ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী ঝিনাইদহে ॥ দু সপ্তাহের মধ্যেই ফের অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৮ মে ২০১৭

জঙ্গী ঝিনাইদহে ॥ দু সপ্তাহের মধ্যেই ফের অভিযান

সাজেদ রহমান/এম.রায়হান, ঝিনাইদহ থেকে ॥ ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বজরাপুর হঠাৎ পাড়া ও সদর উপজেলার লেবুতলা গ্রামের পৃথক দু’টি জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। পরে বজরাপুর গ্রামে জঙ্গী আস্তানায় ‘অপারেশন সাটল স্পিøট’ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। রবিবার রাত নয়টার দিকে মহেশপুর থানায় প্রেস ব্রিফিং করে খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি দিদার আহমেদ এ ঘোষণা দেন। বজরাপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে সর্বশেষ দুটি পিস্তল ও চারটি বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটার মধ্যে চারটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। মহেশপুরের বজরাপুর জঙ্গী আস্তানায় অভিযানে নিহত হয়েছে দুই জঙ্গী। অভিযানে আহত হন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এডিসি নাজমুল ইসলাম ও মহেশপুর থানার এসআই মহসিন। আহত এডিসি নাজমুল ইসলামকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এসআই মহসিনকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় বজরাপুর জঙ্গী আস্তানার মালিক জহুরুল ইসলাম, তার ছেলে জসিম ও লেবুতলার জঙ্গী আস্তানা থেকে শামীম নামে একজনকে আটক করা হয়েছে। লেবুতলা থেকে একটি নাইনএমএম পিস্তল, আটটি বোমা, বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। জঙ্গী আস্তানার দুইশ’ গজের মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এদিকে নিরাপত্তার কথা ভেবে রাতের বেলা লেবুতলা গ্রামের অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। জঙ্গী আস্তানাটি পুলিশ এবং কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা কর্ডন করে রেখেছে। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুবিধামতো সময়ে ওই আস্তানায় অভিযান শুরু করা হবে। ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঢাকা থেকে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা মহেশপুরের বজরাপুর গ্রামে পৌঁছে জঙ্গী আস্তানায় অভিযান শুরু করেন। এরপর জঙ্গী আস্তানার আশপাশের বাড়ি থেকে সকল লোকজনকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার জন্য মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়া জেনারেটর দিয়ে এলাকায় আলোর ব্যবস্থা করা হয়। অভিযানে কাউন্টার টেররিজম ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের এডিসি সাইফুল ও মান্নান উপস্থিত ছিলেন। এদিকে অভিযান শেষ করার আগে সন্ধ্যার পর পুলিশের পক্ষ থেকে স্থানীয় লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলার পর গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাদের অনেকেই গরু, ছাগল নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে থাকেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বজরাপুরের জঙ্গী আস্তানায় বিকট শব্দে একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। বোমার শব্দে এলাকা কেঁপে ওঠে। রাত আটটা পর্যন্ত এরপর আরও তিনটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। সর্বশেষ খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি দিদার আহম্মেদ জানান, নিরাপত্তার কথা ভেবে রাতের বেলা লেবুতলা গ্রামের অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। তবে ওই গ্রামের জঙ্গী আস্তানাটি পুলিশ এবং কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা কর্ডন করে রেখেছে। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুবিধামতো সময়ে ওই আস্তানায় অভিযান শুরু করা হবে। এদিকে সকাল থেকেই খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ, এডিশনাল ডিআইজি হাবিবুর রহমান, ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম তালুকদার ঘটনাস্থলে অবস্থান করেন। এছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাও ঘটনাস্থলে ছিলেন। খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি দিদার আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানান, বজরাপুর গ্রামের নব্য জেএমবির আস্তানাটিতে সকালে অভিযান শুরু করলে ভেতর থেকে জঙ্গীরা বোমা ও গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক জঙ্গী নিহত হয়। এ সময় ঘরের ভেতরে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আরও এক জঙ্গী আত্মহত্যা করে। সেসময় বাড়ির মালিক জহুরুল ইসলাম ও তার ছেলে জসিমকে গ্রেফতার করা হয়। ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বজরাপুর গ্রামের হঠাৎপাড়ায় জহুরুল ইসলাম নামের এক জনের বাড়িতে জঙ্গীরা অবস্থান করছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার রাতে বাড়িটি ঘিরে রাখা হয় এবং রবিবার সকাল থেকে অভিযান শুরু হয়। অভিযানে অংশ নেয় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও স্থানীয় পুলিশ। অভিযান চলাকালে ভেতর থেকে জঙ্গীরা গুলি ছোড়ে সে সময় এসআই মহসিন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। অভিযানের সময় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এডিসি নাজমুল ইসলামের একটি হাত ভেঙ্গে গেছে। আহতদের প্রথমে কোটচাঁদপুর হাসপাতালে ও পরে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখান থেকে বেলা ১১টার দিকে এডিসি নাজমুল ইসলামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ আস্তানা থেকে জহুরুল ইসলাম ও জসিম নামে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং লেবুতলা থেকে শামীম নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জঙ্গী আস্তানায় ভেতরে বোমা, বিস্ফোরক, সুইসাইডাল ভেস্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে পারে। সে কারণে এখন জঙ্গী আস্তানা দু’টি ঘিরে রাখা হয়েছে। এদিকে বজরাপুর গ্রামে নিহত একজন জঙ্গীর নাম তুহিন বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে তার ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই জানা যায়নি। এছাড়া নিহত অপর জঙ্গীরও নাম পরিচয় জানা যায়নি। বজরাপুর গ্রামের আলতাফ হোসেন জানান, ভোরবেলা হঠাৎ করে দেখছি গ্রামে ব্যাপক পুলিশ ঢুকেছে। দেখলাম তারা গ্রামের জহুরুল ইসলামের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। একটু পরেই বাড়ির ভেতরে বিকট শব্দে বোমার বিস্ফোরণ হয়। গুলির শব্দও শুনতে পাই। আস্তে আস্তে জানতে পারলাম জহুরুলের বাড়িতে পুলিশের অভিযান চলছে। এখানে জঙ্গী আছে। এরপর ভয়ে ভীত হয়ে পড়লাম। জানলাম দুজন জঙ্গী নিহত হয়েছে। পুলিশও আহত হয়েছে দুজন। তিনি বলেন, যে বাড়ির পাশ দিয়ে প্রতিদিন আসা যাওয়া করতাম সেখানে জঙ্গীদের আস্তানা জানতে পেরে আরও ভয় পাচ্ছি। তার মতো গ্রামের অনেকেই বলেছেন, জহুরুল জঙ্গী হওয়ার কারণেই তার বাড়ির ভেতরে কাউকে ঢুকতে দিত না। গ্রামবাসী এসব জঙ্গীদের দৃষ্টান্তমূল শাস্তির দাবি জানান। প্রতিবেশী আনোয়ার হোসেন জানান, দেখে মনে হতো বড় হুজুর। ভেতরে ভেতরে এ ধরনের খারাপ তা আমরা ভাবতে পারেনি। গ্রামবাসী আরও জানায়, জঙ্গী সন্দেহে আটক জহুরুল ইসলাম একজন চা-দোকানি। খালিশপুর বাজার মসজিদের কাছে তিনি চায়ের দোকানদারি করতেন। তবে সম্প্রতি সেখান থেকে দোকানটি উচ্ছেদ হয় বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। এর আগে তিনি খাস্তাজাতীয় মিষ্টি বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তারা বলছেন, জহুরুল ইসলামের বাবার নাম নুরুল ইসলাম নুরু। জহুরুল অত্যন্ত ধর্মভীরু লোক ছিলেন। নিয়মিত নামাজ পড়া ছাড়াও তিনি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতেন পুরোপুরি। আর অনুসারী ছিলেন চরমোনাই পীরের। তার বাড়ির স্ত্রীলোকেরা খুবই পর্দানসীন। মহেশপুর থানার ওসি আহমেদ কবিরও এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। প্রতিবেশী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জহুরুল এখানে বাড়ি তৈরি করে ৮-১০ বছর বসবাস করছেন। নিরীহ, ধর্মভীরু মানুষ হিসেবেই তাকে দেখেছি। কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার সংশ্রব দেখিনি।’ তবে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজিপি) দিদার আহমেদ গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন, বাড়িটি নব্য জেএমবির আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। নিহত দুইজনও নব্য জেএমবির ক্যাডার বলে তারা মনে করছেন। জহুরুল ইসলাম স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে ওই বাড়িটিতে বসবাস করতেন। তার তিন সন্তানের মধ্যে জসিমকে (২৫) আটক করেছে পুলিশ। অন্য দুটি মেয়ে- সায়রা (১৩) ও রাবেয়া (৭)। লেবুতলা গ্রামে জঙ্গী অভিযান এছাড়া লেবুতলা গ্রাম ঝিনাইদহ শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে। সদর উপজেলার কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের এই লেবুতলা গ্রামের জনৈক শরাফত হোসেন ম-লের বাড়ি রাত থেকে ঘিরে অভিযান চালানো হয়। জঙ্গী আস্তানা সন্দেহে ওই বাড়িতেও অভিযান চালায় পুলিশ। ওই বাড়ি থেকে ৮টি বোমা ও ১টি নাইন এমএম পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে শরাফত হোসেনের ছেলে শামীম হোসেনকে। শামিম হোসেন ঝিনাইদহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত ২১ এপ্রিল ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পোড়াহাটি গ্রামে একটি জঙ্গী আস্তানায় আব্দুল্লাহর বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। পরদিন ২২ এপ্রিল ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় ২০ ড্রাম হাইড্রেন পার অক্সাইড, ১০০টি লোহার বল, ৩টি সুইসাইডাল ভেস্ট, ৯টি সুইসাইডাল বেল্ট, বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রিক সার্কিট, ১৫টি জিহাদী বই, ১টি বিদেশী পিস্তল, ১টি ম্যাগজিন, ৭ রাউন্ড গুলি, ১টি মোটরসাইকেল, ১টি চাপাতি, বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, ৮ থেকে ১০ কেজি ওজনের ৬টি শক্তিশালী বোম। এর মধ্যে ৩টি সুইসাইডাল ভেস্ট ও ২টি বোম নিস্ক্রিয় করা হয়। কোন জঙ্গী পাওয়া যায়নি। জানা যায়, আব্দুল্লাহর বাড়িতে পুলিশী অভিযানের আগেই সে চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে যায়। সেখানে এক জঙ্গী আস্তানায় সে ২৬ এপ্রিল বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় বলে পুলিশ জানায়। আব্দুল্লাহ পোড়াহাটি গ্রামের চৈতে বিশ্বাসের ছেলে প্রভাত ওরফে বেড়ে। সে ৫ বছর আগে ধর্মান্তরিত হয়ে পোড়াহাটি গ্রামে বসবাস করছিল।
×