান, ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর দুদিন আগে বিষয়টি থানার ওসি তদন্তকে জানান। পরে তারা থানায় মামলা করতে চেয়েছিলেন। তারা অভিযোগ করেন, থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা আসামিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়েছেন। এজন্য মামলা নিতে থানাকে রাজি করাতে টানা ৪৮ ঘণ্টা ‘যুদ্ধ’ করতে হয়েছে তাদের। সে কারণেই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সারারাত থানায় কাটাতে হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন।
×