ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

সবুজ অর্থনীতিতে নতুন আশা

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ৭ মে ২০১৭

সবুজ অর্থনীতিতে নতুন আশা

ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরের লোকসংখ্যা অনুযায়ী যে পরিমাণ গাছ থাকার কথা, তার সিকি ভাগের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায় না। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে পৃথিবীর দেশে দেশে নগর পরিকল্পনায় যোগ হচ্ছে সবুজ প্রকৃতির। ছাদ কৃষি পরিবেশের ভারসাম্যতা রক্ষার পাশাপাশি সবুজ অর্থনীতিতে নতুন সংযোজন হিসেবে আশা জাগিয়েছে। ছাদ কৃষির মাধ্যমে বাগান বিস্তারে ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে। দালান-কোঠার সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি তাপমাত্রা হ্রাস করা সম্ভব হচ্ছে। ছাদের সবুজ স্তর বিভিন্ন ট্রান্সমিটিং স্টেশন থেকে নিঃসরিত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রতিহত করছে। মোট কথা ছাদ কৃষি নগরজীবনে বহুমাত্রিক সুবিধা ও সম্ভাবনার উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন- একটা সবজি গাছ তিন মাসের জন্য হলেও বায়ু থেকে তিনজনের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন রিসাইক্লিন করতে পারে। তাহলে তিন মাস কালের সবজি কিংবা বহুবর্ষী ফলের গাছ লাগিয়ে বায়ুর পরিশুদ্ধতা রক্ষা করা সম্ভব হলে আমাদের উচিত ছাদ কৃষিতে মনোনিবেশ করা। ছাদ কৃষির সবুজে সম্ভাবনা ছাদ কৃষির প্রতি নগরবাসীর আগ্রহ বাড়ছে। ফলে বহুমাত্রিক সুবিধা ও সাফল্যের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ছাদ কৃষিতে একদিকে যেমন বাগান পরিচর্যার মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা আসবে, তেমনি ছাদে সবুজ আভরণে পরিবেশের মলিনতা কাটিয়ে সবুজ সতেজতা আনবে। তাছাড়াও সবুজ অঙ্গন যত বাড়বে ততই নির্মল বায়ু, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে। জানলে অবাক হবেন, ছাদের বাগান বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা প্রায় ১.৭৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস হ্রাস করতে পারে। আমরা জানি, জার্মানিতে ১২% ছাদ ‘সবুজ’। টোকিওর আইনে সব বাড়ির নতুন ছাদের অন্তত ২০% সবুজ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সারা পৃথিবীতেই ছাদে চাষ পদ্ধতি জনপ্রিয় করার কাজ চলছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শহরগুলোর ১০ লাখেরও বেশি বাড়ির ছাদের আয়তন প্রায় একটি জেলার আয়তনের সমান। এক হিসাবে আড়াই কাঠার একটি বাড়ির ছাদে বাগান করে নিজস্ব চাহিদা পূরণ করে বছরে ৫০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করা সম্ভব। ছাদগুলো চাষাবাদের আওতায় আনলে বছরে একটা ছাদ থেকে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকার সবজি পাওয়া সম্ভব। নগরীর প্রতিটি বাড়ির ছাদ আঙ্গিনা ও বারান্দা কৃষি উৎপাদনের আওতায় আনা হলে তা থেকে বিপুল পরিমাণ শাক-সবিজ, ফল-ফুল, ঔষধি গাছ উৎপাদনসহ ছোট, মাঝারি খামারও গড়ে শত পকাটি টাকার আয়ের ব্যবস্থা হতে পারে। নগর সাজুক সবুজ সাজে শহরে সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপন করতে হলে সবুজ নগরী গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। তাই সারি সারি অট্টালিকার ছাদে, বারান্দা-ব্যালকনিতে গড়ে তুলতে হবে সবুজ বাগান। এটি খুব কঠিন কাজ নয়, আমাদের সামান্য ইচ্ছার প্রতিফলনেই ছোট ছোট বারান্দা, ব্যালকনি, ছাদ এমনকি ঘরের শোভায় গাছগাছালি পরিবেশে আনতে পারে সবুজ আবরণ এবং নির্মল বাতালের উৎস। ফুলের টব, অকেজো বালতি, অকেজো ড্রামে করতে পারেন মৌসুমি শাকসবজি চাষ, খেতে পারেন বারো মাস। আশার খবর হলো ছাদ কৃষিসহ শহরের বাসাবাড়িতে ফুলের গাছ ও অন্যান্য গাছগাছালি লাগানোর প্রবণতা অনেক বেড়েছে। সৌখিনতা দিয়ে শুরু হলেও এর সুফল পেতে শুরু করেছেন শহরের মানুষেরা। এখন অনেক বাসাবাড়ির ছাদ, বারান্দা ও ব্যালকনিতে দেখা যায় সবুজ গাছ আর রঙিন ফুল, ফল ও সবজির নান্দনিক শোভা। শহরের মানুষের এই প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টাকে উপজীব্য করে গড়ে উঠেছে অনেক অনেক নার্সারি। এতে কর্মসংস্থান হচ্ছে বহু মানুষের। রাসায়নিক ব্যবহার না করার ফলে সবজি খুব সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত হয়। বেগুন, টমেটো, বরবটি, ক্যাপসিকাম, ঝিঙ্গা, ধুন্দল. ঢেঁড়স, পুঁইশাক, করলা, মরিচ, মিষ্টি কুমড়াসহ নানা জাতের সবজি চাষ হচ্ছে ছাদে। ফলের মধ্যে- পেয়ারা, আম, কলা, লেবু, বড়ই, স্ট্রবেরি, পেঁপে, শরিফা, সফেদা, ডালিমসহ দেশীয় জাতের প্রায় সব ফলেরই ছাদে চাষাবাদ হচ্ছে। বাহারি দেশী-বিদেশী ফুলের চাষ আরও অনেক বছর আগে থেকেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অনেকে ছাদে ফুল, ফল ও সবজির মিশ্র চাষ করেও সফল হয়েছেন। ছোট একটা চৌবাচ্চায় করতে পারেন মাছ চাষ। ছাদে খরগোশ, কবুতর কিংবা কোয়েল পালনও করা যায়। উদ্যোক্তাদের পাশে আছেন যারা যারা বাড়ির ছাদে বাগান করেছেন বা করতে চান তাদের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে ‘সবুজ ঢাকা’ নামের একটি পরিবেশবাদী সংগঠন। আগ্রহীরা মৎববহ.ফযধশধ১৫@মসধরষ.পড়স অথবা ফেসবুক পেজ িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/ ংযড়নঁলউযধশধ১৫। ছাদে বাগানে আগ্রহীদের সহযোগিতা দিয়ে থাকে ‘গ্রিন বাংলা’, যোগাযোগ-০১৭১১৪৩৪৬৪৭ নম্বরে। গ্রিনসেভারস নামে আরেকটি সংগঠন ছাদ বাগানের আন্দোলনকে সামাজিকীকরণে প্রায় ৪০০ স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে কাজ করছে। রাজধানীর রাইফেলস, রাজউকসহ বেশকিছু বিদ্যালয়ে অক্সিজেন ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে গ্রিনসেভারস। ঋণ দিয়ে ছাদ বাগান কার্যক্রমকে উৎসাহ দেয়ার চেষ্টা করছে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। তবে কেন্দ্র্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেশের অন্যান্য ব্যাংকেও পরিবেশ রক্ষার এই উদ্যোগে অংশ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিকাশে প্রয়োজন সরকারী উদ্যোগ ছাদ কৃষি বহুমাত্রিক সুবিধা ও সুফল পাওয়ার জন্য সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ খুবই জরুরী। পরিবেশকে সহনীয় করতে শুধু বাড়ির ছাদে নয় চীন বা কোরিয়ার মতো অফিসের বিশাল ছাদগুলোকেও ছাদ কৃষির আওতায় আনা প্রয়োজন। জাপান ও চীনে ছাদে গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ অন্যান্য শহরে ছাদে গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক করতে পারে সরকার। সরকারী সকল অফিস বা ভবনের ছাদে কৃষি ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে ছাদ কৃষি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। বেসরকারী ও বাণিজ্যিক ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদে, বারান্দায়, সিটি কর্পোরেশনের মার্কেটের ছাদে বাগান বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। ছাদ কৃষি উদ্যোক্তাদের জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পুরস্কার প্রবর্তন, হোম ট্যাক্স মওকুফ, গ্রিনসেভারস লোন সুবিধা দিলে এটি সামাজিক আন্দালনে রূপ নেবে। ছাদে বাগানের উপকারিতার দিকসমূহ ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। নতুন বাড়ি তৈরির অনুমোদনে প্রত্যক ছাদের ৫০ ভাগ ছাদ কৃষির আওতায় আনা বাধ্যতামূলক করে আইন করা প্রয়োজন। ছাদ কৃষকদের জন্য সুবিধা প্রাপ্য গ্রিনসেভারস কার্ড দেয়া যেতে পারে। ব্যাংকগুলোকে ছাদ কৃষির জন্য নামমাত্র সূত্রে লোন সহায়তার নির্দেশনা প্রয়োজন। পরিবেশ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদের নিজস্ব তহবিল থেকে ছাদ কৃষি জনপ্রিয়করণে সহায়তা ও প্রচারণা বাড়ানো দরকার। নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, কৃষিবিদ, উপকরণ সরবরাহকারীদের প্রতিনিধি, ছাদে বাগানকারী সংগঠনের প্রতিনিধি, সিটি কর্পোরেশন, নগর উন্নয়ন কর্পোরেশন, পরিবেশবিদ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ‘গ্রিন সিটি ডেভেলপার ফোরাম’ গঠন করা যেতে পারে।
×